শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

বিল পাস, বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে

pic-06_130130

জাতীয় সংসদে বহুল আলোচিত সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪ পাস হয়েছে। এর ফলে বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হবে বর্তমান সংবিধানে। বিলটি আইনে পরিণত হলেই উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পাবে সংসদ। তবে কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করতে হলে তাঁর বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে অভিযোগ বিশেষ কমিটির তদন্তে প্রমাণিত হতে হবে। আর ওই তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হবে। এরপর সংবিধানে পুনর্বহাল হওয়া ৯৬ অনুচ্ছেদ কার্যকর করা সম্ভব হবে।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর শেষে দিনের অন্যান্য কার্যসূচি স্থগিত করে বিল পাসের কার্যক্রম শুরু হয়। বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। বিলটির ওপর জনমত যাচাই-বাছাই এবং ৩০টি সংশোধনী প্রস্তাব দেন জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও বিএনএফের সদস্য এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মিলিয়ে মোট ১৫ জন। তাঁদের মধ্যে আছেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু।
জাতীয় পার্টির সদস্যরা বিলের পক্ষে অবস্থান নিলেও তড়িঘড়ি করে গুরুত্বপূর্ণ এই বিল পাসের কঠোর সমালোচনা করেন। তাঁরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা ও জনমত যাচাইয়ের পর বিলটি পাসের দাবি উত্থাপন করেন। নানা ইস্যুতে পার্টির অভ্যন্তরে বিরোধ থাকলেও বিলের ওপর আলোচনায় তাঁরা একই সুরে কথা বলেন। এ ছাড়া সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা বিচারক নিয়োগের বিধান যুগোপযোগী করার দাবি জানান।
পরে সংসদের লবিতে স্থাপিত বুথে গোপন ব্যালটে বিভক্তি ভোটে বিলটি পাস হয়। সংসদে উপস্থিত ৩২৮ জনের মধ্যে ৩২৭ জন বিলের পক্ষে ভোট দেন। ভোট গণনা শেষে স্পিকার ফলাফল ঘোষণা করেন। একজন সংসদ সদস্য ভোটদানে অংশ নেননি। তবে এর আগে প্রথম দফায় সংসদীয় কমিটির সংশোধনী প্রস্তাবকে বিলের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে ভোটগ্রহণকালে ৩২৮ জনই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। উৎসবমুখর পরিবেশে এই ভোটগ্রহণ শেষে বিল পাসের ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টেবিল চাপড়ে উপস্থিত সংসদ সদস্যরা অভিনন্দন জানান। এই বিলটি পাস হওয়ায় স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপিত হবে। ওই অনুচ্ছেদে কোনো বিচারককে তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে অপসারণের বিধান ছিল। তবে সংশোধিত অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের চাকরির বয়স বর্তমান বিধান অনুযায়ী ৬৭ বহাল রাখা হয়েছে।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণসংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং তাদের পক্ষে এই ক্ষমতা প্রয়োগের কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। এর প্রতিফলনে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারককে তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে অপসারণের বিধান ছিল। কিন্তু পরে এই পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন ব্যবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে কোনো বিচারককে তাঁর পদ হতে অপসারণ করা যাবে বলে বিধান করা হয়। ওই বিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল যে, কোনো বিচারককে তাঁর সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর যুক্তিসংগত সুযোগদান না করা পর্যন্ত তাঁকে অপসারণ করা যাবে না। ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালের সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে অভিযোগে অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অন্য দুজন প্রবীণ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংসদ রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের মতো উচ্চ আদালতের বিচারকদের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতার নীতি বিশ্বের বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিদ্যমান রয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ৯৬-এর দফা ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮-এর পরিবর্তে ১৯৭২ সালের প্রণীত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা ২, ৩ ও ৪ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদেরকে সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে এ বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। উক্ত বিলের ৩ দফা অনুযায়ী কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। সুতরাং ওই আইনে সুনির্দিষ্টকৃত পদ্ধতি অনুসরণে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে অপসারণের সুযোগ থাকবে না। এমতাবস্থায় বিলটি আইনে পরিণত হইলে স্বচ্ছতা দৃশ্যমান হইবে এবং স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে বিচারকগণ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব অবাধ ও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে পালনের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সমুন্নত রাখতে পারবেন।’
