সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ১২৭ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ

5_125910

ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ১২৭ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই মুহূর্তে ১৬টি দুর্নীতি মামলার আসামি তিনি। এসব মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে আব্বাস রিট করলেও উচ্চ আদালত তা খারিজ করে দেন। কিন্তু মির্জা আব্বাস ছাড়া অন্যান্য কয়েকজন আসামির পক্ষে স্থগিতাদেশ থাকায় মামলাগুলোর বিচার কাজ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, স্থগিতাদেশ ভ্যাকেট করাতে (প্রত্যাহার) তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঢাকার দুটি বিশেষ জজ আদালতে আব্বাসের বিরুদ্ধে বিচারাধীন দুর্নীতি মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে উল্লেখিত সব তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্নীতির মামলা ছাড়াও আব্বাসের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু এই মামলাগুলোর তদন্ত শেষে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়ায় আব্বাস মামলা থেকে অব্যাহতি পান। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ কোনো বিরোধিতা না করার কারণে দুই বছর আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আরিফ মোর্শেদ খান আজিজ হত্যা মামলায় পুলিশের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে আদালত। এমনকি আব্বাসের বিরুদ্ধে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তাও জানেন না ঢাকা মহানগরের প্রধান আইন কর্মকর্তা (পিপি) আবদুল্লাহ আবু। জানতে চাইলে পিপি আবদুল্লাহ আবু সোমবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘আব্বাসের বিরুদ্ধে হত্যা মামলায় পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিল কিনা তা আমার জানা নেই। আব্বাসের বিরুদ্ধে কয়টি মামলা বিচারাধীন তা বলতে পারব না। খতিয়ে দেখব।’এছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের আরও ২০টি মামলা বিচারাধীন। দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে আব্বাসের বিরুদ্ধে ১৬টি দুর্নীতিসহ ৩৬টি মামলার বিচারকাজ চলছে কচ্ছপ গতিতে। জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মোঃ বদিউজ্জামান সোমবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘আব্বাসের বিরুদ্ধে ১২৭ কোটি টাকার দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাগুলোর বিচার কাজ চলবে বলে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন। কিন্তু এ মামলায় কয়েকজনের পক্ষে স্থগিতাদেশ থাকার কারণে আব্বাসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার বিচার কাজ বন্ধ আছে। অপর যাদের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ রয়েছে, তা প্রত্যাহারের জন্য আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি। কিন্তু বাস্তবতা হল, মির্জা আব্বাসদের পক্ষে দেশের বড় বড় আইনজীবী লড়েন, বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত। আমরা চাই, দুর্নীতির এসব বড় বড় মামলা দ্রুত শেষ হোক। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’অনুসন্ধানে জানা গেছে, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ঢাকার বিশেষ জজ-৩ আদালতে দুর্নীতির ১৫টি মামলা বিচারাধীন। এছাড়া ঢাকার বিশেষ জজ-৪ আদালতে আরও একটি দুর্নীতির মামলা বিচারাধীন। ঢাকার বিশেষ জজ-৩ আদালতে বিচারাধীন ১৫টি মামলায় বিনা দরপত্রে ১৮টি সরকারি বাড়ি বিক্রি সংক্রান্ত ১২৭ কোটি ৬৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৯ টাকা দুর্নীতির অভিযোগে আসামি মির্জা আব্বাসসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন এ আদালতের তৎকালীন বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন। অভিযোগ গঠনের আদেশে উল্লেখ করা হয়, ‘পরিত্যক্ত বাড়ি নম্বর এনডব্লিউ (আই)-৬, রোড নম্বর-৫৩, গুলশান, ঢাকার নিলাম দরপত্র আহ্বান করা হয়। বাড়ি নম্বর কে-৬, সড়ক নম্বর-৮৯, গুলশান, বাড়ি নম্বর সিএনজি-১৬,সড়ক-১১৩, গুলশান, বাড়ি নম্বর বি-৫, সড়ক নম্বর-১১৩, গুলশান, বাড়ি নম্বর-১২০, সড়ক-২, পুরাতন ধানমণ্ডি, বাড়ি নম্বর-১৩৯, সড়ক নম্বর-২, ধানমণ্ডি, বাড়ি নম্বর-৫৪০/এ (পুরাতন), সড়ক নম্বর-১২, ধানমণ্ডি, বাড়ি নম্বর-৫৪০/বি (পুরাতন), সড়ক নম্বর-১২ (পুরাতন), বাড়ি নম্বর-৭২৩/এ (পুরাতন), সড়ক নম্বর-১৪ (পুরাতন), বাড়ী নম্বর-৭২৩/বি, সড়ক নম্বর-১৪ ধানমণ্ডি, ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ১৭ নম্বর ও ১৮ নম্বর কলেজ স্ট্রিট, বাড়ি নম্বর-৭/১, নওরতন কলোনি, শান্তিনগরসহ সর্বমোট ১৮টি পরিত্যক্ত বাড়ি রাজউক কর্তৃক সাজানো দরপত্রে কারচুপি ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ পছন্দের ব্যক্তিদের বাড়িগুলো পাইয়ে দিয়ে প্রকারান্তরে নিজে লাভবান হয়ে সরকারের ১২৭ কোটি ৬৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৯ টাকার অর্থের ক্ষতি