শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

আর একটি মুক্তিযুদ্ধ চাই

॥ শেখ আতাউর রহমান ॥

আমরা তো এক লড়াকু জাতি। আমরা ইংরেজ বেনিয়াদের বিরম্নদ্ধে লড়াই করেছি স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে। আমরা পাকিস-ানি বেনিয়াদের বিরম্নদ্ধে লড়েছি মায়ের ভাষাকে মর্যাদা দিতে এবং এক দীর্ঘ সংগ্রাম আর রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চরম আত্মত্যাগ বিনিময়ে প্রিয় স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে বিদেশী বেনিয়াদের বিরুদ্ধে এতসব লড়াই করে টিকে থাকে যে জাতি, তাকে কিনা আজ দেশীয় বেনিয়াদের কাছে মার খেতে হচ্ছে নিরবে। আজ দেশী-বিদেশী চক্রানে- একে একে অবলুপ্ত হয়ে গেল আমাদের সকল অর্জন। তবু আমাদের ঘোর কাটছেনা।

আমাদের সংকট আজ বহুমুখী। কিন’ সব সংকটের মূলে রয়েছে মূল্যবোধের সংকট। যে নৈতিক মূল্যবোধ এবং আদর্শিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আমরা অতীতে লড়াই করেছিলাম নিরাপোষভাবে। আজ তা তিরোহীত। বিশ্বায়ন আর আকাশ সংস্কৃতির তোড়ে আমাদের নিজস্ব সব অর্জন, ঐতিহ্য, কৃষ্টি যেভাবে একে একে বিলীহ হয়ে যাচ্ছে, সেভাবেই আমাদের আদর্শবাদীতা এবং নৈতিকতাবোধও সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

যেকোন মহৎ সংগ্রামের মূলে অবশ্যই থাকে একটি নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি। মানবেতিহাসে যত বড় বড় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে , তার পেছনে এই নৈতিক ভিত্তি ও শক্তি ক্রিয়াশীল ছিল। এ যাবৎ পৃথিবীতে যত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিপ্লব, সংস্কার আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, যত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতবাদের উদ্ভব হয়েছে সবকিছুর মূলভিত্তি ছিল নৈতিকতা ও কল্যাণমূলক মূল্যবোধ। কিন’ সম্ভবতঃ আমরাই পৃথিবীতে একমাত্র জাতি যারা অতীতের সব অর্জনকে, মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে আবার উল্টো দিকে হাঁটছি। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে আমাদের অগ্রগতি যে কিছুই হয়নি তা কিন’ নয়। তবে নৈতিকতার দিক থেকে আমাদের পশ্চাৎগতি আমাদের সব অগ্রগতিকেই অর্থহীন, মূল্যহীন এবং প্রাণহীন করে দিয়েছে। ভোগ সর্বস্ব নব্য জীবনবোধ এবং বাজারী মূল্যবোধ কেড়ে নিয়েছে আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা চিরকালীন ঐতিহ্যকে এবং পরম আরাধ্য সুখ ও প্রশানি-কে। আমাদের সমাজ জীবনের সর্বত্র আজ হতাশা আর নৈরাজ্য বিরাজ করছে। আমরা কোথায় চলেছি তার হদিস কারো জানা নেই। এখানে বিবেক আজ নির্বাসিত। মানবতা ভূলুণ্ঠিত। সততা-নৈতিকতা-মূল্যবোধহীনতার সর্বগ্রাসী প্লাবনে মনুষ্যত্ব আজ হাবুডুবু খাচ্ছে। আজকের এ কঠিন ক্রানি-কালে প্রশ্ন জাগে আমরা কি জাতিয় জীবনে বিদ্যমান এ অবস’া ও ব্যবস’ার প্রতি আস’াশীল? অন্য কথায়, আমরা কি এর বিপরীত অবস’া অর্থাৎ সদাচার, সুশাসন ব্যবস’া প্রত্যাশা করি? উত্তরটা যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে তা অর্জনের জন্য আমাদের কী করা দরকার? আমরা জানি, যে কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা সি’র করতে হয়। ব্যক্তি জীবনে তো আমরা যে কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যথেষ্ট চিন-া-ভাবনা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করি এবং তা বাস-বায়নে কোমর বেঁধে কাজে লেগে যাই। তবেই না আমরা ব্যক্তি জীবনের যেকোন লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য পাই। একইভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও বাঞ্চিত লক্ষ্য তথা পূর্বোক্ত সুশাসন ব্যবস’া প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদেরকে একটি বাস-ব ভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে বৈকী। তবে সেটি বাস-বায়নের উপযোগী কর্মকৌশল ও কর্মীদল তৈরী করাটাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আমাদের সমাজের সকল ক্ষেত্রে সুশাসন ও সুনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য একটা বৈপ্লবিক কর্মসূচী বাস-বায়ন করতে হলে প্রয়োজন সকল স-রে, সর্বক্ষেত্রে নিবেদিত প্রাণ, দৃঢ়চেতা ও লড়াকু মানসিকতা সম্পন্ন একটি সচেতন জনগোষ্ঠী। যারা এগিয়ে যাবে যেকোন প্রকারের বাধাকে অগ্রাহ্য করে। প্রথমেই দূর্নীতির বিষবৃক্ষটাকে সমূলে উৎপাটিত করে একে একে সকল সামাজিক অনাচারের মূলে কুঠারাঘাত করে যাবে তারা। সেজন্য তাদের জানতে হবে- দূর্নীতির বীজ কোথায় অংকুরিত হয়, দূর্নীতির মূলোৎপাটনের জন্য কোথা হতে টান দিতে হবে। জানতে হবে কোন সুচতুর চক্রান-  আমাদের শিক্ষা ব্যবস’া হতে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষাকে মুছে দিল। বুঝতে হবে-শিক্ষাঙ্গনে সংঘাত কেন ঘটছে, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিতে কেন ছাত্র-যুবসমাজ সাচ্ছন্দ্যবোধ করে, মাদকের বিষ কারা ছড়াচ্ছে; কারা, কীভাবে আমাদের প্রবল দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত লড়াকু শক্তিটাকে বিভক্ত, বিধ্বস- ও নির্বীর্য্য করে দিচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান-রে।

