হজ ও মহানবী (সা.) নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে মন্ত্রিত্ব ও দলীয় সদস্য পদ হারানো আবদুল লতিফ সিদ্দিকী স্বেচ্ছায় এমপি পদথেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।রোববার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) শুনানিতে অংশ নিয়ে লতিফ সিদ্দিকী স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে এমপি থেকে পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়ে যান। পদত্যাগের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইসির শুনানি দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধের অনুরোধ জানান তিনি।নির্বাচন কমিশনের শুনানি বন্ধে উচ্চ আদালতে আইনি লড়াই চালিয়ে হেরে যাওয়ার পর শুনানিতে অংশ নিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন তিনি। পদত্যাগের কারণ হিসেবে লতিফ সিদ্দিকী শুনানির এক পর্যায়ে বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও সদস্য পদ বাতিল চেয়েছে। আমার তো কিছু করার নেই, তাই তাদের সঙ্গে একমত। তাই আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছি।যদিও শুনানি শেষে ইসিতে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমার নেতা চান না আমি এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করি। সংসদ সদস্য পদ নিয়ে আমার কোনো লোভ নেই। তাই দলের প্রতি, নেতার প্রতি আস্থা ও আনুগত্যের অংশ হিসেবে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেব।গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে একটি অনুষ্ঠানে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী পবিত্র হজ ও মহানবী (সা.) নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় প্রথমে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সর্বশেষ প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার সংসদ সদস্য পদ বাতিলে স্পিকারকে চিঠি দেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ থাকবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নিতে ইসিকে চিঠি দেন স্পিকার। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও লতিফ সিদ্দিকীর লিখিত বক্তব্যের পর রোববার শুনানির আয়োজন করে ইসি।শুনানি শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, লতিফ সিদ্দিকী স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। কিভাবে একজন সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করবেন তা সংবিধানে বলা রয়েছে। তিনি (লতিফ সিদ্দিকী) তা মেনেই কাজ করবেন বলে আশা করি। অপর নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, লতিফ সিদ্দিকী পদত্যাগ করবেন জানিয়ে শুনানি দুই সপ্তাহের জন্য মুলতবি করার অনুরোধ জানান। যেহেতু তিনি পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছেন তাই শুনানি মুলতবি করা হয়েছে। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছে ইসি। ওই পরিস্থিতি বিবেচনায় পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।পদত্যাগের ঘোষণার আগে কমিশনের শুনানি বন্ধে আইনগত লড়াই চালান আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। কমিশনের শুনানিতে অংশ নেয়ার চিঠির কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন তিনি। ওই চিঠি কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে রুলও চান তিনি। হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ২০ আগস্ট আবেদনটি খারিজ করে দেন। এরপর হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার আদালতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের নোটিশ স্থগিতের আবেদন করেন তিনি। চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দিলে রোববার তা শুনানির জন্য ওঠে। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ ‘নো অর্ডার’ দিলে হাইকোর্টের আদেশ বহাল থাকে। এরপর লতিফ সিদ্দিকী কমিশনে শুনানিতে অংশ নিতে চলে আসেন। বেলা ১১টায় শুরু হওয়া শুনানি চলে মাত্র ১৪ মিনিট। ইসির সম্মেলন কক্ষে শুনানিতে ছিলেন সিইসি, চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম ও আইন শাখার যুগ্ম সচিব মো. শাহজাহান। আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে তার আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শুনানিতে উপস্থিত না থাকলেও তার প্রতিনিধিত্ব করেন দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবির কাউছার ও সাইফুদ্দিন খালেদ।শুনানিতে ইসির যুগ্ম সচিব আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে তার বক্তব্য তুলে ধরার আমন্ত্রণ জানালে তিনি নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি কি এখানে কথা বলব, নাকি পাশের ডায়াসে যাব?’ এরপর এগিয়ে এসে সামনে রাখা ডায়াসে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ। তিনি বলেন, আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি সাচ্চা মুসলমান, আমি জন-আস্থায় বিশ্বাস করি। জনতার আদালতে আমি গিয়েছি। আমি সংসদ সদস্য। আইনগতভাবে ও সাংবিধানিকভাবে সংবিধানের ৬৬(৪) ধারা অনুযায়ী আমার বিষয়ে স্পিকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় আমাকে হাইকোট-সুপ্রিমকোর্টে যেতে হয়েছে। নিজের অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে লতিফ বলেন, এর আগে বহুবার দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও এমন শুনানিতে কখনও আসতে হয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমি আনন্দের সঙ্গে, নির্লিপ্তভাবে ঘোষণা করছি, আমি টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করব। এটা আমার ঘোষণা, আমার সিদ্ধান্ত। এ সময় নির্বাচন কমিশনের শুনানির দরকার নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আপনাদের আর কোনো কার্যক্রম নেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। আপনাদের কষ্ট দিলাম। আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করছি, এখান থেকে মাত্র ৫ মিনিট পরই তা কার্যকর হবে। স্পিকারের কাছে বিষয়টি জানানো হবে। এ সময় দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন কায়েমের প্রত্যাশা রাখেন তিনি। পরে কমিশনের কাছে ইংরেজিতে লেখা একটি কাগজ তুলে দেন। ওই কাগজে পদত্যাগের সিদ্ধান্তের বিষয়টি লেখা রয়েছে বলে জানা গেছে।এরপর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবির কাউছারকে শুনানিতে বক্তব্য দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। ডায়াসে দাঁড়িয়ে এ আইনজীবী বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, উনি (লতিফ) তো পদত্যাগের কথা বলছেন। এখন কি আমাকে আর কিছু বলতে হবে? এ সময় নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ তার উদ্দেশে বলেন, আপনি আপনার বক্তব্য উপস্থাপন করুন। উনি (লতিফ) তো পদত্যাগের ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তখন নিজের আসন থেকে দাঁড়িয়ে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত বলেছি। আমি সংসদে গিয়ে স্পিকারকে তা জানাব।এ সময় আওয়ামী লীগের আইনজীবী রিয়াজুল কবির কাউছার বলতে থাকেন, নির্বাচনী আইন ও সংবিধান অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীর আর সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকার সুযোগ নেই। তার সদস্য পদ বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারেরর সঙ্গে কথা বলেন নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক। ইসি জানতে চায়, আওয়ামী লীগের দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করেন কিনা? লতিফ বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও সদস্য পদ বাতিল চেয়েছে। আমার তো আর কিছু করার নেই, তাদের সঙ্গে একমত। তাই আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছি।এরপর সিইসি বলেন, লতিফ সিদ্দিকী স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন, পদত্যাগের ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এখন কিভাবে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয় তা সংবিধানে বলা রয়েছে। তিনি তা মেনেই কাজ করবেন আশা করি। শুনানি শেষে দুই সপ্তাহের মধ্যে বিতর্ক নিষ্পত্তির বিধান থাকায় এ বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্তও পরে জানানো হবে বলে উল্লেখ করেন সিইসি। তিনি বলেন, শুনানি আপাতত মুলতবি রাখা হল। দুই সপ্তাহ পরে এ বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্ত জানাব।শুনানি থেকে বের হয়ে লতিফ সিদ্দিকী অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ভালো সংবাদের অপেক্ষায় রয়েছেন নিশ্চয়ই। এরপরই তিনি বলতে থাকেন, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার হয়েছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে বিলম্ব হয়েছে। আমি অবগত ছিলাম। আমার নেতা চান না আমি এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করি। সংসদ সদস্য পদ নিয়ে আমার কোনো লোভ নেই। তাই দলের প্রতি, নেতার প্রতি আস্থা ও আনুগত্যের অংশ হিসেবে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেব।লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমার কাছে মূল্যবান হচ্ছে জনগণের ভালোবাসা। জনগণের ওপর আস্থা রয়েছে। আমি কমিশনকে বলেছি, আমি আর এ মামলা লড়তে চাই না। আমার সংসদ সদস্য পদ রক্ষার জন্য আর বৃথা লড়াই করব না। আমি যেহেতু অনুগত, সেহেতু আমি কমিশনকে বলেছি, আজকের এ শুনানি মুলতবি করা হোক। আমি স্পিকার বরাবর আমার পদত্যাগপত্র পৌঁছে দেব। সংসদ সদস্য পদ নিয়ে লড়ার মতো দুর্বল মানসিকতা আমার নেই। কমিশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে লতিফ সিদ্দিকী বলতে থাকেন, আমি চাই এদেশের কল্যাণ হোক। জঙ্গিবাদ, অনাচারের বৈষম্যের রাজনীতি, হানাহানির রাজনীতি নির্মূল হোক। ন্যায় প্রতিষ্ঠা হোক। এ দেশের কল্যাণ… শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠা…। আপনাদের কল্যাণ হোক, শেখ হাসিনা দীর্ঘজীবী হোক, জয় বাংলা।