শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

২০১১ সালে ঘটে যাওয়া মীরসরাই ট্রাজেডী অবলম্বনে রচিত গল্প ‌‌‌‍‍‌‌‌‌”স্বপ্নভঙ্গ”

ইমরান হোসেন সোহান,

অনার্স, গনিত বিভাগ। ফেনী সরকারী কলেজ।

বাবা, ভাত খেয়ে নাও, কথাটা শুনতেই মাথা উঠায় জমির শেখ। মিশুক নাকি রে… বলেই আবার নিজের কাজে মন দে সে। কিছুক্ষন পর আলের পানিতে হাত দুয়ে বলে, দে, ভাত। মিশুক নিজের হাতে থাকা বাসন টা বাবাকে এগিয়ে দেয়। বাবা ভাত খাচ্ছে আর ছেলে অপলক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা ছেলের এমন চাহনি সত্যিই দেখার মতো। কিরে, তুই খেয়েছিস? হুম বাবা, আমি খেয়েছি। তোর মা খেয়েছে? হুম মা ও খেয়েছে। তো স্কুলে যাবি না আজ? আজ বাবা আমাদের স্কুলের সাথে মীরসরাই পাইলট স্কুলের খেলা আছে। পরক্ষনেই মিশুক আবার বলে, বাবা তুমি মা কে বলো না আমিও খেলা দেখতে যাবো। আমাদের স্কুলের সবাই যাবে। আচ্ছা, আচ্ছা আমি তোর মাকে বলবো। বাবার মুখে কাথাটা শুনা মাত্রই মিশুক বাবার হাত থেকে বাসন টা নিয়েই ভোঁ দৌড় দিল সবুজ ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে। যেন হরিণ শাবক ছাড়া পেয়ে দুর-দুরান্তে থাকা তার মায়ের কাছে ছুটছে। জমির শেখ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিশুকের চলে যাওয়াতে।একমাত্র ছেলে তার মিশুক। তার স্বপ্ন ছেলেকে বড় ডাক্তার বানাবে। দশ গ্রামের সেবা করবে তার ছেলে। সবাই বলবে ঐ দেখ, জমির শেখের বেটা যায়।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে তার নেত্রজোড়া বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু পড়ছিল টেরই পায়নি। এবছর আগাম ফসল পাবে সে। নিজের ক্ষেতের বোনা ফসল আর হাতের বোনা ফসল নিয়েই তার যত স্বপ্ন। মিশুক, ঐ মিশুক খেলা দেখতে যাবি না? তাড়াতাড়ি আয়, সবাই এসে গেছে। কি হানিফ তুমিও খেলা দেখতে যাবে নাকি? ঘর থেকে বেরিয়ে বলল মিশুকের মা। জ্বী, চাচি আমিও যাচ্ছি। তাহলে তো ভালো। মিশুক কে তোমার সাথেই রাখবা। ঠিক আছে চাচি। মা যাচ্ছি বলেই মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে যায় মিশুক। মা বলল, সাবধানে যাস বাবা। আর তাড়াতাড়ি আসিস, অনেক দিন পর মাংস রান্না করছি, একসাথে খাবো। আচ্ছা বলেই হানিফ ভাইয়ের সাথে বেরিয়ে পড়ে। হানিফ আর মিশুক স্কুলে এসেই দেখে তারা আসার আগে অনেকে এসে হাজির। হেড় স্যারের নির্দেশে একটা পিকআপ ভাড়া করা হলো আর সবাই পিকআপে রওয়ানা হলো। খেলায় মিশুকদের স্কুল ২-০ গোলে জয়লাভ করে। সবাই খুশিতে আত্মহারা। ঢাকডোল পিটিয়ে তারা আবার পিকআপে করে রাওয়ানা হলো। গাড়িও আপন বেগে ছুটছে। এক সময় গাড়ি পাকা রাস্তা শেষ করে শাখা রাস্তায় প্রবেশ করছে।রাস্তার দু’পাশে রয়েছে অসংখ্য ডোবা। আর সে ডোবায় কুচুরিপানার দল তার ফুলের ডালা সাজিয়ে গেঁয়ো পথিকদের বরণ করে নিচ্ছে। হঠাৎ গাড়ী ব্রেক থ্রু করলো।কিছু বুঝে উঠার আগেই গাড়িটা পাশের ডোবায় উল্টে পড়ে গেলো। জমির চাচা, জমির চাচা, স্কুলের গাড়ি রাস্তার পাশের ড়োবায় পড়ে গেছে, তাড়াতাড়ি চলেন। হাতের কাজ দৌড় দে জমির শেখ। আর মিশুকের মা উদাসীনি পল্লিবালার মতো এদিক ঔদিক ছুটাছুটি করতেছে। ফায়ার সার্বিস আর স্থানীয় লোকদের সহয়তায় গাড়ী উল্টিয়ে লাশ উঠানোর কার্যক্রম চলতেছে । এক এক করে উঠানো হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের টাটকা লাশ। জমির শেখ এদিক ওদিক ছুটে মিশুকের লাশ খুজতেছে। কিছুক্ষন পর খবর এলো আরও দুটা উঠানো হলো। জমির শেখ দৌড়ে গিয়ে দেখে একটা তার ছেলে মিশুক আরেকটা হানিফের লাশ। অপলক দৃষ্টিতে নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল নিথর দেহ দুইটার দিকে। তখন বিকাল বেলা। ঠিক যেন শৈলচূড়ায় বরফের আলো ঠিকরে পড়েছে, কিন্তু বরফ এখনও গলেনি। সে কি নিবিড় পবিত্র মুখখানা। ঝর্ণার মৃদু চরণ প্রান্তরে নূপূরের ন্যায় অনুষ্টপ ছন্দে যে সময় কাটতো তা যেন আজ প্রকৃতির মতোই প্রশান্ত। বনহরীণির সেই দুরন্তপনা আজ নেই। হারিয়ে গেছে হেমন্তের ঝরা ফসলের মতো জমির শেখের ফসলটিও। জমির শেখ শোকের পাথর হয়ে তার নিজ হাতে বোনা ফসল মিশুকের লাশ কাধে নিয়ে যাচ্ছে সবুজ ফসলের মাঠ দিয়ে। তার স্বপ্নগুলো দোল খায় বাতাসের তালে।

#বি.দ্র: ২০১১ সালে ঘটে যাওয়া মীরসরাই ট্রাজেডী অবলম্বনে রচিত।