মো: সাইফ উদ্দিন ফরহাদ ঃ “এমন দিনে তারে কি বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়” সকাল থেকেই বৃষ্টি নামছে অঝর ধারায়। অতিথি আগমন নিয়ে দ্বিধান্বিত আয়োজক কমিটি। সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে নির্ধারিত সময়ের একটু পরেই অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানস্থনে উপস্থিত। যথারীতি পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হলো “দ্বাদশ জাতীয় আবৃত্তি উৎসব-২০১৭ ও রজতজয়ন্তী” ।
১১ই আগস্ট রোজ শুক্রবার “দ্বাদশ জাতীয় আবৃত্তি উৎসব-২০১৭ ও রজতজয়ন্তী” উপলক্ষে নটর ডেম কলেজের অডিটোরিয়ামের মঞ্চে নটর ডেম আবৃত্তি দলের আমন্ত্রণে চট্টগ্রামের স্বনাম প্রসিদ্ধ সংগঠন নরেন আবৃত্তি একাডেমি তাদের অনবদ্য গল্প গাঁথার প্রযোজনাসমূহ মঞ্চায়ন শুরু করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ডা: মো: হাবিবে মিল্লাত মুন্না (এম.পি), বিশেষ অতিথি হয়ে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পি (এম.পি), সভাপতিত্ব করেন নটর ডেম আবৃত্তি দলের সম্মানিত মডারেটর মিসেস মারলিন ক্লারা পিনেরু এবং নরেন আবৃত্তি একাডেমির পরিচলক মিশফাক রাসেল ।
দ্বাদশ জাতীয় আবৃত্তি উৎসব-২০১৭ ও রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ব্যক্তি হিসেবে ড: ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যয় ও সংগঠন হিসেবে নরেন আবৃত্তি একাডেমিকে সম্মাননা পদক প্রদান করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি।
বেলা ৩.৪০টায় মা-বাব, শিক্ষাগুরু, শহীদগণ এবং বাইন দুয়ারীগনের বন্দনার মাধ্যমে গায়েন উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের আহ্বান জানিয়ে শুরু করেন কাব্যনাটক “অমাবস্যা”। অমাবস্যা যা একজন এসিডদগ্ধ নারীর করু আত্মকাহিনী। গায়েন তার কাব্যের গড়নে বর্ণনা করে যান আম্বিয়ার কথা। দরিদ্র ঘরের গরীব চাষার মেয়ে আম্বিয়া যার নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তার উপর নজর পড়ল গ্রামের মহাজনের ছেলে সেলিমের। যার ধন সম্পদ ও ক্ষমতার কারণে গ্রামের মানুষ কেউ শ্রদ্ধা করে কেউ ভয়ে মানে। সমাজের এই শ্রেণিবিভেদের কথা চিন্তা করে আম্বিয়া সেলিমকে মানা করে দিলেও প্রতিদিন রাস্তা ঘাটে তার পথের বাঁধা থামাতে পারে না। অবশেষে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় আম্বিয়া। সেলিম তাকে বিয়ে করার অঙ্গীকার দেয় এবং সব বাঁধা সত্ত্বেও তাদের ভালোবাসা গভীর হতে থাকে। এভাবে খুব সাধারণ এক ভালোবাসার গল্প গাঁথা হতে থাকে “অমাবস্যা” নাটকে। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা করেন প্রয়াত নাট্যজন শোভনময় ভট্টাচার্য। সমাজে বৈষম্য শোষণ শ্রেণিবিভেদ নিয়ে তৈরি এই নাটকে ভেসে আসে না শোনা শোষিতের চাপা কান্না ও পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের উপর অত্যাচার। সেলিম আম্বিয়ার সম্পর্কে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সেলিমের বাবা গ্রামের মহাজন। তিনি আম্বিয়ার বাবাকে হুমকিও দেন। সেলিমের সাহস বা ব্যাক্তিত্ব ছিল না তার বাবাকে রাজি করানোর ও আম্বিয়ার পাশে দাঁড়াবার। ওদিকে নিজের বাবার কথা ভেবে আম্বিয়া তার চাচাত ভাই সাইফুলের সাথে বিয়েতে রাজি হয়। কিন্তু সেলিমের অহংকার তাকে এই বিয়ে মেনে নিতে দেয় না। আম্বিয়াকে সে নিজের সম্পত্তি মনে করে আর কারো হতে না দেবার জন্য সে তার মুখ ঝলসে দেয় এসিডে। অর্থ-সম্পদের অন্ধ দম্ভে ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে এভাবে কত সেলিম মুখ ঢেকে দেয় কত আম্বিয়ার। আর এদের কান্না চাপা পড়ে যায় সুশীল সমাজের বন্দনায়। তাই জোট বেঁধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক হবার আহ্বান জানিয়ে শেষ হয় এই কাব্যনাটক।
