সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

সার্ক কার্যকর করতে মতপার্থক্য দূর করুন

pic-22_155913
গত তিন দশকে প্রত্যাশা পূরণে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) পিছিয়ে থাকার কথা স্বীকার করলেন দক্ষিণ এশীয় নেতারা। গতকাল বুধবার সকালে আঠারোতম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে এক মঞ্চে উঠে তাঁরা দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে নিজেদের ভাবনা, প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, সার্ককে আরো কার্যকর ও গতিশীল করতে মতপার্থক্য দূর করা জরুরি। তাঁদের বক্তব্যে উঠে এসেছে সন্ত্রাসবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, অশিক্ষা মোকাবিলাসহ আঞ্চলিক সংযোগ (কানেকটিভিটি), বাণিজ্য বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক ইউনিয়ন গড়তে একসঙ্গে কাজ করার জোরালো আগ্রহ। একাধিক নেতার বক্তব্যে উঠে এসেছে এই অঞ্চলের দেশগুলোর বিষয়ে বাইরের দেশগুলোর হস্তক্ষেপ রোখার প্রত্যয়।
মোটরযান চলাচল, আঞ্চলিক রেল যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতাবিষয়ক প্রস্তাবিত তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া আগেই ভেস্তে গেছে। শেষ চেষ্টার পরও একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করা যায়নি। কোনো চুক্তি এবার হচ্ছে না- এমন আলামত আগেই মিলেছিল।
১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামেন আবদুল গাইয়ুমের সভাপতিত্বে গতকাল কাঠমাণ্ডুর সিটি হলে আঠারোতম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়। এরপর তিনি সার্কের সব সদস্য রাষ্ট্রের রাষ্ট্র/সরকারপ্রধানদের পক্ষে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালাতে ১৮তম শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালাকে আমন্ত্রণ জানান। মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানোর সময় মঙ্গলসংগীত পরিবেশন করা হয়। এরপর নেপালের প্রধানমন্ত্রী সম্মেলন মঞ্চের ডান পাশে মঙ্গলপ্রদীপ রেখে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন। ওই বক্তব্য অনুষ্ঠানের পর সার্কের রীতি অনুযায়ী সম্মেলনের স্বাগতিক দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুশীল কৈরালাকে সর্বসম্মতিক্রমে সংস্থার সভাপতি নির্বাচন করা হয়। নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা ধন্যবাদ জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। এরপর স্বাগতিক দেশ নেপালের পর থেকে সার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী একে একে বক্তব্য দেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ নওয়াজ শরিফ, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আশরাফ ঘানি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লিয়োনচেন শেরিং তোবগে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামেন আবদুল গাইয়ুম।
এরপর সার্ক মহাসচিব অর্জুন বাহাদুর থাপার বক্তব্যের পর আসে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদলের প্রধানদের বক্তৃতার পালা। মঞ্চের বাইরে নিজ নিজ আসনে বসে বক্তব্য দেন অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি বেট্র মেসন, চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী লিউ ঝেনমিন, ইরানের সড়ক ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী আব্বাস আখুনদি, দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিবিষয়ক উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী লি কিউং সু, মিয়ানমারের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থিন ও লিন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। এ ছাড়া জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার বক্তৃৃতা পড়েন কাঠমাণ্ডুতে জাপানের রাষ্ট্রদূত মাশাহি ওগাওয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রবিষয়ক হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ ফ্রেডেরিকা মেঘেরিনির বক্তৃতা পড়েন ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনজি টেমিক। ইইউয়ের প্রতিনিধি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মতপার্থক্য কমিয়ে আনার আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি নিশা দেশাই বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে এখন গণতন্ত্র আছে। আঞ্চলিক সংযোগের লক্ষ্যকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে।
কানেক্টিভিটিতে গুরুত্ব বাংলাদেশের : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যৌথ সমৃৃদ্ধির জন্য মতপার্থক্যকে দূরে সরিয়ে রেখে কানেক্টিভিটির ওপর জোর দিতে সার্কের সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কানেক্টিভিটি বিষয়ে আঞ্চলিক সমঝোতা বাস্তবায়নে সহযোগিতার জন্য আমি এই মঞ্চে বসা সার্কের সব নেতার প্রতি আহ্বান জানাই। আঞ্চলিক মোটরযান চুক্তি ও আঞ্চলিক রেলওয়ে চুক্তি দ্রুত স্বাক্ষর হবে বলে বাংলাদেশ আশা করছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, সার্ক এ অঞ্চলের জনগণের প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ করতে পারেনি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিতে সার্ক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। এগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য, তরুণদের কর্মসংস্থান, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবর্তন, আঞ্চলিক চুক্তি ও বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডা অন্যতম।
শেখ হাসিনা বলেন, সার্ক দেশগুলোর দ্রুত আন্তঅঞ্চল বাণিজ্যের ওপর জোর দেওয়া উচিত। দক্ষিণ এশীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) কার্যকর বাস্তবায়নও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘অশুল্ক ও আধাশুল্ক বাধাগুলো দূর করার ওপরও আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের জনগণ কার্যকর জোরালো উদ্যোগ দেখতে চায়। প্রক্রিয়ার চেয়ে ফলের দিকেই তাদের আগ্রহ বেশি।’
শেখ হাসিনা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের শান্তি, সমৃদ্ধি ও মঙ্গলের জন্য অংশীদারি গড়ার লক্ষ্যে তিন দশক আগে সার্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘বিগত দিনগুলো দেখলে যে কারো মনে হবে যে আমাদের প্রত্যাশা ও সম্ভাবনার তুলনায় অর্জন অনেক কম।’ সম্মিলিত রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও লক্ষ্য সার্কের উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্য এই অঞ্চলের অভিন্ন শত্রু। এটি আঞ্চলিক শান্তি ও উন্নয়নেও প্রধান বাধা।
দারিদ্র্য বিমোচন এবং জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং কৃষিতে পানি ব্যবহারের দক্ষতা উন্নয়নে সহযোগিতার ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া তিনি সার্ক খাদ্যব্যাংক ও সার্ক বীজব্যাংক সফলভাবে পরিচালনার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দ্রুতগতিতে উন্নয়নের জন্য সার্ক দেশগুলোকে অবশ্যই সব পর্যায়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সফল প্রয়োগে সম্মিলিত প্রয়াস জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, সার্ক দেশগুলোতে দুর্যোগের মাত্রা ও ভয়াবহতা বাড়ছে। উন্নয়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি এতই প্রকট যে ২০৫০ সালের মধ্যে এ দেশের তিন কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়াসহ আমাদের বার্ষিক জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সার্ক দেশগুলোর আন্তসীমান্ত উদ্যোগের মাধ্যমে আঞ্চলিক চুক্তি ও পরিকল্পনার ফলাফলভিত্তিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা উচিত।
বিদ্যুৎ সহযোগিতা বিষয়ে সার্কের কাঠামো চুক্তি স্বাক্ষরের অগ্রগতির প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎ এমন একটি খাত যেখানে এ অঞ্চলের সব দেশের আঞ্চলিক জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর অনেক সুযোগ আছে। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন, দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার, সংরক্ষণের মতো বিষয় এখানে আছে, যেখানে আমরা লাভজনকভাবে কাজ করতে পারি। এ কারণে আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগের মাধ্যমে সমন্বিত উপায়ে আমাদের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন প্রয়োজন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডার কারণে সার্ক দেশগুলোকে তাদের চতুর্থ সীমান্ত- ভারত মহাসাগরের দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘সম্মিলিতভাবে প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সমুদ্রসম্পদ আহরণের অনেক সুবিধা আছে। সার্ক অঞ্চলের টেকসই উন্নয়নের জন্য সাগর অর্থনীতিভিত্তিক সমুদ্রসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সপ্তম ও শেষ ভাবনায় বলেন, দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সার্বিকভাবে শান্তি, অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সার্কের বিভিন্ন অঞ্চল ও সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ভৌত সংযোগ (ফিজিক্যাল কানেক্টিভিটি) প্রয়োজন।
