বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে যে কোন সময় গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তার রাজনৈতিক যোগাযোগ, তৎপরতা সার্বক্ষণিক গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে সরকার। আসন্ন সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে বিএনপি কঠোর অবস্থানে অটল থাকলে এবং বেগম খালেদা জিয়া নিজে সরাসরি রাজপথের আন্দোলনে শরিক হলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার কৌঁসুলি ভূমিকা নেবে। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে গ্রেপ্তার করা হবে তার জামিন বাতিল করার মাধ্যমে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম খালেদা জিয়া গত ছয় মাস ধরে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন না। হরতাল, শারীরিক অসুস্থতার কারণে হাজিরার টানা দশটি তারিখ তিনি অনুপস্থিত থেকেছেন। এই অজুহাতে আদালত তার জামিন বাতিল করতে পারে। বিষয়টি সরকার রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করবে। তবে তা নির্ভর করবে খালেদা জিয়ার কার্যক্রমের উপর। একটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে এ খবর জানা গেছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী তার গুলশানের বাড়িতে গত শুক্রবার থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত কার্যত অবরুদ্ধ ছিলেন। তার বাসার পানির সংযোগ কেটে দেয়া হয় নজিরবিহীনভাবে। বাড়ির গেটের দু’পাশের র্যাব, পুলিশের সশস্ত্র সদস্যবাহী ৭টি গাড়ি, সাদা পোশাকধারী পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি, মূল সড়কে পুলিশ ও সাদা পুলিশের ব্যাপক তৎপরতার মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে প্রয়োজনে গ্রেপ্তার করে অবরুদ্ধ রাখার সতর্ক বার্তাই পৌঁছে দেয়া হয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছড়ানোও এর উদ্দেশ্য। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, ১৮ দলেরই শরিক জামায়াত-শিবিরের দিক থেকে হামলার আশঙ্কা থেকে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। সরকার আশঙ্কা করছে, জামায়াত-শিবির একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য যে কোন পদক্ষেপ নিতে পারে। সরকার বেগম খালেদা জিয়ার গতিবিধি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তার বাসায় দলীয় এবং বাইরের কারা আসেন তা পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। কি কথা বলেন জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচন প্রতিহত করতে পরবর্তী আন্দোলনের কি নির্দেশনা দেন তা জানার চেষ্টা করছে সরকার। এখনই গ্রেপ্তার না করে সরকার দেখতে চাইছে খালেদা জিয়া কতটুকু যান। তার চলাফেরায় এখনই বাধা দেয়া হবে না। খালেদা জিয়ার কার্যক্রম রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলছে মনে করলে সরকার তাকে গ্রেপ্তার করতে দ্বিধা করবে না। গ্রেপ্তারের পর তাকে নিজবাড়িতে গৃহবন্দি অথবা কাশিমপুরেও নেয়া হতে পারে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে দারুণ দুর্ভাবনায় আছে সরকার। রাজপথের আন্দোলনের নেতৃত্বে তিনি সরাসরি অবতীর্ণ হতে পারেন। সেক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে কোনক্রমেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না, এমনি ভীতি কাজ করছে সরকারের মধ্যে। এই ভীতি থেকেই প্রশাসনিক ও আইনানুগভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রীর নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে সরকার। ইতিমধ্যে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও একাধিক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বিরোধী দলীয় নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধু একাডেমি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, হরতালে নৈরাজ্য অব্যাহত থাকলে খালেদা জিয়া সহ বিএনপির শীর্ষনেতাদেরও একই পরিণতি বরণ করতে হবে। ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, বিরোধী দলীয় নেতার নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব সরকারের। গত শনিবার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, হরতালে সহিংসতা বড় রাজনৈতিক সহিংসতা। এতে জ্বালাও-পোড়াও-এর মতো ঘটনা ঘটছে। মানুষ মরছে। এসব ঘটনার জন্য খালেদা ও বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতারা দায় এড়াতে পারেন না। এর দায়ভার বেগম জিয়াকেই নিতে হবে। এসময় তাকে বিরোধী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা আমরা ভেবে দেখবো। বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সরকারের একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। বিরোধী দলের প্রতিবাদ প্রতিরোধের মুখেও সরকার যে কোন পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্পন্ন করার সার্বিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি, এমনকি সরকারের ৫ বছরের সহযোগী এরশাদের জাতীয় পার্টিও যদি নির্বাচন বর্জন করে তাহলেও সাংবিধানিক শূন্যতা এড়ানোর নামে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার বদ্ধপরিকর। বিরোধী দল সরকারের একতরফা নির্বাচন বর্জন শুধু নয়, প্রতিহত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কর্মসূচি পালন করছে। অপরদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে চালানো হচ্ছে গ্রেপ্তার অভিযান। শীর্ষস্থানীয় বর্ষীয়ান নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এমকে আনোয়ার এবং ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যান্য নেতা, বিশেষ করে সংগঠক পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি হানা দেয়া হচ্ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে দেশব্যাপী পরিচালিত হবে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের আশঙ্কা এতেও তারা হয়রানির শিকার হতে পারেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে নির্বিঘ্নে নির্বাচন সম্পন্ন করতে চায় সরকার। ভোটের দিন ৫৫ শতাংশের বেশি ভোটার উপস্থিতি দেখানোর পরিকল্পনা তাদের। বিরোধীদলীয় কর্মীরা ব্যালট বাক্স, ব্যালট পেপারসহ ভোটের সরঞ্জামাদি পরিবহনে বড় রকমের বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিরোধী দল সপ্তাহে দু’দিন শুক্র, শনিবার বিরতি দিয়ে দেশজুড়ে টানা হরতাল দিতে পারে। ভোটের দু’দিন আগে থেকেই এবং ভোটের দিন ব্যাপক গোলযোগ, বোমাবাজির মাধ্যমে এক আতঙ্কময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে বিরোধী দল। