শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

কালিহাতীতে জড়িত ৭ পুলিশ প্রত্যাহার

61931_1_326710

টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহতের ঘটনায় জড়িত ৩ জন এসআইসহ ৭ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে পুলিশ সদর দফতর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩ দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে রিপোর্ট দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে শনিবার বিকালে নিহতদের লাশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহত প্রত্যেক পরিবারকে দেয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকা করে। ঢাকা ও টাঙ্গাইলে চিকিৎসাধীন আহতদের চিকিৎসা খরচও দেয়া হচ্ছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। নিহত পরিবারে চলছে এখন শোকের মাতম। কোনো কিছুতেই থামছে না স্বজনদের আহাজারি। এলাকায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। পুলিশ ও র‌্যাবের টহল জোরদার করা হয়েছে। শনিবার রাতে পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামির নামে ২টি মামলা করেছে।সরেজমিন শুক্রবারের ঘটনা সম্পর্কে জানতে গেলে কালিহাতী উপজেলার কামরতি গ্রামের ভ্যানচালক মিনহাজ উদ্দিন জানান, নিহত ফারুক বাজার করতে কালিহাতী সদরে আসেন। এ সময় সংঘর্ষের মুখে পড়েন। পরে পুলিশ খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি বলেন, ফারুক নির্দোষ ছিল। কালিহাতী সদরের নিহত শ্যামল সম্পর্কে রাজন নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, নিহত শ্যামল একজন শীল। মিছিল দেখার জন্য সে দোকান থেকে বের হয়েছিল। তখন তাকে লক্ষ্য করে অন্যায়ভাবে পুলিশ গুলি ছুড়লে শ্যামল গুরুতর আহত হন। প্রথমে তাকে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে ঢাকায় যাওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। নিহত শামীমের সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল। শুক্রবার ঘটনার সময় বাজারে গিয়েছিল সে। এ সময় হঠাৎ সে গুলির শব্ধ পায়। দৌড়ে পালানোর সময় পুলিশ তাকে গুলি করে। তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী হালিম মিয়া।নিহতদের বাড়িতে শোকের মাতম : পুলিশের গুলিতে নিহতদের বাড়িতে চলছে আহাজারি ও শোকের মাতম। কিছুতেই কান্না থামছে না নিহতের বাবা-মা, স্ত্রী, ভাই-বোন ও স্বজনদের। শনিবার বিকালে ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তরের পর নিজেদের বাড়িতে লাশ পৌঁছলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। সন্ধ্যায় লাশের দাফন পর্যন্ত এলাকার হাজার হাজার শোকাতুর মানুষ উপস্থিত থেকে চোখের পানি ফেলেন। তারা ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে বুলেট বিদ্ধ হয়ে ৩ জনই নিহত হয়েছে বলে ডা. মো. আশরাফ আলী জানিয়েছেন।বিচার চাই : নিহত ফারুক ভ্যানচালক, শ্যামল সেলুনের কর্মী, আর শামীম শ্রমিক। কুষ্টিয়া গ্রামের ফারুকের স্ত্রী আছিয়া বেগম বুকফাটা চিৎকার করে বলছিল, তার প্রতিবন্ধী ৮ বছরের ছেলে আসিফ ও ৩ বছরের মেয়ে ফাতেমার এখন কি হবে? কিভাবে চলবে তাদের সংসার। বৃদ্ধ বাবা-মাকেই এখন কে দেখবে। সালেঙ্গা গ্রামের শ্যামল স্থানীয় সেলুনের শ্রমিক। বাবা রবি দাস কাঠমিস্ত্রি, মা ভারতী রানী অসুস্থ। সংসারের উপার্জনক্ষম শ্যামলই ছিল একমাত্র ভরসা। তাকে হারিয়ে বাবা-মা চোখে-মুখে এখন অন্ধকার দেখছেন। শামীমের সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল ঈদের পরেই। মা আমেনা বেগম বলেন, জুমার নামাজ পড়ে সে আর বাড়ি ফিরেনি। সে তো মিছিল-মিটিংয়ে যায়নি। তাকে পুলিশ মারল কেন? আমি এর বিচার চাই।