মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতরা স্মৃতিসৌধের অনুষ্ঠান বর্জন করলেন

32_f1

যা হয়নি কখনও, ভাবাও যায়নি কখনও- নজিরবিহীন সেই ঘটনাটিই ঘটেছে গতকাল। বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৯ দেশের রাষ্ট্রদূত। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সুস্পষ্ট ‘কূটনৈতিক বার্তা’ এ-ই প্রথম। রাষ্ট্রদূতদের বর্জনের ঘটনাটি অবশ্য আকস্মিক ছিল না, স্মৃতিসৌধে তাদের না যাওয়ার সিদ্ধান্ত তারা আগেই জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। বলা হয়েছিল, দুপুরে এক জরুরি সমন্বয় সভা রয়েছে তাদের। সে কারণেই তাদের পক্ষে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাওয়া সম্ভব নয়। সমন্বয় সভাটি ছিল বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর থেকে ওই পরিস্থিতি নিয়েই জরুরি ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট চাওয়ার প্রেক্ষিতে আয়োজন করা হয়েছিল সভাটি। এই রিপোর্টটি তারা বর্তমানে তৈরি করছেন। এটি তারা জমা দেবেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টে। এ জন্যই তাদের ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।রাষ্ট্রদূতদের সিদ্ধান্ত জানার পর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বার্তা পাঠান রাষ্ট্রদূতদের কাছে। পরে পাঠানো হয় আরেকটি বার্তা। তাতে বলা হয়- বাংলাদেশ চিন্তাই করতে পারছে না যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকতে পারে। বিজয় দিবস বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও গর্বের বিষয়। বাংলাদেশের বিজয় দিবসের মতো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বিদেশী কূটনীতিকদের যোগ না দেয়ার ঘটনা নজিরবিহীন- অতীতে কখনও ঘটেনি। এই অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়াটা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবমাননাকর।পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষভাবে যোগাযোগ করার পরও রাষ্ট্রদূতেরা যাননি স্মৃতিসৌধের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এ সম্পর্কে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সরকার বিষয়টিকে যেভাবে দেখছে সেভাবে দেখার কোন বিষয় নেই। সমন্বয় সভা তাদের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সভাটি রাষ্ট্রদূতরা সবাই মিলে করে থাকেন। সেজন্যই সভাটি করতে হয়েছে তাদের।’ এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়। সমন্বয় সভাটি হয়েছিল সকাল ১১টায়, এরপরও স্মৃতিসৌধে যেতে পারতেন তারা। কিন্তু যাননি কেন? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কি খুব কঠিন কিছু? সরকারও কি আঁচ করতে পারেনি কিছু? হয়তো করেছে বলেই গতকাল দিনভর দূতিয়ালিতে গলদঘর্ম ছিলেন তারা। রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন দফায় দফায়। শেষে রাষ্ট্রদূতেরা যোগ দিয়েছেন বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে।একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বর্জনের মধ্য দিয়ে কি ‘কূটনৈতিক বার্তা’ দিলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন- এ প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন সাবেক কূটনীতিক বিবিসি’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তার ধারণা ব্যক্ত করেছেন এভাবে- গতকালের অনুষ্ঠানে না যাওয়ার মধ্য দিয়ে সরকারের বেশ কিছু বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপছন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের সব কিছু সুনজরে দেখছেন না তারা। বর্তমান সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আসন্ন নির্বাচন নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে তাদের মধ্যে। এছাড়া তারা মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে। কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দেয়ার জন্য বিবৃতি দিয়েছিলেন তারা। এ বিষয়টিও সহজভাবে নিচ্ছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন।আসলে সামপ্রতিককালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের শীর্ষ নেতৃত্বের কোন আহ্বানেই সাড়া দেয়নি সরকার। সকলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচারসহ অনেক বিষয়েই তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি, ঘোষণা, বিধিবিধানে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিলেও তা উপেক্ষা করেছে সরকার। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেবল কূটনৈতিক নয়- ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, উন্নয়ন-সহায়তাসহ বহু ক্ষেত্রে তারা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বলাবাহুল্য তাদের সে অংশ এতখানি যে তা অন্য কারও দ্বারা পূরণ করা সম্ভব নয়। সরকার যদি ‘যিনিই টেলিফোন করুন শুনবো না’র মতো একগুঁয়ে নীতি নিয়ে চলতে থাকেন তা হলে বলতে হয়- আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি তারা নিয়েছেন। সে ঝুঁকির একটি গুরুতর বার্তা গতকাল এসেছে বলে আশঙ্কা জাগার সঙ্গত কারণ রয়েছে। উল্লেখ্য, ২৭ রাষ্ট্রের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, সুইডেন ও যুক্তরাজ্যের পূর্ণাঙ্গ মিশন এ আবাসিক রাষ্ট্রদূত রয়েছেন বাংলাদেশে। প্রতিটি দেশের বাংলাদেশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বহুমাত্রিক ভূমিকা রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে।

 

উৎস-মানবজমিন

Leave a Reply