রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

হারানো সন্তানকে বুকে জড়িয়ে হাসলেন মা

3_140757

‘যমজ সন্তান জন্ম দিয়ে যে খুশি হয়েছিলাম, হারানো সন্তানকে ফিরে পেয়ে তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছি। পুরো পৃথিবী যেন হাতের মুঠোয় পেয়েছি। আনন্দে বুক ভরে যাচ্ছে। চোখ ভেসে যাচ্ছে। কি যে আনন্দ লাগছে, তা বলে বোঝাতে পারব না।’ কথাগুলো বলেই সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে ভরিয়ে দিলেন মা রুনা আক্তার। তার বাঁধনহারা আনন্দই বলে দিচ্ছিল হারিয়ে যাওয়া সন্তান বুকে নিয়ে যেন মাতৃত্বের পরিপূর্ণতা পেলেন তিনি। যমজ সন্তানের মা হয়েও শুধু একটি সন্তান নিয়ে গভীর বিষাদে মুষড়ে পড়া যে মা হাসপাতাল ছেড়ে গিয়েছিলেন তাকেই এবার দেখা গেল একেবারে ভিন্নœ চেহারায়। সব কষ্টের শেষে এখন তার মুখ ভরা হাসি। তার হাসি ছুঁয়ে গেল সবাইকে। এমনই এক প্রাণবন্ত, আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল বৃহস্পতিবার র‌্যাব সদর দফতরের কনফারেন্স রুমে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এক সপ্তাহ আগে চুরি হয়ে যায় রুনা আক্তার ও কাওসার হোসেন বাবু দম্পতির যমজ পুত্র সন্তানের মধ্যে একটি। বুধবার রাত ৩টার দিকে গাজীপুরের বোর্ড বাজারের উত্তর কলেমশ্বর থেকে চুরি যাওয়া শিশুটিকে উদ্ধার করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছে র‌্যাব।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানান, এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রাশেদা খানম পারভীন ও বেলি আক্তার রহিমা নামে দুই মহিলাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে রুনা ও কাওসার উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার কেন্দ্রে থাকা উদ্ধারকৃত শিশুর যমজ ভাইটিকেও সেখানে নিয়ে যান মা-বাবা।
সংবাদ সম্মেলনে কাওসার হোসেন প্রশাসন, র?্যাব, সাংবাদিকসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন, মিডিয়ায় খবরটা এত বেশি করে প্রচারের জন্যই তার ছেলেকে ফেরত পেয়েছেন। এ সময় তিনি বলেন, আমার দুই ছেলেকে সাংবাদিক করব। শুধু সাংবাদিক কেন, র‌্যাব তো আপনার ছেলেকে উদ্ধার করল- এমন প্রশ্নে হেসে ফেলে কাওসার বলেন, ‘যমজ শিশুর একজনকে সাংবাদিক ও আরেকজনকে র‌্যাব অফিসার বানাব।’ জন্মের পরপরই রুনা-কাওসার দম্পতি বড় ছেলের নাম রাখে ইয়াসিন হুসাইন আর ছোটটির নাম এখলাস হুসাইন। চুরি হয়ে যায় এখলাস।
র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, নবজাতক চুরি, চুরির পর বিক্রি অথবা মুক্তিপণ দাবি অপরাধীদের একটি পুরনো কৌশল। কিছু চক্র নবজাতক শিশুদের চুরি করে স্বল্প সময়ে মোটা অংকের অর্থ উপার্জনের জন্য সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে বিপদে ফেলে দেয়। তিনি জানান, ২১ আগস্ট সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাশেদা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রুনার সন্তানকে চুরি করে নিয়ে যায়। শিশুটি চুরি যাওয়ার পরই তাকে উদ্ধারে কাজ শুরু করে র‌্যাব। গাজীপুরের কলমেশ্বর এলাকায় রহিমার বাসা থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। রাশেদা শিশুটিকে চুরি করে রহিমান কাছে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। রাশেদা একজন ধাত্রী। গাজীপুরের ওই এলাকায় তার একটি ফার্মেসি রয়েছে। এ ব্যবসার আড়ালে শিশু চুরি করে বিক্রির কাজও করতেন তিনি। কেউ গর্ভপাত করাতে এলে সন্তান জীবিত থাকলেও মৃত বলে ঘোষণা করতেন। পরে ওই শিশু অন্য লোকের কাছে বিক্রি করতেন রাশেদা। এর সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তা।
র‌্যাব আরও জানায়, গাজীপুরের বাসিন্দা রহিমা নিঃসন্তান হওয়ায় পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে অবজ্ঞার পাত্র হয়ে ওঠেন। পরে রাশেদার পরামর্শে রহিমা তার স্বামীর সঙ্গে মা হওয়ার অভিনয় করেন। রহিমা তার স্বামীকে জানান, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে সন্তান প্রসব করাবেন। এজন্য একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। ৬-৭ মাসের মধ্যে রহিমাকে একটি শিশু এনে দেয়ার প্রতিশ্র“তি দেন রাশেদা। এরই মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রুনা ভর্তি হওয়ার পর রাশেদা সেখানে যান। মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তিনি রুনা ও তার মায়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং বিশ্বস্ততা কুড়িয়ে নেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ২১ আগস্ট রুনার যমজ সন্তানদের একজনকে চুরি করে পালিয়ে যান রাশেদা।
আটককৃত রাশেদা ও রহিমাকে বৃহস্পতিবার দুপুরে শাহবাগ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আজ তাদের আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড চাওয়া হতে পারে। শাহবাগ থানার এসআই ফেরদৌস বলেন, রাশেদা অসুস্থ থাকায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান রাশেদাকে তার কক্ষে নিয়ে গিয়ে চুরির বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
মা-বাবার অসচেতনতাকে দায়ী করল ঢামেক : এদিকে হাসপাতাল থেকে চুরি যাওয়া শিশু উদ্ধারের পর বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক সংবাদ সম্মেলন করেছেন। যমজ এক সন্তান চুরির ঘটনায় মা-বাবার অসচেতনাতাকে দায়ী করে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সন্তান প্রসবের পর মা-বাবার সচেতন হওয়া দরকার। তারা সচেতন হলে চুরির ঘটনা ঘটবে না। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন ৩০-৪০টি শিশু ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। হাসপাতালের জনবল কম থাকায় সবসময় শিশুদের প্রতি নজর রাখা কিছুটা কঠিন। এ কারণে মা-বাবাকে বা সন্তানের সঙ্গে যারা থাকবেন তাদের সচেতন হতে হবে। রুনা আক্তারের সন্তান যে মহিলা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন, ওই মহিলা তাদের আত্মীয় পরিচয়েই তাদের সঙ্গে ছিলেন। শিশু চুরির ঘটনায় হাসপাতালের কোনো কর্মচারী জড়িত নয় দাবি করে তিনি বলেন, এ ঘটনার পর হাসপাতালের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য গণমাধ্যম ও র‌্যাবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন পরিচালক।