কাব্যনাটক শেষ হতেই বাদ্যযন্ত্রের সুরের ছন্দে মঞ্চে প্রবেশ করেন নরেন আবৃত্তি একাডেমির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, চ্যানেল আই এর বিশিষ্ট্য সংবাদ পাঠিকা ফারজানা করিম এ্যানি। তিনি তার মধুর কন্ঠের স্বরচিত কবিতা আবৃত্তিতে মুগ্ধ করেন নটর ডেম আঙ্গিনায় উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের।
এরপর শুরু হয় কাব্যনাটক দেশর মানুষ, নদীর মানুষ। কাব্যনাটক দেশের মানুষ, নদীর মানুষ তোমার আমার হৃদয় রাণী সুজলা সুফলা এ বাংলার সচ্ছ প্রতিচ্ছবি। পাহাড়, নদী, ঝর্ণাধারার এই দেশে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের বসবাস। কথকের বর্ণনায় উঠে আসে গ্রাম বাংলার বর্ণিল চিত্রপট। গাঁয়ের তরুণী যখন তার সমবয়সি পুরুষকে দেখে লোক লজ্জার ভয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায়, ডাঙ্গায় ফেরা মাঝি তরুণীর পথ আগলে ধরে তার শৈশবের পরিচিত বলে মনের কথা ব্যক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তরুণী ঘরের বড়জন আর দুঃখে দরদি ঘটকের দোহায় দিয়ে প্রস্থান করে। তরুনীর উচ্ছলতায় প্রেমে লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ায় সখীরা হাসি তামাশা জুড়ে দেয়। এদিকে গায়ের মান্যজনদের মধ্যে চলে বিয়ের কথা। সেখানে শুরু নানান বাক বিতন্ডার। পাত্র পক্ষের ঘটক শিক্ষিত(পঞ্চম শ্রেণী পাশ) বরের জন্য যৌতুক হিসেবে ঘড়ি, সাইকেল চেয়ে বসে। নইলে তারা কন্যা না নেওয়ার হুমকি দেয়। পাত্রী পক্ষও কম যায়না। তারা নানা গুণে গুণবতি কন্যাকে এমন বরের হাতে তুলে দিতে নারাজ। মহাজন রীতিমতো বরকে আরও ভালো কোন ঘরে বিয়ে কারাবার হুমকি দিয়ে সভা ছেড়ে উঠে যেতে প্রস্তুত। অবশেষে গাঁয়ের মডলের মধ্যস্থতায় শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। তরুণ-তরুণী সোহগ ভারা অভীমানে বাঁধে সংসার, সাজায় স্বপ্ন। তরুণ তার সফল হাতে ফসল বুনে, আনে ধানের সওদা। হঠাৎ গাঁয়ের ভেতর ধ্বংস লীলা হয়ে হু হু করে ছুটে আসে বন্যা, এঁকে দেয় ধ্বংস নিশান। কিন্তু গাঁয়ের মানুষ ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে জানে না। গায়ের কৃষাণ, নায়ের মাঝি, কামার, কুমার সকল শ্রেণী পেশার মানুষ এক হয়ে হাজার হাতে ঠেকায় বন্যা। ভয়াল বন্যার ছোবল থেকে রক্ষা পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায় গাঁয়ের লোকজন। আবার নতুন উদ্যমে লেগে যায় কাজে। মাঝিরা নদীর বুকে ভাসায় তরী, আনে সওদা। বেদে-বেদেনীরা ছুটে গ্রাম থেকে গ্রামান্তর। কৃষাণ শক্ত হাতে চালায় লাঙ্গল, বুনে ফসল। সোনার ধানে ভারে উঠে মাঠ। সোনার ধানের মধুর গন্ধে মন হয়ে রয় উন্মনা। যখন ফসল কাঁটার সময় হয়, তখন বাংলার প্রতিটি ঘরে বিরাজ করে খুশির জোয়ার। এমনই প্রাণবন্ত গ্রাম বাংলার বর্ণিল গল্পে নির্মিত দেশের মানুষ, নদীর মানুষ। নাটকটি রচনা করেন আবু হেনা মোস্তফা আর নির্দেশনায় মিশফাক রাসেল।
