রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

বিশ্বকাপে বিশ্ব মাতাল

10_110822

মাঠের ঠিক মাঝখানে বিশাল আকৃতির বল। পদ্মফুলের মতো সেই বলই মূল মঞ্চ। যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলেন ৬০০ পারফরমার। ঘূর্ণায়মান সেই বল দেখাতে শুরু করল একের পর এক জাদু। সূচনায় ২০১৪ ফিফা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী ৩২ দেশের ভাষায় বিশ্ববাসীকে বলা হল ‘হ্যালো’। বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ১৫ মিনিটে সাম্বার দেশ ব্রাজিলে শুরু হয় ফুটবল বিশ্বকাপের মোহনীয় ও মদির, বর্ণিল ও বিদ্যুতাড়িত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এই গ্রহের প্রতিটি ফুটবল-গৃহকোণে মাদকতা ছড়ানো ‘হ্যালো’ সম্ভাষণ অনুরণিত হওয়ার পর ঐন্দ্রজালিক আবেশ ছড়াতে সেই দৈত্যাকৃতির বর্ণিল বল থেকে বেরিয়ে এলেন শিল্পীত্রয়ী ব্রাজিলের ক্লদিয়া লেইতে, র‌্যাপার পিটবুল এবং হলিউডের লাস্যময়ী ললনা জেনিফার লোপেজ। লোপেজ কিন্নরকণ্ঠী না হলেও ন্যাড়া মাথার পিটবুল এবং ক্ষীণাঙ্গিনী ক্লদিয়ার সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন- ‘উই আর ওয়ান’ শিরোনামের গানে। পেলে-গারিঞ্চা-সক্রেটিস-জিকো-রোনালদোর দেশ যেন শুধু ৩২ দেশকে নয়, এই গ্রহের সব্বাইকে আমন্ত্রণ জানাল ফুটবলের মহাযজ্ঞে শরিক হতে।
সাড়ে বারো হাজার রেস্তোরাঁর শহর, ব্রাজিলের সাংস্কৃতিক রাজধানী সাও পাওলোতে বিশ্বকাপ আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল যুগপৎ রঙে-ঢঙে, গীতে-নৃত্যে এবং প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষে আরোহণ করে। ‘শো দ্য ওয়ার্ল্ড হোয়্যার ইউ আর ফ্রম/শো দ্য ওয়ার্ল্ড উই আর ওয়ান’- সাও পাওলোর অ্যারেনা করিন্থিয়ান্স থেকে এই উদাত্ত আহ্বান ছড়িয়ে পড়ল এই গ্রহের কত শত-সহস্র-কোটি গৃহের কোণে কোণে। ‘বিশ্বকে দেখিয়ে দাও আমরা কোথা থেকে এসেছি/বিশ্বকে দেখিয়ে দাও আমরা এক।’ ৩২ দিন ৬৪ ম্যাচে এই বাণীই তো গুঞ্জরিত হবে কখনও লাতিন ঘরানার শিল্পিত ফুটবলে। কখনও ইউরোপের শক্তি ও গতির শৈলীতে।
সবুজ মাঠ যদি ক্যানভাস হয়, তাহলে মাঠের ২২ ফুটবলার একেকজন দক্ষ শিল্পী। মাঠের সবুজ ক্যানভাসে তারা তুলির আঁচড় বুলিয়ে দেন কখনও চোখ ধাঁধানো ড্রিবলিংয়ে, আবার কখনও চকিত ওভারল্যাপে, ত্বরিত ভলিতে অথবা ছোট্ট চিপে কিংবা ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো লক্ষ্যভেদী নিপুণ শটে।কাল ব্রাজিল বিশ্বকে এও দেখালো যে, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, প্রতিবাদ, অসন্তুষ্টি চাপা দিয়ে পেলের দেশ হলুদ-সবুজে নিজেদের রাঙিয়ে ফুটবলে বিভোর হতে জানে। ঠিক যেভাবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শারীরিক প্রতিবন্ধী পারফরমার হুইল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান বিশেষভাবে তৈরি পোশাকের সাহায্যে। এখন ব্রাজিল উঠে দাঁড়ালেই হয়। মায়াবী বিভ্রম ছড়ানো ২৫ মিনিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফুটবলযজ্ঞ। স্বাগতিক ব্রাজিল ‘হেক্সা’ (ষষ্ঠ শিরোপা) মিশন শুরু করে বলকান রাজ্যের দৈত্য ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। জাপানি রেফারির প্রথম বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় ২০১৪ ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের মূলপর্ব।সকাল থেকেই সাও পাওলো উৎসবের নগরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরেই সাজ সাজ রব চারদিকে। হলুদ-সবুজের আধিক্য চারদিকে। ব্রাজিলের জাতীয় রঙে রাঙা মানুষ, পথ-ঘাট সবই। মাত্র ৬৭ হাজার মানুষের আসন বিশ্বকাপ উদ্বোধনের ভেন্যু করিন্থিয়ান্সে। যারা টিকিট পেয়েছেন তারা তো মহা ভাগ্যবান। সারা জীবন এই একটি দিনের গল্প করে কাটাতে পারবেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে পারবেন এই অভিজ্ঞতার কথা। আর যারা টিকিট চেয়েও পাননি, তেমন হাজারও ব্রাজিলিয়ান ও পর্যটক ধরেছিলেন স্টেডিয়ামের পথ। পাতাল রেল থেকে শুরু করে পায়ে হাঁটা পথ, সব জায়গায় তাদের ব্যস্ততা। সময়মতো স্টেডিয়ামে পৌঁছে যেতে হবে। স্টেডিয়ামে থেকে বা বাইরে থেকেই হতে হবে ইতিহাসের অংশ। বাইরে বিশ্বকাপের ফ্যান জোন তো আছেই। প্রতি ম্যাচে সমর্থকরা যেখানে জমান আড্ডা। স্টেডিয়ামের বাইরে স্টেডিয়াম বলা যায় একে। জায়ান্ট স্ক্রিনে স্টেডিয়ামের বাইরে বসে ভেতরে থাকার অনুভূতি নেয়া যায়। সেই অনুভূতি নিতেই হাজারও মানুষ উপস্থিত। বিশ্বকাপ উদ্বোধনের পরই হল ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ। ২০১৪ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ। সেটি স্টেডিয়ামের সবচেয়ে কাছে বসে হই-হুল্লোড় করে দেখার, সমর্থনে গলা ফাটিয়ে দেখার কারণটাও তো ছিল। এই যুগল আনন্দ নিতে আসা মানুষগুলোও স্বীকার করে গেছেন, এবারের বিশ্বকাপ উদ্বোধন সত্যিই ছাপিয়ে গেছে আগের সব আয়োজনকে।