Thursday, December 12Welcome khabarica24 Online

সিরাজগঞ্জে ট্রাকে পেট্রল বোমায় ২ ব্যবসায়ী নিহত

1_57293
সিরাজগঞ্জের হোড়গাঁতীতে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ সড়কে ট্রাকে অবরোধকারীদের পেট্রল বোমা নিক্ষেপের ঘটনায় প্রাণ হারালেন দুই ব্যবসায়ী। এরা হলেন- শিবগঞ্জের গণেশপুর গ্রামের আলু ব্যবসায়ী লুৎফর রহমানের ছেলে মিলন (২০) ও প্রতিবেশী আমজাদ হোসেনের ছেলে ইমরান হোসেন (১৮)। ট্রাকের চালক একই গ্রামের মৃত ওসমান আলীর ছেলে শাফায়াত আলী অগ্নিদগ্ধ হয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
এদিকে রাজধানীর শাহবাগে পেট্রল বোমা হামলায় দগ্ধ আরও দুজন বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা গেছেন। এরা হলেন- ফল ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়া ও বীমা কর্মকর্তা শাহীনা আক্তার রূপসা। সিরাজগঞ্জ ও উল্লাপাড়া প্রতিনিধি জানান, জেলা পুলিশ সুপার এসএম এমরান হোসেন ও নিহতদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ট্রাক বোঝাই আলু নিয়ে মঙ্গলবার মিলন ও ইমরান ঢাকা যাচ্ছিলেন। রাত ৮টার দিকে ট্রাকটি হোড়গাতীতে পৌঁছলে অবরোধকারীরা ট্রাকটি লক্ষ্য করে পেট্রল বোমা ছোড়ে। এতে মুহূর্তেই ট্রাকটিতে আগুন ধরে যায়। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন চালক। ফলে এটি রাস্তার ধারে উল্টে যায়। ট্রাকের কেবিনে থাকা ব্যবসায়ী মিলন পুড়ে মারা যান। ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে ও আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ইমরান। রাতেই মিলনের লাশ উদ্ধার হলেও ইমরানের জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বুধবার সকালে পুলিশ ট্রাকটি সরালে তার লাশ মিলে। এ ঘটনায় পুলিশ রাতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জড়িত সন্দেহে ১০ জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীকে আটক করে।
বগুড়া ব্যুরো জানায়, শজিমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন অগ্নিদগ্ধ ট্রাক চালক সাফায়াত আলী (৪৫)। ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর পুলিশ ও দমকল বাহিনীর সদস্যরা চালক শাফায়াতকে উদ্ধার করে সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাত ১১টার দিকে তাকে শজিমেক হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা আশংকাজনক; শরীরের ৫০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে। এখানে অবস্থার উন্নতি না হলে তাকে ঢাকায় পাঠানো হবে।
বুধবার সকালে হাসপাতালে গিয়ে স্বজনদের আহাজারি দেখা যায়। শাফায়াত অতিকষ্টে শুধু প্রশ্ন করেন তার কি অপরাধ? কি অপরাধে তাকে আগুনে পুড়তে হল? একই প্রশ্ন করছিলেন তার স্বজনরাও।
শিবগঞ্জ থানার ওসি ফজলুল করিম জানান, সিরাজগঞ্জে পেট্রল বোমার আগুনে পুড়ে নিহত সবজি ব্যবসায়ী মিলন ও এমরানের মৃতদেহ বুধবার বিকাল পর্যন্ত তাদের বাড়িতে পৌঁছেনি। দুই তরুণ ব্যবসায়ীর এ নির্মম মৃত্যুতে শুধু তাদের পরিবারে নয়; পুরো গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
স্ত্রীর মৃতদেহ সামনে নিয়ে নির্বাক হয়ে বসে আছেন ফখরুজ্জামান। বার্ন ইউনিটের নিচতলায় পুড়ে অঙ্গার হওয়া শাহীনা আক্তার রূপসাকে নিয়ে তখন স্বনজদের মাতম। এমন সময় ফখরুজ্জামানের মোবাইলে একটি কল পুরো পরিবেশকে আরও ভারি করে তোলে। গগনবিদারী চিৎকারে ফখরুজ্জামান অভিশাপ দিতে থাকেন এ দেশের রাজনীতিবিদদের। ফখরুজ্জামান বলতে থাকেন, ‘বাবা আমরা নোংরা পলিটিক্সের শিকার হয়েছি। এদেশের রাজনীতিবিদরা তোর মাকে মেরে ফেলেছে। আমি আর এদেশে থাকতে চাই না। তুই আমাকে নিয়ে যা।’ বিদেশে অবস্থানরত ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আসিফকে উদ্দেশ করে একথা বলতে বলতেই অচেতন হয়ে পড়েন ফখরুজ্জামান।