হঠাৎ প্রজেক্টরের পর্দায় ভেসে আসে চিত্রয়িত কিছু সমধুর কণ্ঠের আবৃত্তি। কবি ময়ূখ চৌধুরীর রচিত কবিতাগুলোয় কন্ঠ দিয়েছেন মিশফাক রাসেল, সৈয়দ হোসেন বাবু, নাজিয়া পলিন, ইসমাইল চৌধুরী সোহান। পরিচালনায় ছিলেন আলাউদ্দিন ফরহাদ।
শ্রোতাদের বিমুগ্ধতার ঘোর না কাটতেই মঞ্চায়ন হয় অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ কাব্যপালা “কাঁদে বাংলা, কাঁদে মাটি”। পলাশপুর নামের ছোট্ট এক গাঁয়ের রঘুময়রার পঞ্চদশী কন্যা শ্রীলেখা। কুষ্টি মিলিয়ে শ্রীলেখার বিবাহের অনিশ্চয়তার কথা জানতে পেরে পিতা রঘুময়রা ও মা ননীবালার চিন্তার অন্ত নেই। অথচ কাজলকালো চোখের দুনিয়া সম্পর্কে উদাসীন শ্রীলেখা খুশি এই ভেবে যে তাকে তার বাবা-মাকে ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না। হঠাৎ এক গ্রীষ্মের দুপুরে সখীর সাথে চলার সময় অজানা এক বাঁশির সুরে ব্যাকুল হয়ে ওঠে শ্রীলেখার মন। সুর খুঁজতে গিয়ে বাঁশিওয়ালা আর শ্রীলেখার হয় মন বিনিময়। এভাবেই এগুতে থাকে কাব্যপালার কাহিনী। বিশ্বে ক্রমবর্ধমান হিংসা-বিদ্বেষ আর ভেদাভেদের ফলে মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম মানবতা আজ বিপর্যস্ত। এই পরম সত্য একটি সরল কাহিনীর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে পালাটিতে। এটি রচনা করেন মোকাদ্দেম মোরশেদ ও নির্দেশনায় ছিলেন মিশফাক রাসেল। কাহিনীচক্রে রঘুময়রা ও ননীবালা সানন্দে বাঁশিওয়ালার সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হলে বাঁধ সাধে পঞ্চায়েত প্রধান বড়মিয়া। কেননা বাঁশিওয়ালা জামাল যে মুসলমান। জাত-বেজাতের দোহাই দিয়ে বাঁশিওয়ালাকে গ্রামছাড়া ও শ্রীলেখার পরিবারকে একঘরে করা হয়। একরাতে ভালোবাসার টানে শ্রীলেখা আর বাঁশিওয়ালা পালিয়ে যেতে গেলে ধরা পড়ে বড়মিয়ার লোকের হাতে। এরপর স্পষ্ট হয়ে ওঠে বড়মিয়ার চরিত্র। শ্রীলেখার উপর তার কুনজর পড়ে। সে তাকে জোর করে ধর্মান্তরিত করে ছোট বিবির সম্মানের লোভ দেখায়। শ্রীলেখা রাজি না হলে বাঁশিওয়ালাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। জামালকে বাঁচাতে শ্রীলেখা বিয়েতে রাজি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাজের ঘৃণ্য রীতি, ধর্মে ভেদাভেদ, বর্ণে ও জাতিতে বৈষম্য এসব দ্বন্দের করাল আঘাতে শ্রীলেখা বিষপান করে। এভাবেই ধর্মকে পুঁজি করে পঞ্চায়েতের বর্বর নীতির ফলে একটি প্রেমের ও একাধিক জীবনের নির্মম পরিণতি ঘটে।
প্রযোজনা তিনটিতে অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন নরেন আবৃত্তি একাডেমির পরিচালক মিতাশা মাহরিন, দিদারুল আলম, সৈয়দ হোসেন বাবু, মিজানুর রহমান সজীব, রাবেয়া আক্তার স্বপ্না, মো: সাইফ উদ্দিন ফরহাদ, মো: আবদুল্লাহ আল মামুন, শেখ ফাহাদ, তাওহিদা জাহান ইউসরা, সেতু দাস, আজয় চক্রবর্তী, ইসমাইল চৌধুরী সোহান, আফরিদা জাইমা নীলান্তি, জান্নাতুল মাওয়া, শিমলা দাশগুপ্তা, মো: মহসিন, দীপ্ত সেন, সৈয়দা আনিকা ফেরদৌস, প্রযুক্তা বৈদ্য জয়া, মারিয়া খানম ইরিনা, তন্ময় দাস, অনিন্দা দাস প্রমূখ। পোশাক পরিকল্পনা ও কোরিওগ্রাফি করেন মিতাশা মাহরিন। আবহ সঙ্গীত পরিচালনা করেন দিদারুল আলম।
নটর ডেম আবৃত্তি দলকে তাদের রজতজয়ন্তীতে নরেন আবত্তি একাডেমি কর্তৃক শুভেচ্ছা স্মারক প্রদানের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
সর্বশেষে নটর ডেম আবৃত্তি দলের মডারেটর মিসেস মারলিন ক্লারা পিনেরু নরেন আবৃিত্ত একাডেমির পরিবেশনার ভুয়সি প্রশংসার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।