সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

ঈদকে সামনে রেখে জাল টাকার ছড়াছড়ি

8922_15887

রাজধানীসহ সারা দেশে জাল টাকার ছড়াছড়ি। রমজান ও ঈদকে টার্গেট করে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে জাল টাকার চক্রগুলো বাজারে এখন ভীষণ সক্রিয়। ১০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকার নোটের পাশাপাশি ২০ ও ৫০ টাকার জাল নোটও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ভারত থেকে সীমান্ত গলিয়ে বিপুল পরিমাণ জাল টাকার নোট ঢুকছে। দেশের বিভিন্ন জেলায়ও তৈরি হচ্ছে জাল টাকা। ভারত, পাকিস্তান ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক জাল টাকা আনছে ও তৈরি করছে। এ দেশের প্রতারক চক্র তা বাজারজাত করছে। এদের অনেকেই একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছে পুলিশের কাছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাল টাকার সঙ্গে জড়িতরা গ্রেফতার হলেও তাদের আটকে রাখা সম্ভব হয় না। এদের অধিকাংশই এখন মুক্ত। গত ১৫ বছরে জাল টাকা সংক্রান্ত সাড়ে ৫ হাজার মামলা হলেও আসামিদের সাজা হয়নি। যে কারণে জাল টাকার ব্যবসা বেড়েই চলছে।

গত দুই মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ জাল নোটসহ অন্তত ২০ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে বিদেশি নাগরিকও রয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, রমজান ও ঈদকে টার্গেট করে তারা জাল টাকার মজুদ গড়ে তুলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন স্থানে যেসব জাল নোট ধরা পড়ে তার সঠিক পরিসংখ্যান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসে না। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে জাল নোট ধরা পড়লে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানোর বিধান থাকলেও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাশ কর্মকর্তারা তা নষ্ট করে ফেলেন। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যন্ত জাল নোটের হিসাব পৌঁছে না। এ প্রসঙ্গে পলওয়েল মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রায় দিনই দু-একটি জাল নোট ধরা পড়ে। ঝামেলা এড়ানোর জন্য ক্রেতাকে ভালোভাবে বিদায় দিয়ে থাকি। এ নিয়ে বেশি যাচাই-বাছাই করতে গেলে ব্যবসায় ক্ষতি হবে ভেবে চেপে যাই। গ্রাহকদের অভিযোগ, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকেও ইদানীং জাল নোট বেরিয়ে আসছে। বুথ থেকে জাল নোট বেরিয়ে এলে গ্রাহকের পক্ষে তা আর বদলে নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই এতে গ্রাহকদের শতভাগ ক্ষতি শিকার করতে হয়। যদিও ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটিএমে জাল টাকা শনাক্তকরণ মেশিন থাকায় জাল টাকা থাকার প্রশ্ন ওঠে না। রাজধানী ছাড়াও ঢাকার বাইরে জাল টাকার চিত্র আরও উদ্বেগজনক। প্রতারক চক্র রাজধানীতে জাল টাকা চালাতে খুব বেশি সুবিধা না করতে পারায় গ্রামাঞ্চলকে বেছে নিচ্ছে। জাল টাকা সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায় সেখানের সহজ-সরল মানুষ খুব বেশি প্রতারিত হচ্ছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এটিএম হাবিবুর রহমান বলেন, জাল টাকা চক্রের তৎপরতা ঈদসহ বিভিন্ন বিশেষ দিনকে কেন্দ্র করে বেড়ে যায়। প্রতিবারের মতো র‌্যাব এবারও জাল টাকার সন্ধানে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে।