বার্ন ইউনিটের কলাপসিবল গেটের ওপাশে তখন পড়ে আছে রাজনৈতিক সংহিসতার আরেক বলি ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়ার নিথর দেহ। ৩ জানুয়ারি বিরোধী জোটের অবরোধ চলাকালে পরীবাগে পেট্রল বোমায় দগ্ধ হন একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কর্মরত শাহীনা আক্তার আর ফল ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়া। নিহত দু’জনই গুলিস্তান-এয়ারপোর্ট রুটের বাসে ছিলেন। ৫ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মাত্র ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তাদের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ বাসচালক বাবুল মিয়া এখনও হাসপাতালে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন।বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায় হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ৬০ বছর বয়সী ফল ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়ার নিথর দেহ ঘিরে চলছিল তার স্বজনদের আহাজারি। ফরিদ মিয়ার ছেলে স্বপন তার মাকে বুকে চেপে ধরে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। স্বামীর মৃত্যুর খবরে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তার মা হালিমা বেগম।কান্নাজড়িত কণ্ঠে স্বপন বলছিলেন, ‘ডাক্তারকে বলেছিলাম যত টাকা লাগে চিকিৎসা করতে। প্রয়োজনে কিডনি বিক্রি করে চিকিৎসা করাবো, আমাদের কি দোষ।’ এমন সময় জ্ঞান ফিরে এলে হালিমা বেগম দু’হাত উঁচিয়ে বলতে থাকেন, ‘ইমুন রাজনীতি চাই না। এই রাজনীতি আমারে স্বামী ছাড়া করছে’। আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন বৃদ্ধা হালিমা বেগম। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের আইসিইউর সামনে এ সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।ফরিদ মিয়ার ছেলে স্বপনুর রহমান জানান, ঘটনার দিন ৩ জানুয়ারি সকালে ফল কিনতে পুরান ঢাকার বাদামতলী যাচ্ছিলেন তার বাবা। সে কারণে তিনি গুলিস্তানগামী একটি বাসে উঠেছিলেন। বাসটি রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে পৌঁছলে সেখানে আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবক বাসটি লক্ষ্য করে পেট্রল বোমা ছুড়ে মারে। এতে অগ্নিদগ্ধ হন ফরিদসহ তিনজন। স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ তাদের উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করে। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, ফরিদের শরীরের ৪৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। পুড়েছে তার শ্বাসনালীও। গত ৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অবশেষে হার মানলেন তিনি। রাজনীতির সহিংসতার বলি হয়ে ছেড়ে গেলেন পৃথিবী। ফরিদ মিয়ার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর বেলাবোতে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি ক্যান্টনমেন্টের মানিকদীতে থাকতেন।এর আগে একই ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ শাহীন আক্তার রূপসা বুধবার রাত পৌনে ২টার দিকে বার্ন ইউনিটে মারা যান। শাহীনা আক্তার বীমা কোম্পানি এলিকোতে চাকরি করতেন। ঘটনার দিন অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি গুলিস্তানগামী বাসে উঠেছিলেন। শাহীনা খুলনার টুথপাড়া জোড়াকল এলাকার বাসিন্দা। থাকতেন স্বামীর সঙ্গে এয়ারফোর্স স্টাফ কোয়ার্টারে। একমাত্র ছেলে আসিফ মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি এখন জাহাজে আছেন। তবে তার অবস্থান এখনও ঠিকমতো জানতে পারেননি তার স্বজনরা। তবে নিহতের এক আÍীয় জানালেন, স্যাটেলাইট ফোনে সোমবার আসিফ বলেছিলেন, তিনি কানাডার কাছাকাছি আছেন। কবে নাগাদ আসিফ দেশে ফিরতে পারবেন সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানাতে পারেননি। ৩ জানুয়ারির ওই আগুনে শরীরের ৬৪ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল ৪০ বছর বয়সী শাহীনার দেহের বিভিন্ন স্থান। দেহের বিভিন্ন স্থানে আট শতাংশে আগুনের ক্ষত নিয়ে যাত্রীবাহী বাসের চালক বাবুল মিয়া এখনও হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করছেন।হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত বিরোধী দলের ডাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ২২ জন। এছাড়া দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৪৫ নারী-পুরুষ, যাদের মধ্যে ৩৬ জন এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
উৎস- যুগান্তর

Leave a Reply