সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

বেসিক ব্যাংকে ফের জালিয়াতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ উপেক্ষা করে আবারও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত বেসিক ব্যাংকে। এবার জালিয়াতি হয়েছে পরিচালনা পর্ষদের এজেন্ডা ঘিরে। পর্ষদ ১৫টি এজেন্ডা বাতিল করে দিলেও চেয়ারম্যানের নির্দেশে পরে তা কার্য়বিবরণীতে অনুমোদিত বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অনুমোদন ছাড়াই ৪৭ কোটি টাকা ঋণছাড় করা হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতারণা ও জালিয়াতির শামিল বলে উল্লেখ করেছে।
সম্প্রতি বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেসিক ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে পর্ষদের এজেন্ডায় তালিকাভুক্ত না করে তা অনুমোদন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে পর্ষদ সভার কমপক্ষে তিন দিন আগে এজেন্ডা সদস্যদের জানানোর কথা। কিন্তু পর্ষদের বাতিল করে দেয়া ১৫টি এজেন্ডাকে কার্যবিবরণীতে অনুমোদিত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে।
এর বাইরে ব্যাংকের পর্ষদের বৈঠক চলাকালীন নতুন আরও তিনটি এজেন্ডাকে অনুমোদনের জন্য তড়িঘড়ি করে উপস্থাপন করা হয়, যা বৈঠকের কার্যবিবরণীতে ছিল না। নিয়ম অনুযায়ী এই এজেন্ডাগুলো তিন দিন আগে কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল।
এই জালিয়াতি ও অনিয়মের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই বেসিক ব্যাংকে অনিয়মগুলো ঘটছে। এত অভিযোগের পরও যেহেতু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না সে কারণে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান সাহস পাচ্ছেন এসব অনিয়ম করতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে আরও দেখা গেছে, গুলশান শাখায় অনুমোদন পত্র প্রাপ্তির আগেই জনৈক গ্রাহককে ১০ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ৮ মে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৩৩১তম সভার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এসব জালিয়াতি ও প্রতারণার সন্ধান পায়। এসব ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও বরখাস্তকৃত ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফকরুল ইসলামকে। বেসিক যেহেতু সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক সেই কারণে এই অনিয়ম উদঘাটনের তদন্ত প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকেও অবহিত করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগে পাঠানো বেসিক ব্যাংকের অনিয়মের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৮ মে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৩৩১তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ২৫১টি আলোচনার বিষয় উপস্থাপন করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পায় সভা চলাকালে নিয়ম ভেঙে আরও তিনটি এজেন্ডা আলোচনার জন্য উপস্থাপন করা হয়। বৈঠকের নিয়ম অনুযায়ী এই এজেন্ডা সভা শুরুর তিন দিন আগে কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা। কিন্তু সেটি করা হয়নি।
বৈঠকে তোলা এজেন্ডাগুলোর মধ্যে মোট ১৫টি এজেন্ডা পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যের সিদ্ধান্তে বাতিল করা হয়েছিল। যদিও এসব এজেন্ডা আগেই বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু ৩৩১তম বৈঠকের কার্যবিবরণীতে বাতিলকৃত এজেন্ডাগুলো অনুমোদন দেখানো হয়।
সর্বশেষ বাতিলকৃত ২৪০ নম্বর এজেন্ডা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ল্যাবস এন্টারপ্রাইজের নামে টার্ম লোনের মঞ্জুরিকৃত ৪০ কোটি টাকার মধ্যে ২৭ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বাকি ১৩ কোটি টাকা মেসার্স বি আলম শিপিং লাইন লিমিটেডের অনুকূলে দেয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়। ২৭ কোটি টাকা উত্তোলন করার ফলে সুদ-আসলে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু সুদের পরিমাণ হচ্ছে ১০ কোটি ১২ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোঁজ নিয়ে জানতে পারে টার্ম লোন নেয়া কোম্পানি ল্যাবস এন্টারপ্রাইজের মালিকানা ও সমুদয় দায়-সম্পদ ক্রয়ের জন্য প্রস্তাব দেয় বি আলম শিপিং লাইন লিমিটেড। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, বকেয়া ঋণ ৩৭ কোটি ১২ লাখ টাকা থাকা অবস্থায় সুদ ১০ কোটি ১২ লাখ টাকা সুদবিহীন ব্লক অ্যাকাউন্টে রেখে অবিতরণ করা ১৩ কোটি টাকা মেসার্স বি আলম শিপিং লাইনের অনুকূলে বিতরণের অনুমোদন বিধিবহির্ভূত।
জানা গেছে, বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটি এই ঋণ অনুমোদনের বিপক্ষে মত দিয়েছে। এজেন্ডার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য ক্রেডিট কমিটির কোনো সুপারিশ ছিল না। তা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য ও বিধিবহির্ভূত প্রস্তাব পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়, সীমাহীন অনিয়মের মাধ্যমে পাঠানো কার্যবিবরণীতে প্রস্তাবটি অনুমোদন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুসন্ধান করে দেখতে পায়, পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফকরুল ইসলাম অবৈধভাবে এই অনুমোদন দেয়ার কারণে গুলশান শাখা বিধির বাইরে গিয়ে অনুমোদনপত্র পাওয়ার আগেই ৫ কোটি করে দুই দফায় ১০ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ তৈরি করে দেয় ওই কোম্পানিকে।

উৎস- যুগান্তর