চক্রের জাল দেশব্যাপী : পুলিশ ও গোয়েন্দার একাধিক সূত্র জানায়, জালিয়াত চক্রের বিশাল সিন্ডিকেট দেশব্যাপী নিয়ন্ত্রণ করছে জাল টাকার ব্যবসা। এর সঙ্গে কয়েকজন বিদেশি নাগরিকও জড়িত রয়েছে। এ চক্রের একাধিক সদস্য কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে জাল টাকা ও তৈরির সরঞ্জামসহ ধরা পড়লেও বন্ধ হয়নি তাদের তৎপরতা। জাল টাকার নোট নিজেদের মধ্যে লেনদেন করতে প্রতারকরা বিভিন্ন ধরনের সংকেত ব্যবহার করে থাকে বলে জানা গেছে। জাল এক হাজার টাকার নোটকে জুব্বা, ৫০০ টাকার নোটকে পাঞ্জাবি এবং ১০০ টাকার নোটকে ধোপা বলে ডাকা হয়। অপর এক সূত্র জানায়, জাল টাকা গ্রামগঞ্জে এজেন্টদের কাছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমিশনে বিক্রি করছে এ সংঘবদ্ধ চক্র। ১০০ টাকার জাল নোট ৪০ টাকায়, ৫০০ টাকার জাল নোট ২০০ টাকায় এবং এক হাজার টাকার জাল নোট বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে ১০ ও ১০০ টাকার নতুন নোট ভারতে পাচার করে সেখান থেকে ১০ টাকার নোটে ৫০ টাকা এবং ১০০ টাকার নোটে ৫০০ টাকা ছাপ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জাল নোট। শুধু টাকা নয়, রুপি ও ডলারও জাল হচ্ছে একই ধরনের কৌশলে। সূত্র জানায়, মাঠপর্যায়ে জাল নোট চালাতে এজেন্টরা লোক নিয়োগ করে থাকে। প্রতারক চক্র জাল টাকা চালানোর জন্য নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। জানা গেছে, জাল নোট বাজারে ছাড়ার জন্য একটি গ্রুপে দু-তিনজন করে থাকে। একজনের কাছে জাল টাকার বান্ডিল রাখা হয়। অন্যজন মাত্র একটি নোট নিয়ে পণ্য ক্রয়ের নামে জাল টাকা চালানোর চেষ্টা করে। জাল নোট ধরা পড়লে এ প্রতারক নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে শরীর চেক করে যেন অন্য কোনো জাল নোট না পাওয়া যায় সে জন্য দ্বিতীয় কোনো জাল নোট তার কাছে থাকে না। এভাবে একেক এলাকায় কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর দ্রুত তারা অন্য এলাকায় চলে যায়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ভারত, পাকিস্তান ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিক এ দেশে জাল টাকার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে কিছু নারী অপরাধীও রয়েছে। ভিনদেশী এসব অপরাধীদের সঙ্গে গভীর সখ্যতা রয়েছে এ দেশের প্রতারক চক্রের। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গ্রেফতার হন বহুল আলোচিত জাল নোট ব্যবসায়ী কামাল হোসেন ও হুমায়ুন কবির। তাদের কাছ থেকে ১০ লাখ ৪ হাজার টাকার জাল নোট উদ্ধার হয়। তারা জাল টাকা তৈরি এবং বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত অর্ধশত জাল টাকা প্রস্তুতকারীর মধ্যে অধিকাংশই বর্তমানে মুক্ত। হুমায়ুন কবির ও কামাল তৃতীয় দফায় গ্রেফতার হলেন। তাদের তৈরি জাল টাকা দেশের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষের চেনার কোনো পথ নেই। হুমায়ুন কবিরের তৈরি জাল টাকা এত সূক্ষ্মভাবে করা যা দেখে চেনা বা বোঝার উপায় নেই। প্রকাশ্য দিবালোকে হুমায়ুন কবিরের জাল টাকা দিয়ে বাজার করে পরীক্ষা করা হয়েছে। কেউ ধরতে পারেনি টাকাটি জাল। পরে অবশ্য দোকানিকে বলার পর তিনি টাকাটি ফেরত দিয়েছেন। নিজের কারখানায় তৈরি জাল টাকা দিয়ে কামাল হোসেন ঢাকা জেলার দোহার থানা এলাকায় ইতিমধ্যেই ৪ কাঠা জমি কিনেছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার রায়েরবাজার এলাকায় ৫ কক্ষবিশিষ্ট একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। ফ্ল্যাটে বিলাসবহুল আসবাবপত্রও জাল টাকায় কিনেছেন। এমনকি মাঝেমধ্যে ফ্ল্যাটের ভাড়া দেওয়ার সময়ও সুযোগ বুঝে দু-একটি জাল টাকার নোট বান্ডিলে দিয়ে দেন। একমাত্র সন্তানের জন্য কেনা সব দামি খেলনাও জাল টাকায় কিনেছেন। স্ত্রীর গহনা থেকে শুরু করে সংসারের সব কিছুই কামাল হোসেন জাল টাকায় কিনেছেন। হুমায়ুন কবির ও কামাল হোসেনের হাত ধরে জাল টাকা চলে যাচ্ছে বড় ব্যবসায়ীদের কাছেও। আর ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে জাল টাকা অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে ব্যাংকের ভল্টে ও সাধারণ মানুষসহ ব্যাংকের এটিএম বুথ পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের তৈরি এক লাখ টাকার জাল নোট প্রথম ধাপের ক্রেতা বা এজেন্টের কাছে বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায়। ক্রেতারা তা বিক্রি করছে ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। এরপর প্রতি লাখ জাল টাকা বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়। জাল টাকা যত হাতবদল হবে দাম তত বাড়বে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ১৯৭৪ সালের আইনে জাল টাকা বা জাল স্ট্যাম্পের সঙ্গে জড়িতদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান ছিল। এরপর ১৯৮৭ সালের ১৯ জানুয়ারি আইনটি সংশোধন করে জাল নোটের সঙ্গে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড অথবা ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। এরপরও বন্ধ হচ্ছে না জাল টাকার ব্যবসা।