রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা, রাষ্ট্রদূতকে তলব

26040_f4

বান্দরবান নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গোলাগুলির ঘটনায় ওই এলাকায় গতকালও উত্তেজনা বিরাজ করছিল। আতঙ্কে সীমান্ত এলাকার লোকজন নিরাপদে সরে গেছেন। গত বুধবার মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত বিজিবি সদস্য
মিজানুর রহমানের লাশ গতকাল ফেরত দিয়েছে বিজিপি। এদিকে পুরো ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়। গতকাল বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে বিজিবি মহাপরিচালক ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
গতকাল বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে নাইক্ষৎছড়ি সীমান্তের ৫২ পিলারের পাশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি ও মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)র পতাকা বৈঠক শেষে মিজানুর রহমানের লাশ ফেরত দেয় মিয়ানমার। লাশ ফেরতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাইক্ষ্যংছড়ি ৩১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শফিকুর রহমান। লাশ গ্রহণ করেন ৩১ ব্যাটালিয়নের মেজর তারেক ও সহকারী পরিচালক মোশাররফ হোসেন। তারা নিহত বিজিবি সুবেদারের লাশ সনাক্ত করেন। বিজিবি কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ফরিদ হোসেন ও ৩১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেম্বুছড়ি ক্যাম্পে ছিলেন। ১৭ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম বলেন, নিহত বিজিবি সদস্য মিজানুর রহমানের লাশ ফেরত দিয়েছে মিয়ানমার। এদিকে এ ঘটনায় নিখোঁজ হওয়া বিজিবির ৪ সদস্যের মধ্যে ২ সদস্য ল্যান্স নায়েক বাতেন, সিপাহি জাহাঙ্গীর ব্যারাকে ফিরে আসলেও এখনও অন্য ২ সদস্য নাইক্ষ্যংছড়ির দৌছড়ি-পাইনছড়ি সীমান্তের গহীন অরণ্যে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছেন। বিজিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে নিখোঁজদের যোগাযোগ হয়েছে। তবে তাদেরকে উদ্ধার করা যায়নি। তাদের সন্ধান পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিজিবি ৩৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর করীম। নিখোঁজ ২ বিজিবি সদস্যরা হলেন- ৩১ ব্যাটালিয়নের হাবিলদার মোতালেব ও আমিনুল। তারা গত বুধবার সকাল ৯টায় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্গম দৌছড়ি ইউনিয়নের মায়ানমার সীমান্তবর্তী পাইনছড়ি এলাকায় (বর্ডার গার্ড পুলিশ) বিজিবি বিওপি ক্যাম্পের কাছাকাছি স্থানে এসে মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি শতাধিক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। প্রায় ৪৫ মিনিট পর্যন্ত এই গুলি বর্ষণ চলে। মিয়ানমার সীমান্তের ৫২ পিলারে এ ঘটনা ঘটে। এসময় দায়িত্বরত পাইনছড়ি বিওপির নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমান গুলিবদ্ধ হয়ে মারা গেলে বিজিবি সদস্যরা জঙ্গলের দিকে সরে আসেন। মিজানুর রহমান নিখোঁজ হওয়ার পর এ নিয়ে বিজিবি বিজিপির কাছে পতাকা বৈঠকের আহবান জানালেও তাতে সাড়া দেয়নি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। গতকাল শনিবার দিনভর নিহতদেন স্বজনসহ বিজিবি সদস্যরা লাশের জন্য অপেক্ষা করলে ও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাতে সাড়া দেয়নি। অবশেষে সন্ধ্যা ৬ টার দিকে নিহত জোয়ানের লাশ বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এদিকে লাশ হস্তান্তরের পরে ও সীমান্তে এক প্রকার উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিজিবি ও বিজিপি দুই পক্ষই সীমান্তে অতিরিক্ত নিরাপত্তা জোরদার করেছে। ঘুমধুম বিজিবির সুবেদার সাহাব উদ্দিন জানান, সীমান্তের পরিস্থিতি নিয়ে লোকজন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। যে কারণে সীমান্তের উভয় পাড়ে জনমানব শূন্য হয়ে পড়েছে। রেজু আমতলী ক্যাম্পের সুবেদার মো. সোহ্‌রাব হোসেন জানান, বিজিপির গুলি বর্ষণের ঘটনার পর থেকে সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিজিবি সদস্যদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কঠোর সর্তক রাখা হয়েছে।