সার্কের ব্যর্থতার কথা বললেন মোদি : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘গত তিন দশকে সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সার্ক অনেক সাফল্য পেয়েছে। এর পরও সার্কের প্রসঙ্গ এলে আমরা সাধারণত অন্যের প্রতি দোষারোপ আর সংশয়- এ দুটি প্রতিক্রিয়াই লক্ষ করি। দুঃখজনক হচ্ছে, আশাবাদী তরুণ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি অঞ্চলেই এমন প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে।’
বৈশ্বিক বাণিজ্যের মাত্র ১ শতাংশেরও কম বাণিজ্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বিনিময় হওয়া আর দক্ষিণ এশীয় মুক্তবাণিজ্য এলাকার অধীনে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ১০ শতাংশের কম বাণিজ্য হওয়া নিয়ে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন।
নরেন্দ্র মোদি বলেন, ধীরে ধীরে হলেও সার্কভুক্ত দেশগুলো একীভূত হচ্ছে। রেল, সড়ক, বিদ্যুৎ আর ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিবিড় হচ্ছে। ভারত ও নেপাল জ্বালানি সহযোগিতার নতুন যুগে প্রবেশ করছে। বাস ও ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, জনগণের প্রত্যাশা আর সদস্য দেশগুলোর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সার্ক ব্যর্থ হয়েছে।
অবকাঠামোগত সমস্যাকে এ অঞ্চলের প্রধান সমস্যা হিসেবে অভিহিত করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘এ অঞ্চলে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বাড়াতে অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ভারতে একটি বিশেষায়িত ব্যবস্থা চালু করতে চাই। আমরা ভারতে ব্যবসাপ্রক্রিয়া নমনীয় করার কথা বলছি। এ প্রক্রিয়া এ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত করা যায়। আসুন আমরা সবাই মিলে প্রক্রিয়াগুলো নমনীয় করি। ভারত সার্কভুক্ত দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের জন্য তিন থেকে পাঁচ বছরের ভিসা দেবে। আসুন, সার্ক বিজনেস ট্রাভেলার কার্ড চালু করে এ প্রক্রিয়া আরো সহজ করি।’ তিনি জ্বালানিকে ‘পণ্য’ বিবেচনা করে এতে বিনিয়োগ আর এ নিয়ে বাণিজ্যের কথা বলেন। এ প্রক্রিয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দেশের সমর্থনের কথা উল্লেখ করেন।
নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘সাধারণ জনগণের মেলবন্ধন করতে পারলেই আমাদের সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। তাই সড়ক আর রেলপথে যোগাযোগ ও সেবা প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি।’ তিনি জানান, এ অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য ২০১৬ সালের সার্ক দিবসের দিন সার্ক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করছে ভারত। এটি শিক্ষা, দুর্যোগের পূর্বাভাস ও যোগাযোগসহ নানা ক্ষেত্রে সদস্য দেশগুলোর জন্য সহায়ক হবে।
নরেন্দ্র মোদি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধির জন্য এ অঞ্চলকে নিরাপদ রাখাটা জরুরি। আসুন, সন্ত্রাসবাদ ও আন্তসীমান্ত অপরাধ দমনে আমাদের অঙ্গীকার পূরণে কাজ করি।’ তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা, জনগণের যোগাযোগ এবং নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ- এ পাঁচটি বিষয়ের ওপর ভারতের পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা সবাই আমাদের গন্তব্যের পথ ঠিক করতে পারি। কিন্তু আমরা যখন একসঙ্গে একই গতিতে চলব তখন পথচলাটা সহজ হয়ে যায়, যাত্রা দ্রুততর আর গন্তব্যটা অনেক কাছে হয়ে যায়।’
বিকল্প জ্বালানি খোঁজার তাগিদ নওয়াজের : পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সস্তায় জ্বালানি প্রাপ্যতার বিষয়টি নির্ভর করে। তাই এ অঞ্চলে বিকল্প জ্বালানির উৎসের প্রাপ্যতার বিষয়টিতে সম্মিলিত উপায়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত। পাশাপাশি ত্রিদেশীয় তেল ও গ্যাস পাইপলাইন চালুর বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তিনি যোগাযোগ নেটওয়ার্ক জোরদার আর ভিসাপ্রক্রিয়া সহজ করার ওপর তাগিদ দেন। নওয়াজ শরিফের মতে, সার্কের অঙ্গীকার আর বাস্তবতার ব্যবধানটা কমানো উচিত। এ অঞ্চলের জনগণের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে নিজেদের মতপার্থক্য ভুলে একসঙ্গে কাজ করা উচিত।