অবশেষে বলতে হয়, চলমান বাস-বতায় সময়ের প্রয়োজন মেটাতে নতুন একটি সামাজিক শক্তিকে উঠে আসতে হবে। তীব্র আলোড়নে ঘুরে দাঁড়াতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে নব চেতনায়। লড়াকু বাঙ্গালীর আপাত তন্দ্রাচ্ছন্নতাকে দূরীভূত করতে তাই আবির্ভাব ঘটুক কোন এক মহানায়কের। যাঁর বাঁশির মোহনীয় যাদুতে সংঘটিত হবে আর একটি মুক্তিযুদ্ধ। তবে এ যুদ্ধ কোন সশস্ত্র যুদ্ধ নয় এবং এ মুক্তি কোন বন্ধন মুক্তিও নয়। এ মুক্তি হবে স্বার্থান্ধতা হতে মোহমুক্তি। কালজয়ী সে যুদ্ধ কোন বিদেশী বেনিয়ার বিরুদ্ধেও নয়। সে যুদ্ধ হবে অনৈতিকতার বিরুদ্ধে নৈতিকতার, ভোগবাদীতার বিরুদ্ধে আদর্শবাদীতার, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে নিয়ম-নিষ্ঠার, স্বার্থপরতার বিরম্নদ্ধে আত্মত্যাগের। এ যুদ্ধ হবে দেশী-বিদেশী বেনিয়াদের চক্রানে-র বিরুদ্ধে। যাতে আমরা আমাদের নৈতিকতার ভিত্তিটাকে পূণর্গঠিত করতে পারি একাত্তরের মতোই। অতঃপর আমরা বিগত চল্লিশ বছরে জমে থাকা অসমাপ্ত কাজগুলোকে, জনগণের অপূর্ণ স্বপ্ন-বাসনাগুলোকে সফল করে তুলব। তাই প্রতীক্ষায় রয়েছি, তেমন লাগসই কোন বৈপ্লবিক কর্মসূচীর জন্য। যার সফল বাস-বায়নের মধ্য দিয়ে নব প্রজন্মের লড়াকুরা একটি সমৃদ্ধ, সুখী-সুন্দর বাংলাদেশে পৌঁছে দেবে আমাদেরকে।

লেখক ঃ  শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ

Leave a Reply