বিজিবি ডিজির ব্রিফিং: এদিকে গতকাল বিকালে বিজিবিরি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ সংবাদ সম্মেলন করে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, সীমান্তে ৫২নং পিলারের কাছে গিয়ে দেখি, সেখানে গুলি লেগে নষ্ট হওয়া একটি মোবাইল ফোন পড়ে আছে। আর রক্তের ধারা চলে গেছে মিয়ানমারের দিকে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে প্রতিবেশী দেশে হামলা চালানোর কোন সুযোগ নেই। এ সময় বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) ঘাঁটি থাকার ব্যাপারে মিয়ানমারের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়ে প্রতিবেশী দেশে হামলা চালানোর কোন সুযোগ নেই। আমরা তাদের বলেছি, দেশে আরএসও কোন ক্যাম্প থাকলে তথ্য দেন। আমরা তাদের বিতাড়িত করবো। সম্পূর্ণ উস্কানিমূলকভাবে মিয়ানমারের সীমাস্তরক্ষীরা বিজিবির টহল দলের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে উল্লেখ করেন মেজর জেনারেল আজিজ। তিনি বলেন, মিয়ানমারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে শুধু বিজিবিই নয়, সেনাবাহিনীর সহায়তায় নাইক্ষ্যংছড়িতে অপারেশন পরিচালনা করি। কিন্তু আরএসওর কোন ক্যাম্প পাইনি। তিনি বলেন, এমনকি ওই দিক দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ছয়টি বিপিও (সীমান্ত চৌকি) স্থাপন করি।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ফের তলবকূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের ওপর মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)’র গুলিবর্ষণ এবং এক সদস্যকে হত্যার প্রতিবাদ জানাতে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থানকে ফের তলব করা হয়েছে। গতকাল সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘পদ্মা’য় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। এ সময় সীমান্তে গুলিবর্ষণ বন্ধ এবং নিহত বিজিবি সদস্যের দ্রুত ফেরত দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়। বুধবার থেকে মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। ওই দিন সকালে সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিজিবি সদস্যরা টহল দিচ্ছিলেন। এ সময় সীমান্তের ওপার থেকে বিনা উসকানিতে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। বিজিবিও পাল্টা গুলি ছোড়ে। ওই ঘটনায় বিজিবি’র নায়েক মিজানুর রহমান প্রথমে নিখোঁজ, পরে নিহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে তাৎক্ষণিক তলব করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও কনস্যুলার) মুস্তাফা কামাল রাষ্ট্রদূতকে তার দপ্তরে ডেকে নিয়ে ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে একটি কূটনৈতিক পত্রও দেন। গুলিবর্ষণ বন্ধ এবং ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি এড়াতে ঘটনার তদন্তও দাবি করেন তিনি। রাষ্ট্রদূতকে তলবের পরদিন (শুক্রবার) বিনা উসকানিতে দ্বিতীয় দফায় বিজিবি সদস্যদের ওপর গুলিবর্ষণ করে বিজিপি। ওই দিন নিহত বিজিবি সদস্যের লাশ হস্তান্তরের কথা ছিল। গতকাল সরকারি ছুটির দিনে রাষ্ট্রদূততে ডেকে আনা হয় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। সেখানে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেন সচিব মুস্তাফা কামাল। ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি এড়াতে ঘটনাগুলোর বিস্তারিত তদন্তের দাবি জানানো হয়। রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি তার যথাযথভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেছে মর্মে যে রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে তার প্রতি রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশের কর্মকর্তা বলেন, এটি সীমান্ত চুক্তি ১৯৮০-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যদি সেনা মোতায়েন করে থাকে, তাহলে দ্রুত যেন তা প্রত্যাহার করা হয়। ঢাকার পররাষ্ট্র দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ঘটনার অনুরূপ প্রতিবাদ জানিয়ে মিয়ানমার পররাষ্ট্র দপ্তরকে কূটনৈতিক পত্র পাঠিয়েছে দেশটিতে থাকা বাংলাদেশ মিশন। সেখানে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করা হয়েছে। দু’টি ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে, তাতে বিরূপ প্রভাব পড়ে এমন কর্মকাণ্ড যাতে মিয়ানমার সরকার প্রশ্রয় না দেয় সেই অনুরোধও জানানো হয়েছে। মিয়ানমার রাষ্ট্রদূত অবশ্য বলেছেন, সীমান্তে সামপ্রতিক ঘটনা বিজিবি মহাপরিচালকের আসন্ন মিয়ানমার সফরে কোন প্রভাব ফেলবে না, বরং এ সফরের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ দু’টি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তকে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল রাখাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আগামী ৯-১৪ই জুন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের মিয়ানমার সফরের কর্মসূচি রয়েছে। এ ছাড়া আগামী ১৮ই জুন ঢাকায় অনুষ্ঠেয় ঢাকা নেপিড ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন’-এর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি থাকার বিষয়টিও স্মরণ করেন দেশটির রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থান।