রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

ঢাকার দিকে ধেয়ে আসছে বন্যা

খবরিকা ডেক্সঃ সারাদেশে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। এতে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে বন্যা। সারাদেশে বন্যায় এ পর্যন্ত ৩৭ জন মারা গেছেন। এছাড়া ঢাকাসহ আরও ৯টি জেলা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বন্যার বিস্তার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বিভিন্ন ধরনের দুর্ভোগ ও রোগবালাই। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

এরই মধ্যে কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরের সঙ্গে সারাদেশে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের ছোট-বড় ২৭টি নদীর পানি এখন বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় বাঁধ, উঁচু সড়ক, আশ্রয়কেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন দুর্গতরা।

এর মধ্যে খাদ্য সঙ্কটে পড়েছেন বানভাসীরা। অনেকের ঘরে খাবার থাকলেও তা রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারছেন না তারা। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্প্রতি উজানের দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানে এ বছর স্মরণকালের মারাত্মক বন্যা হয়েছে। আর উজানের দেশগুলোতে বন্যার প্রভাব পড়ছে ভাটির দেশ বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় সবক’টি জেলাই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। দেশের উজানে ৩টি অববাহিকায় (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা) গত ২-৩ দিন ধরে মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যবারের মতোই বন্যার পানি ঢাকায় ঢুকবে পূর্বাঞ্চলের অরক্ষিত বন্যাপ্রবণ এলাকা দিয়ে। গত ২-৩ দিনে যার লক্ষণ দেখা দিয়েছে শীতলক্ষ্যা আর বালু তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানির স্তরের ঊর্ধ্বমুখী অবস্থান থেকে। ঢাকা মহানগরী রক্ষা বাঁধের একাংশ সমাপ্ত হলেও পূর্বাঞ্চলীয় বাঁধ না হওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার গত ১ দশকের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ফলাফলেও ঢাকার পূর্বাঞ্চলকে বন্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পূর্বাঞ্চল দিয়ে বন্যার পানি ঢাকায় ঢুকলে তা সরতে অনেক সময় লাগবে। তাই সম্ভাব্য বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত ঢাকার সব সেবা সংস্থাকে সক্রিয়ভাবে প্রস্তুত করা দরকার। যদিও সে রকম ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ঢাকার বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। একই কথা বলেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারাও।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে ৫৫ বছরে সবচেয়ে বড় বন্যাটি হয় ১৯৯৮ সালে। তাতে দেশের ১ লাখ ২৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়। ১৯৮৮ সালের বন্যায় প্লাবিত হয় ৮৯ হাজার ৯৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকা।

২০১৪ সালে প্রকাশিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের গবেষণার ফল অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের পর ২০০৪ সালের জুলাইয়ে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা বড় বন্যায় প্লাবিত হয়। যা ঐ বছর আগস্ট পার হয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ২০০৭ সালে আরেকটি বড় বন্যা শুরু হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এ পর্যন্ত যতবার ঢাকা প্লাবিত হয়েছে তার প্রতিবারই পানি ঢুকেছে পূর্বাঞ্চল হয়ে। আর ডিএনডি বাঁধ নির্মাণের পর ঢাকার পশ্চিমাঞ্চল আগের তুলনায় বেশি সুরক্ষিত হলেও পূর্বাঞ্চল রয়ে গেছে আগের মতো অরক্ষিত। অবশ্য ঢাকা মহানগরীর বাইরে মানিকগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ সংলগ্ন ঢাকা জেলার অন্যান্য এলাকা প্লাবিত হয় পদ্মার প্রভাবে।

এদিকে চলতি মৌসুমের দ্বিতীয় দফার বন্যায় এ পর্যন্ত ২০ জেলার ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৯০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। বন্যা মোকাবিলা এরই মধ্যে দিনাজপুরে উদ্ধার অভিযানে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে অনেক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছে।

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিককায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, প্রধান নদ-নদীগুলোয় পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানান, নদ-নদীগুলোর ৯০টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের ৬৯টিতে পানি বাড়ছে। এর মধ্যে ২৭টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপরে বয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং সুরমা-কুশিয়ারায় সমান তালে পানি বেড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ধরলা, তিস্তা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধলেশ্বরী, গুর, ধলেশ্বরী, ইছ-যমুনা, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, আত্রাই, পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, যদুকাটা, সোমেশ্বরী ও কংশ নদীতে পানি বিপদসীমার ওপরে বইছে।

বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা প্রকাশ করে এ কর্মকর্তা বলেন, যমুনার বাহাদুরাবাদ কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ ও সারিয়াকান্দি পয়েন্টে পানি বইছে বিপদসীমার ৯৬ থেকে ১১৮ সেন্টিমিটার ওপরে। পদ্মার গোয়ালন্দ পয়েন্টেও বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপরে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলছেন, দেশের উজানে ৩টি অববাহিকায় (গঙ্গা, বহ্মপুত্র ও মেঘনা) গত ২-৩ দিন ধরে মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ হচ্ছে। ফলে এসব অববাহিকার ভারতীয় ও বাংলাদেশ অংশের নদীগুলোতে পানি বাড়ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনকে প্রস্তুতি নিতে বলেছে অধিদপ্তর।

পানি বৃদ্ধির হার অন্তত আরও ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে জানিয়ে বলা হয়েছে, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট জেলায় চলমান বন্যা গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত হবে। পাশাপাশি মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত হতে পারে।