বাইরের হুমকি মোকাবিলার আহ্বান রাজাপাকসের : শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে বলেন, ‘সার্কের চর্চা হলো অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয়ে নাক না গলানো। আমাদের অবশ্যই সম্মিলিতভাবে বাইরের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে হবে। সার্কের আদর্শকে ধারণ করে সদস্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে বাইরের হুমকি সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে আমরা এ অঞ্চলের কয়েকটি দেশে মানবাধিকারের নামে বাইরের দেশগুলোর চাপানো রাজনৈতিক এজেন্ডা দেখছি। মানবাধিকারকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত।’ সন্ত্রাসবাদ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবেও বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি হয়ে আছে বলেও তিনি জানান।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট বলেন, বৃহৎ পরিসরে আঞ্চলিক সংহতির জন্য সার্কের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। সাফটার পূর্ণ বাস্তবায়নে শ্রীলঙ্কার সমর্থন অব্যাহত থাকবে। বাণিজ্য ও সেবা কেবল দৃশ্যমান হওয়াই নয়, উন্নয়ন প্রক্রিয়ারও অংশ হওয়া উচিত।
২০৩০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা ও সাফটা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেরই এ প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে থাকা উচিত নয়। তিনি বলেন, ‘জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের অবশ্যই জ্বালানি উৎপাদনের বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে।’
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার তিন দশক পর সার্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে পৌঁছেছে। লক্ষ্য পূরণে গতানুগতিক উদ্যোগের বদলে এখন ফলভিত্তিক উদ্ভাবনী উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এটি সরাসরি আমাদের জনগণের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে।’ তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলে পর্যাপ্ত মূল্যবান ভূখণ্ড ও সাগরভিত্তিক সম্পদ, তরুণ ও দক্ষ মানবসম্পদ আছে। এসব দক্ষতাকে আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে কাজে লাগাতে হবে।’
সম্ভাবনা বাস্তবায়নে সম্মিলিত প্রয়াস চান শেরিং : ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বলেন, সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ, মানব ও মাদক পাচারের মতো অভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে। এ ছাড়া একইভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও দারিদ্র্যের মতো সবার অভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা এবং আন্তঅঞ্চল বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে সমৃদ্ধ অঞ্চল গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ সব সীমান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়া সম্ভাবনার অঞ্চল। কিন্তু এ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করা প্রয়োজন।’
শেরিং আরো বলেন, মোটরযান চলাচল, রেল যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি তিনটি স্বাক্ষরিত হলে সেগুলো আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে তিনি সার্ক নেতাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা কাজে লাগানোর আহ্বান জানান।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় অভিন্ন অর্থনৈতিক ইউনিয়ন চালু করার লক্ষ্যে সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথে যোগাযোগ ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে পণ্য, সেবা, বিনিয়োগ ও জনগণের চলাচল বাড়াতে হবে।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম বলেন, সার্কের লক্ষ্য ও অগ্রাধিকারগুলো পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, সার্ককে অবশ্যই বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উচিত। কোনোভাবেই সার্ককে পিছিয়ে থাকা চলবে না।
গাইয়ুম আরো বলেন, ‘বাণিজ্য ছাড়া আমাদের জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন হবে না।’ তিনি সম্মিলিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার আহ্বান জানান।
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি বলেন, তিনি তাঁর দেশের মাটিকে কারো ছায়াযুদ্ধের কাজে ব্যবহার হতে দেবেন না।
গতকাল সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে নেতারা কাঠমাণ্ডুর সোয়ালটি হোটেলে ফিরে যান। বিকেলে তাঁরা অন্য নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন এবং রাতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দেন।
সার্ক নেতারা আজ বৃহস্পতিবার সকালে যাবেন কাঠমাণ্ডুর অদূরে ধুলিখেল রিসোর্টে। সেখানেই তাঁদের ‘রিট্রিট সেশন’ অনুষ্ঠিত হবে। সার্ক নেতারা সেখানে নিজেদের মধ্যে আলোচনার পর বিকেলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। সেখানেই কাঠমাণ্ডু ঘোষণার মধ্য দিয়ে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হবে।