রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকালের গণসমাবেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বেশির ভাগ শরিক দলের নেতারা উপস্থিত থাকলেও জামায়াতে ইসলামীর কাউকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। সরকারবিরোধী আন্দোলনে এর আগে বিএনপির ডাকা সমাবেশ ও কর্মসূচির অগ্রভাগে জোরালোভাবে উপস্থিত থাকত জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা। নিজেদের দাবি লেখা ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে স্লোগানের রব তুলত তারা। কিন্তু গতকাল এর কিছুই ছিল না।
দুপুর সোয়া ২টায় শুরু হয়ে সন্ধ্যা পৌনে ৬টা পর্যন্ত চলে সমাবেশ। এতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যোগ দেয় বিনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য শোনার পাশাপাশি তাদের অনেকেই কেন্দ্রীয় ও ঢাকার নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মন্তব্য করে। তারা বলে, কেন্দ্রীয় ও ঢাকার নেতাদের কারণেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। অজ্ঞাত স্থান থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি বা ভিডিওবার্তা পাঠিয়ে আন্দোলন সফল করা যায় না।
গণসমাবেশে ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর কোনো নেতা বা কর্মীকে দেখা না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিএনপির এক নেতা বলেন, ১৫ জানুয়ারি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ১৮ দলের পক্ষে এই সমাবেশের ঘোষণা করেছিলেন। তবে গত রবিবার রাতে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান জানান, এটি বিএনপির সমাবেশ, ১৮ দলের নয়। তাই হয়তো জামায়াতের নেতারা আসেননি।
তবে সমাবেশের মঞ্চে ১৮ দলীয় জোটের অন্য প্রায় সব দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দেখা গেছে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, এনপিপির শেখ শওকত হোসেন নিলু, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামিক পার্টির অ্যাডভোকেট আবদুল মবিন, এনডিপির খন্দকার গোলাম মোর্তজা, ন্যাপের জেবেল রহমান গাণি প্রমুখ। তাঁদের অনেকে বক্তব্যও দিয়েছেন।জোটের আগের সব কর্মসূচিতে দেখা গেছে, মঞ্চে খালেদা জিয়ার ডান পাশে জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বসতেন। সে হিসেবে প্রথম আসনটি এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের জন্য, দ্বিতীয় আসনটি নির্ধারিত থাকত জামায়াতের শীর্ষ নেতার জন্য। বাঁ পাশে বসতেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির নেতারা। তবে গতকাল প্রথম আসনটিতে অলি আহমদ বসলেও পরের আসনটিতে বসেন জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমেদ।জোটের এক শীর্ষ নেতা বলেন, আজকের সমাবেশে ১৮ দলের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর জন্য মঞ্চে কোনো আসন রাখা হয়নি। ওই স্থানে বসেন কাজী জাফর আহমেদ। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেওয়া হয়েছে কি না আমি জানি না। তবে জামায়াতের আসনে জাতীয় পার্টির নেতাকে বসতে দেখি আমি অবাক হয়েছি।’তবে সমাবেশে থাকা ছাত্রদলের কয়েক নেতা বলেন, ‘জামায়াতের মহানগরীর কয়েকজন নেতা-কর্মী সমাবেশের উত্তর পাশে অবস্থান করছেন।’ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা বলেন, ‘জামায়াতের অল্প কিছু নেতা-কর্মী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। তবে ব্যানার, ফেস্টুন না থাকায় বা কোনো স্লোগান না দেওয়ায় তাদের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না।’জামায়াতের না থাকা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বিএনপির তৃণমূল নেতাদের মধ্যে। এদের অনেকেই মনে করে, বিএনপি যতই বলুক না কেন জামায়াতের সহিংতার দায় নেবে না, তা ঘুরেফিরে বিএনপির ওপরই বর্তাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলকর্মী সালেহ বলেন, ‘সাধারণ মানুষের মতো আমরাও মনে করি সম্প্রতি জামায়াতের কর্মসূচি অনেকটা নেতিবাচক ছিল। ফলে দলটিকে সন্ত্রাসী বলছে অনেকে। আর এর কিছুটা দায় বিএনপির ওপর চলে এসেছে।’ বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকার কারণেই জামায়াত এসব কর্মকাণ্ড চালাতে সাহস পেয়েছে বলে মনে করেন তিনি। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্রদল পরিচয়দানকারী একটি সংগঠনের এক নেতা বলেন, জামায়াত-শিবির বিএনপির সঙ্গে থাকায় আন্দোলনের শক্তি বেড়েছে। তবে জনপ্রিয়তা কমেছে।এদিকে সমাবেশে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, দোহারসহ কয়েকটি জেলা ও উপজেলা থেকে আসা নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৯ ডিসেম্বর দলীয় প্রধানের ডাকে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির দিনও তাঁরা ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা ওই দিন কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে তাদের ভাষায় ‘পালিয়ে ছিলেন’। আর এই কারণে পরবর্তীতে মাঠের কর্মীদের মনোবল চাঙা রাখা যায়নি। কেন্দ্রীয় নেতারা সাহস করে ওই দিন দিকনির্দেশনা দিলে আজ পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত বলে ঢাকার বাইরের নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস।
মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলা থেকে আসা যুবদলকর্মী কামরুল হাসান বলেন, ‘শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিদ্যুৎসহ অসংখ্য ব্যর্থতায় জর্জরিত এই সরকার। এর পরও বিএনপি সেগুলো কাজে লাগাতে পারেনি। আজ আওয়ামী লীগ যদি বিএনপির জায়গায় থাকত তবে কবেই সরকার পড়ে যেত।’ দোহার উপজেলা বিএনপির সদস্য নেসার আলী বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ মাত্র সাত দিনে সরকার ফেলে দিয়েছিল। আর আমরা দুই মাস যুদ্ধ করেও এই সরকারের কিছু করতে পারিনি শুধু ঢাকা নেতাদের ব্যর্থতার কারণে।’নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আরিফ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘জেলে যেতে যদি কেন্দ্রীয় নেতাদের ভয় থাকে, তাঁরা দায়িত্ব কেন ছেড়ে দেন না। পালিয়ে থেকে কী লাভ হলো। ২৯ ডিসেম্বর লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় ছিল। একটি বড় মিছিল হলে তাতে কয়জনকে গুলি করে মারত পুলিশ।’মুগদা থানা ছাত্রদল নেতা তানভীর বলেন, আন্দোলনের সময় নেতারা ‘অজ্ঞাত স্থান’ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি বা ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন। নেতারা মাঠে না এলে কর্মীরা মাঠে আসার সাহস কোথায় পাবে? আরেক কর্মী প্রশ্ন করেন, ‘কয়জন নেতা আন্দোলনের সময় খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন? শুধু টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে এসে আন্দোলনে থাকার অভিনয় করলে আন্দোলন সফল হবে কিভাবে?’
পল্টন থানার বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন কমিশনের আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে।’ ‘আন্দোলনে ব্যর্থ এবং লুকিয়ে থাকা নেতাদের’ বাদ দিয়ে সংগঠন গোছাতে পারলে আবারও বিএনপি ক্ষমতায় আসবে বলে বিশ্বাস করে তৃণমূল কর্মীরা।
উৎস- কালেরকন্ঠ