সাধন করেন। সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ‘দ্য বাংলাদেশ অ্যাবানডন্ড প্রপার্টি (কন্ট্রোল, ম্যানেজমেন্ট ও ডিসপোজাল) অর্ডার, ১৯৭২ অনুযায়ী উল্লিখিত ১৮টি সরকারি বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা না করে লাভবান ও অন্যান্য প্রভাবশালীদের লাভবান করার জন্য গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলীদের দর বেশি হওয়া সত্ত্বেও তা আমলে না নিয়ে রাজউক কর্তৃক সাজানো কম মূল্যের দরপত্রের মাধমে মূল্যায়ন না করে বিক্রির অনুমোদন করেন। আসামি মির্জা আব্বাসসহ অপর আসামিরা দণ্ডবিধির ৪০৯, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারাসহ দণ্ডবিধির ১০৯ ধারার অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। উল্লিখিত মামলাটির বাদী দুদকের সহকারী পরিচালক মোঃ শফিউল আলম আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ মামলার কার্যক্রম বন্ধ করতে উচ্চ আদালতে রিট মামলা দায়ের করেন আব্বাস। উচ্চ আদালত ২০১০ সালে তার আবেদন খাজির করে দেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুর্নীতির এ মামলা পরিচালনাকারী দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম যুগান্তরকে বলেন, ‘১৮টি পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দেয়াসংক্রান্ত ১২৭ কোটি টাকার দুর্নীতির ১৫টি মামলা এ আদালতে বিচারাধীন। প্রত্যেকটি মামলার আসামি মির্জা আব্বাস। মামলার কার্যক্রম বন্ধে আব্বাসের আবেদন উচ্চ আদালত খারিজ করে দেন।’আরও জানা গেছে, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ঢাকার বিশেষ জজ-৪ আদালতে আরেকটি দুর্নীতির মামলা বিচারাধীন। মামলা নম্বর হল- বিশেষ মামলা ৩/২০০৮। এ আদালতের তৎকালীন বিচারক শামসুননাহার বেগম মির্জা আব্বাসসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠনের আদেশে উল্লেখ করা হয়, ‘মির্জা আব্বাস গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকাকালীন একজন গণকর্মচারী হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ লাভবান হয়ে এবং আপনার দলীয় একজন সংসদ আলী আজগর লবীর মালিকানাধীন প্যাসিফিক কেমিক্যালস লিমিটেডের মাধ্যমে তাকে আর্থিকভাবে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় নবসৃষ্ট শিল্প প্লট বাবদ আবেদনপত্র বিনিয়োগ বোর্ডের সুপারিশ করেন। এমনকি আপনি পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদির অভাবে আবেদনটি অসম্পন্ন থাকা সত্ত্বেও শিল্প প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত নিয়মনীতি লংঘন করে ২০০৬ সালের ১৯ অক্টোবর ১৯.৪৪ কাঠার পরিবর্তে ২০.৯৬ কাঠা জমির দখল হস্তান্তর ও পরবর্তী সময়ে লিজ দলিলের রেজিস্ট্রি ব্যবস্থা করেন। এ অনিয়ম করে আপনি মির্জা আব্বাস ১৯৪৭ সারে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) এবং দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা লংঘন করেছেন। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ বর্তমানে মামলাটি উচ্চ আদালতের আদেশে এর কার্যক্রম বন্ধ আছে।আব্বাসের বিরুদ্ধে আরও মামলা : মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় জানা গেছে, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ২০০১ সালের ১৩ ফেব্র“য়ারি রমনা থানায় জননিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। মামলা নম্বর-৩৫। অন্যদিকে ২০০৪ সালের ২৮ মার্চ শাহজাহানপুর ঝিল মসজিদ পুকুর পাড়ে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) ছাত্র আরিফ মোরশেদ খানকে হত্যার অভিযোগে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় হত্যা মামলা হয়। এর এক বছর পর ২০০৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর শাজাহানপুরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে রকিবুল ইসলামকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার অভিযোগে রকিবুলের চাচা আবদুল গফুর মতিঝিল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০০৮ সালে রকিবুল হত্যা মামলা ও ২০১২ সালে মোরশেদ হত্যা মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ২০০৭ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি আব্বাসের বাড়িতে বৈদেশিক মুদ্রা রাখার অভিযোগে মিতঝিল থানায় বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। মামলাটি বিচারাধীন। মতিঝিল থানার মামলা নম্বর-৭০।আরও জানা গেছে, ২০০৭ সালের ২২ মার্চ আব্বাসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়। মতিঝিল থানার মামলা নম্বর-১৪০। এর চার মাস পর শাহবাগ থানায় তার বিরুদ্ধে আরেকটি দুর্নীতির মামলা হয়। শাহবাগ থানার মামলা নম্বর-৩০। ২০০৭ সালের ১৫ জুলাই মামলা হয়। এর এক মাস পর জ্ঞাত আয়বহির্র্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা হয় আব্বাসের বিরুদ্ধে। মতিঝিল থানার মামলা নম্বর-৩৫। ২০০৭ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে আব্বাসের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলা হয়।