দোষী পুলিশ প্রত্যাহার ও তদন্ত কমিটি গঠন : শনিবার দুপুরে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার জিল্লার রহমান এবং অতিরিক্ত ডিআইজি মোহম্মদ আলী ঘটনাস্থল পরিদর্শনে কালিহাতী আসেন। তিনি জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন, ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে থানায় জরুরি সভায় বসে শুক্রবারের ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব পুলিশ সদস্যকে টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনে ক্লোজ করার সিদ্বান্ত দেন। একই সঙ্গে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। এদিকে ঘটনা তদন্তে ভারপ্রাপ্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমানের নির্দেশে অতিরিক্ত ডিআইজি আলমগীর আলমকে সভাপতি, ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আক্তারুজ্জামান ও টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসলাম খানকে সদস্য করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। আগামী তিন দিনের মধ্যে এই কমিটিকে রিপোর্ট দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ সময় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার জিল্লার রহমান বলেন, গুলি করার যৌক্তিকতা ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ডিআইজি নুরুজ্জামান বলেন, ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা না করে যারা গুলি ছুড়েছে এবং সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তা অবশ্যই তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দোষী কাউকেই রেহাই দেয়া হবে না। তারা ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জনগণের সহায়তা কামনা করেন। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসকও ঘটনা তদন্তে স্থানীয় প্রশাসনকে দিয়ে পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন জানান, এ ঘটনায় প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরপর তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। নিহত প্রত্যেকটি পরিবারের মাঝে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া নিহত ও ভিকটিমকে নিরাপত্তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের আর্থিক সহায়তার টাকা কালিহাতী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডুর নেতৃত্বে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনছার আলী বিকম, ঘাটাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম সামু, ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম লেবুসহ প্রমুখ উপস্থিত থেকে নিহত প্রতিটি পরিবারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।শুক্রবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে ঘাটাইল উপজেলার আঠারদানা ও হামিদপুর এলাকার কয়েক হাজার লোক বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কালিহাতী থানা ঘেরাওয়ের উদ্দেশে কলেজ গেট এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ বাধা দেয়। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশও লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই ৩ জন নিহত ও ৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়। আহত হন কালিহাতী থানার এসআই ফারুক, কনস্টেবল লিয়াকত ও কনস্টেবল হারুনসহ প্রায় অর্ধশত সাধারণ মানুষ।১৫ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) দুপুরে কালিহাতী পৌর এলাকার সাতুটিয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম রোমা তার স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ার জের ধরে ঘাটাইলের আঠারদানা গ্রামের এক শ্রমজীবী ছেলে ও তার মাকে কৌশলে ডেকে এনে বাড়ির উঠানে বিবস্ত্র করে অমানবিক নির্যাতন করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে পর পর দু’দিন এলাকাবাসী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে এবং সে বিক্ষোভ শুক্রবার সংঘর্ষে রূপ নেয়।নিন্দা ও প্রতিবাদ : কালিহাতীতে পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহতের ঘটনায় বিভিন্ন সংগঠন তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। পৃথক বিবৃতিতে ছাত্র ইউনিয়ন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল ও নারী মুক্তি কেন্দ্রের নেতারা বলেছেন, একটি প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের নির্বিচারে গুলি এবং মানুষ হত্যা অবশ্যই অমানবিক এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়, তখনই ঘটে এ ধরনের নিষ্ঠুর ঘটনা। সংশ্লিষ্টদের শুধু পুলিশ লাইনে ক্লোজ করলেই হবে না, তদন্তসাপেক্ষে বিচারও নিশ্চিত করতে হবে।

 

উৎস- যুগান্তর