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নেবে। এমনি সব আগাম তথ্য সংগ্রহ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার লোকজন। শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরসহ দেশব্যাপী ধরপাকড়, শীর্ষ নেতৃত্বকেও গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চায় সরকার। নিরাপত্তার নামে খালেদা জিয়াকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে: বিএনপি বিরোধী নেতা খালেদা জিয়াকে নিরাপত্তা দেয়ার নাম করে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। গতকাল বিকালে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ৮৪ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনের চিত্র তুলে ধরতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ এ অভিযোগ করেন। বিএনপি চেয়ারপারসনকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে নিরাপত্তা দেয়ার নামে মূলত নিরাপত্তাহীন করা হয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। এমনকি পানি ও খাবার পর্যন্ত সরবরাহ করতে দিচ্ছে না সরকার। তাঁর আত্মীয়স্বজনদেরও গেটে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ফিরে চলে যেতে হয়। এই ঘটনায় সারাদেশের মানুষ উদগ্রীব, উৎকণ্ঠিত, তাঁর বাসায় পানি বন্ধ করা হলো কেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসায় খাবার সরবরাহ বন্ধ করা হলো কেন- দেশের মানুষ তা জানতে চায়। তিনি বলেন, যে সরকার তাঁকে দীর্ঘদিনের বাস করা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, তাঁর সরকারি নিরাপত্তা কমিয়ে দিয়েছে, এসএসএফ এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহার করে চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এই বক্তব্য কুমিরের কান্না ছাড়া আর কিছুই নয়। এদের অন্য ইচ্ছা আছে। বিরোধী নেতাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। রিজভী আহমেদ বলেন, দেশ যখন একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য উন্মুখ তখন ক্ষমতাসীনরা দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের গোপন ইচ্ছা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এজন্য বিরোধী দলের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ (কঠোর ব্যবস্থা) শুরু করেছে। তারা দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পুলিশ নেতাদের বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে- এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, বিরোধী দলের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে সরকার তার স্বৈরাচারের মুখোশ উন্মেচন করেছে। ১৮ দলের নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি এখনও অব্যাহত রয়েছে। তল্লাশির সময় বাসায় থাকা শিশু, মহিলা ও বয়োবৃদ্ধদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দুর্ব্যবহার করছে। রিজভী আহমেদ বলেন, সরকার মুমূর্ষু গণতন্ত্রকে কফিনে পুরে ফেলার জন্য ধরপাকড় ও দমন-পীড়নের রাজনীতিকে আরও সংঘাতসঙ্কুল করে তুলেছে। স্বস্তি, শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিঘ্ন করে এক বিভীষিকাময় অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশ ও জনগণকে ঠেলে দিয়েছে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞার সঙ্গে সরকারের গণতন্ত্রের চরিত্র মেলে না। এখন গণতন্ত্র মানে আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র। সেখানে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে কিছু নেই। রিজভী আহমদে বলেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এর সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিনের বাসায় গতরাতে হানা দিয়েছে পুলিশ। তল্লাশির নামে বাহাউদ্দিন সাহেবকেই চাপে রাখতে এবং মানসিকভাবে তাকে বিপর্যস্ত করতেই তার বাসায় পুলিশ আক্রমণ চালিয়েছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. পিয়াস করিমের বাসায়ও ককটেল বিস্ফোরণ ও তার বাসার দারোয়ানকে গুলি করা হয়েছে। এটি একটি জঘন্য কাপুরুষোচিত কাজ। হরতাল চলাকালে সারা দেশে বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর অবিলম্বে আটক নেতাদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহরের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সারা দেশে জনগণ হরতাল পালন করেছে।মনোনয়ন বিক্রি আওয়ামী লীগের নীলনকশার অংশএর আগে দলীয় কার্যালয়ে রিজভী আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ নীলনকশার নির্বাচন করতে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করছে। এজন্য নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে চলমান সঙ্কটের সমাধান না করেই সরকার একতরফা নির্বাচনে দিকে এগোচ্ছে। রিজভী বলেন, বিরোধী দলের দাবি একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, যাতে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। এটা সমাধানের জন্য বিরোধীদলীয় নেতা সংলাপের আহ্বানও জানিয়েছেন। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। দেশের মানুষ বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে একদলীয় এই প্রহসনের নির্বাচন মেনে নেবে না বলেও মন্তব্য করেন বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এ নেতা।
উৎসঃ মানবজমিন