গত ৭ সেপ্টেম্বর বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ওই দিনই বিলটি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। যাচাই-বাছাই শেষে বিলের ওপর সংসদে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সংসদীয় কমিটি ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর মাত্র দুটি বৈঠকেই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে।
এর আগে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে ওই সংশোধনীর মাধ্যমে। সংসদে বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সেদিন বিলটি পাস হয়েছিল।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য : বিলটি পাসের আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সংবিধান সংশোধন বিল পাস হলে বিচারপতিদের স্বাধীনতা আরো সুরক্ষিত হবে। আর সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ কার্যকর করতে আগামী তিন মাসের মধ্যে নতুন আইন করা হবে, যাতে বিচারকদের অসাদচরণ ও অসমর্থের ব্যাখ্যা থাকবে। তদন্তপ্রক্রিয়াসহ যাবতীয় বিষয়টি এ আইনে থাকবে।
আগের বিধান তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, সংসদ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং স্পিকারকে অপসারণ করতে পারে। কিন্তু গুরুতর অসদাচরণ ও অসমর্থ বিচারপতিকে সংসদ অপসারণ করতে পারে না। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু জনগণের অধিকারের ব্যাপারে কখনোই আপস করেননি। ’৭২ সালের সংবিধানে জনগণের অধিকারের কথা বলা আছে। ’৭২ সংবিধানে যা ছিল, তা হুবহু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে মাত্র।
এই বিল পাসের মাধ্যমে বিচারপতিদের মর্যাদা সমুন্নত রাখা হচ্ছে উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিচারপতিদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার ব্যবস্থা রেখেছি। কেউ অসদাচরণ না করলে তাঁকে কেন সরানো হবে? আর কাউকে অপসারণ করা হলে তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে করা হবে। এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
বিল বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাব : সংবিধান সংশোধন বিল পাস হওয়ার আগে এটি বাছাই কমিটিতে পাঠিয়ে রিপোর্ট প্রদানের জন্য প্রস্তাব করেন আটজন সংসদ সদস্য। তাঁদের মধ্যে স্বতন্ত্র সদস্য মো. রুস্তম আলী ফরাজী চলতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পাঁচজন সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। একই প্রস্তাব করেন স্বতন্ত্র সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী, জাতীয় পার্টির এম এ হান্নান, ইয়াহইয়া চৌধুরী ও মো. আবদুল মতিন এবং বিএনএফের এস এম আবুল কালাম আজাদ। এ ছাড়া তিন সদস্যের কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান। আর ছয়জন সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিম।
জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব : বিলটির ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ, জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, কাজী ফিরোজ রশীদ, মো. আবদুল মতিন, নুরুল ইসলাম মিলন, পীর ফজলুর রহমান, এম এ মান্নান, রওশন আরা মান্নান ও ইয়াহইয়া চৌধুরী, জাসদের মঈন উদ্দীন খান বাদল, বিএনএফের এস এম আবুল কালাম আজাদ এবং স্বতন্ত্র সদস্য মো. রুস্তুব আলী ফরাজী, হাজি মো. সেলিম ও তাহজীব আলম সিদ্দিকী।
সংশোধন প্রস্তাব : সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪ সম্পর্কে স্থায়ী কমিটির রিপোর্টের ১ দফায় সংশোধনী এনেছেন মোট তিনজন সংসদ সদস্য। তাঁদের মধ্যে রুস্তুম আলী ফরাজী বিচারপতিদের বয়স ৭০ বছর করার প্রস্তাব করেন। এ ছাড়া হাজি মো. সেলিম ও এম এ হান্নান দফা ১-এর ওপর সংশোধনী আনেন। দফা ২-এর ওপর সংশোধনী এসেছে ২৭টি।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মো. রুস্তুম আলী ফরাজী দফা ২-এ প্রস্তাব করেন, ‘বিচারকদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও অসামর্থ্যরে কোনো প্রস্তাব সংসদে উত্থাপিত হলে সংসদের ন্যূনতম ১০০ জন সদস্যের ওই প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন থাকলে প্রস্তাবটি সরাসরি সংসদ কর্তৃক গঠিত জাজেস ইনকোয়ারি কমিশনে প্রেরিত হবে এবং সংসদ ওই কমিশনের তদন্ত রিপোর্টের মাধ্যমে প্রমাণিত অসদাচরণ ও অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করা যাবে না।’
তিনি দফা (২)-এর প্রস্তাবিত উপদফা (৪)-এর পর নতুন উপদফা (৫) সন্নিবেশের প্রস্তাব করেন। রুস্তুম আলী ফরাজী তাঁর প্রস্তাবিত ৫ উপদফায় বলেন, এই আইনটি কার্যকর হওয়ার পর অনতিবিলম্বে উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগের নীতিমালা তৈরি করার লক্ষ্যে ‘বিচারক নিয়োগ কমিশন’ গঠন করবেন।