রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

ভেজালবিরোধী অভিযান চলবেই

1_18304

রমজান মাস শেষ হলেও পুলিশের ফরমালিনবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শেষ হচ্ছে না, বন্ধ হচ্ছে না ভেজালবিরোধী প্রশাসনিক তৎপরতাও। বরং খাদ্যপণ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ ও ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল ব্যবহার রোধে লাগাতার অভিযান চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নাগরিকদের কাছে ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ খাদ্যপণ্য পৌঁছানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে দেশব্যাপী স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।রাজধানীসহ অন্যান্য মহানগর পর্যায়ে পুলিশ কমিশনারদের নেতৃত্বে এবং জেলা পর্যায়ে ডিসিদের তত্ত্বাবধানে ভেজালবিরোধী সমন্বয় কমিটি গঠন করা হবে। প্রতি মাসেই এ কমিটি রুটিনমাফিক অভিযান পরিচালনাসহ খাদ্যপণ্যে ভেজাল রোধ, ফরমালিন, কার্বাইড, টেক্সটাইল রং ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করাসহ বাসি-পচা, বিনষ্ট খাবার কেনাবেচা পুরোপুরি বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। সমন্বিত কমিটির ভেজালবিরোধী কার্যক্রম গ্রাম-গঞ্জ, তৃণমূল পর্যায়ের হাটবাজারে ছড়িয়ে দিতে উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও কমিটি গঠনের চিন্তাভাবনা চলছে।রমজান মাস শুরুর আগে থেকেই রাজধানীতে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের ‘ফরমালিনবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান’ পরিচালনায় দারুণ সফলতা অর্জিত হয়েছে। নগরীর বাজারগুলোতে ক্রেতারা ফরমালিনমুক্ত খাদ্যপণ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনেকটাই আস্থাবান হয়ে উঠেছেন। তাছাড়া সাধারণ মানুষজনের মধ্যে ফরমালিনবিরোধী জনসচেতনতাও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু রাজধানীতে পুলিশ নানামুখী ব্যস্ততার মধ্যে অনেকটা এককভাবে ভেজালবিরোধী কার্যক্রম চালালেও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত কার্যক্রম ছিল না বললেই চলে। ফলে ফরমালিন ছাড়া অন্যান্য রাসায়নিক মিশ্রিত খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। শুধু সমন্বয়হীনতায় ভেজাল খাদ্যপণ্যের অভিশাপ থেকে নিস্তার মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম জেলায় ভেজালবিরোধী সমন্বিত অভিযানের চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপনের খবর পাওয়া গেছে। বিএসটিআই চট্টগ্রাম আঞ্চলিক দফতরের সহকারী পরিচালক আবু হানিফ জানান, পবিত্র রমজান শুরুর আগেই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে একটি অ্যাকশন টিম গঠন করা হয়। এ টিমে বিএসটিআই, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, সিটি করপোরেশন, জেলা খাদ্য কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ, র‌্যাব, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স, পরিবেশ অধিদফতর, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ রয়েছে। বিএসটিআই কর্মকর্তা আবু হানিফ বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে বৈঠকে বসে সাত দিনের বাজার তদারকির রুটিন ও অন্তত দুই দিন অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরের বৈঠকেই অগ্রগতি পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রস্তুতেরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিএসটিআইর চলমান ভেজালবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগেও সার্বক্ষণিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। ফলে চলতি রমজান মাসে চট্টগ্রামে ভেজালবিরোধী কার্যক্রম যে কোনো বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি গতি পেয়েছে।’ তার মতে, জেলা প্রশাসনের গৃহীত সমন্বয় কমিটির কর্মকাণ্ড চট্টগ্রাম নগরীতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, নগরবাসীর মনেও সৃষ্টি হয়েছে স্বস্তি।ডিএমপি কমিশনারের মতো দেশের অন্যান্য মহানগরে এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের গঠিত সমন্বয় কমিটির আদলে জেলায় জেলায় কমিটি গঠনসহ অভিযান পরিচালনা জরুরি মনে করছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল। নির্দিষ্ট কোনো সময় বা মাসের জন্য নয়, সারা বছরই ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা ও বাজার তদারকির নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে। এক্ষেত্রে সর্বত্র সমন্বয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে ভেজালবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনায় ‘স্থায়ী ভিত্তির কাঠামো’ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কমিটি ও অ্যাকশন টিমে অন্তর্ভুক্ত থাকছে একাধিক ম্যাজিস্ট্রেট। থানা পর্যায়ের স্যানিটেশন ইন্সপেক্টরদের তৎপরতাকে আরও জবাবদিহিমূলক করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভেজালবিরোধী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের তেমন কোনো তৎপরতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, অভিযান পরিচালনা বা বাজার পর্যবেক্ষণ কর্মকাণ্ড থেকে এ তিনটি দায়িত্বশীল সংস্থা বরাবরই পিছিয়ে থাকে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা এবং গাফিলতির কারণেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য তারা আইনের প্রয়োগের অভাব, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি আর আইন প্রয়োগে সরকারের অনীহাকেও দায়ী করেছেন। এ ছাড়া ভেজাল খাবার শনাক্তকরণে ল্যাবরেটরির সীমাবদ্ধতা আর সচেতনতার অভাবতেও ওই প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়েছে। টিআইবি দেখতে পেয়েছে, ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব থাকলেও তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই এবং আইনের কার্যকর প্রয়োগেরও অভাব রয়েছে। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ব পালনে যেমন অবহেলা রয়েছে, তেমনি তারা নিজেরা দুর্নীতির সঙ্গেও জড়িত রয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ভেজাল খাবার রোধের জন্য মানুষের সচেতনতাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সচেতন মহলকেই এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, ভেজালের ব্যাপ্তি ও পরিণতি ব্যাখ্যা করতে হবে, এগুলো থেকে বেঁচে থাকার পথও দেখাতে হবে। আমাদের দেশে যে হারে দুরারোগ্য ব্যাধি বাড়ছে, তাতে ভেজাল খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করার ব্যাপারে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে রোগব্যাধি যেমন বাড়বে, তেমনি সঙ্গে তৈরি হবে মেধাশূন্য জাতি, যা দেশের জন্য এক ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনবে।