সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

জেল থেকে লেখা সাঈদীর জিহাদি বই বাজারে!

5_23451

জেলে বসে ‘জিহাদি বই’ লিখলেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারিক আদালতে দণ্ডিত জামায়াতে ইসলামীর এই নেতার লেখা সেই বই এখন বাজারে। ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে গ্রামে, ভক্তদের হাতে হাতে। ‘নন্দিত জাতি, নিন্দিত গন্তব্যে’ নামের এই বইটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে গত ফেব্রুয়ারি থেকে। প্রকাশ করেছে গ্লোবাল পাবলিশিং নেটওয়ার্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগ ও সরকারকে অনৈসলামিক উল্লেখ করে সমালোচনাসহ সশস্ত্র লড়াই, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিরও নানা উপাদান রয়েছে বইটিতে।

জানা গেছে, ২০১০ সালের জুনে গ্রেফতার হওয়ার পর জেলখানায় বসে এ বই লেখা শুরু করেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। বিভিন্নভাবে সহযোগিতা নেন ছেলে আবদুস সালাম মিতুলের কাছ থেকে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ভেদ করে কৌশলে পাণ্ডুলিপি পাচার করা হয় কারাগারের চার দেয়ালের বাইরে। পরে তা বই আকারে প্রকাশ করেন পরিবারের সদস্যরা। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়েছে অত্যন্ত গোপনে, কারা কর্তৃপক্ষের অজান্তে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই বই লেখার সময় যথাযথভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেননি সাঈদী। এমনকি জেল থেকে লেখা তার বই বাজারে-এ খবরও জানে না কারা কর্তৃপক্ষ। কারা আইন বলছে, অনুমতিসাপেক্ষে কারাগারে বসে সাহিত্য চর্চা করতে পারবেন যে কোনো বন্দী। তবে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উন্মাদনা কিংবা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এমন কিছু লেখা যাবে না। কিন্তু আইন ভেঙে কোনো উপায়ে একজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হয়েও জেলে বসে সাঈদী এমন বই লিখলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন আসছে কারাগারে থাকা স্পর্শকাতর মামলার আসামিদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি নিয়েও। আইনজ্ঞরা বলছেন, পাণ্ডুলিপি বাইরে পাচার করে তা বই আকারে প্রকাশ করার ঘটনা নজিরবিহীন। কারাগারে আটক অন্য স্পর্শকাতর বন্দীরাও এভাবে পাণ্ডুলিপি বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করছেন কিনা, তা তদন্ত করা প্রয়োজন। কারণ জেলে থাকা অবস্থায় এভাবে বই প্রকাশ সম্পূর্ণ বেআইনি। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরাও। তারা বলেছেন, বইটি অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করা উচিত।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার ফরমান আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের অনুমতি ও বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে লেখালেখি এবং সাহিত্য চর্চা করতে পারবেন কারাবন্দীরা। তবে তা হতে হবে জেল কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে। সাঈদীর বই লেখা ও প্রকাশের ঘটনা কীভাবে ঘটল সে সম্পর্কে আমার জানা নেই।’

লেখকের মেজো ছেলে শামীম সাঈদী ৫২৪ পৃষ্ঠার এ বইয়ের প্রকাশক। প্রচ্ছদ করেছেন সেজো ছেলে মাসউদ সাঈদী। আর বইয়ে অনুলেখক হিসেবে রয়েছে আরেক ছেলে আবদুস সালাম মিতুলের নাম। ঢাকার বড় মগবাজারের নাবিল কম্পিউটার থেকে কম্পোজ করা ও বাংলাবাজারের আল আকাবা প্রিন্টার্স থেকে মুদ্রিত বহু বানান ও ব্যাকরণগত ভুলে ভরা বইটির মূল্য ৩৫০ টাকা। পাঁচ অধ্যায়ের এ বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে, লেখকের প্রয়াত বড় ছেলে মাওলানা রাফিক বিন সাঈদীকে।

বইয়ের শুরুতে ‘মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশ্যে যা বলতে চেয়েছি’ শিরোনামে চার পৃষ্ঠার ভূমিকা লিখেছেন সাঈদী। বইয়ের ১৩ পৃষ্ঠায় অনুলেখক অভিযোগ করেছেন, ‘শুধু কোরআন প্রচারের অপরাধেই ফাঁসির দণ্ডাদেশ শুনতে হয়েছে সাঈদীকে।’ ৩৭৭ থেকে ৪১১ পৃষ্ঠায় শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী, হাজী শরিয়ত উল্লাহ ও মীর নিসার আলী তিতুমীর প্রমুখের জীবনকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে জিহাদি স্টাইলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি আলেম সমাজের করণীয় বাতলে দিয়েছেন বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে। জঙ্গিবাদকে উসকে দিয়ে এই অধ্যায়ে আরও রয়েছে, ‘জিহাদ ইমানের অপরিহার্য দাবি, মুমিনের জিন্দেগি ও জিহাদ, জিহাদই ইমানের কষ্টি পাথর, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই সশস্ত্র জিহাদের উদ্দেশ্য এবং জিহাদই জান্নাত লাভের একমাত্র পথ’ শীর্ষক কয়েকটি অনুচ্ছেদ। পঞ্চম অধ্যায়ের ৪৩০ পৃষ্ঠায় ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কে আবার বলা হয়েছে, ‘ওলামায়ের কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদগণকে রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।’ পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপক সমালোচনা করা হয়েছে বইটিতে। বাদ যায়নি জাতিসংঘও। কসাইখানার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ এই প্লাটফর্মকে। ৬৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্যের জাতিসমূহের সহিংস জাতীয়তাবাদ তাদের এমন হিংস্র হায়েনায় পরিণত করেছে যে, নিজেদেরই রচিত সাধারণ নিয়ম-নীতি ও নৈতিকতাকেও তারা নূ্যনতম সম্মান প্রদর্শন করছে না। এক কালে কসাইখানার জন্য আমেরিকার যে স্থানটি নির্ধারিত ছিল, সেখানে জাতিসংঘ ভবন নির্মাণ করে উক্ত ভবনে বসেই পৃথিবীর অন্যান্য জাতিসমূহকে লোমহর্ষক পদ্ধতিতে জবেহ করা হচ্ছে।’

বইয়ের ৯৩ পৃষ্ঠায় প্রকাশ পেয়েছে সাঈদীর রাষ্ট্র ক্ষমতার খায়েশ। কোনো রাখঢাক ছাড়াই তিনি লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যতীত উলি্লখিত সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার মহান আল্লাহর এই আদেশ বাস্তবায়ন করা যায় না। আর রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জন করতে হলে অবশ্যই ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদের একতাবদ্ধ হয়ে একটি শক্তিশালী সংগঠন দাঁড় করাতে হবে এবং সেই সংগঠনকে বিজয়ী করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে হবে।’ আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বইয়ের ৩২০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগ প্রতিবেশী দেশের প্রভাবে এবং দেশীয় বা নিজ দলীয় নাস্তিকদের পরামর্শে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ সংযোজন করেছিল। অথচ আওয়ামী লীগের ছয় দফায় ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের উল্লেখ ছিল না।’ তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে একই পৃষ্ঠায় বিশেষায়িত করা হয়েছে ‘মহান’ অভিধায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দৃষ্টান্ত এসেছে বইয়ের ৩২৭ পৃষ্ঠায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অস্তিত্ব সগৌরবে বিরাজমান।’ ৩৬৭ পৃষ্ঠায় অমুসলিম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মুঘল সম্রাট আকবরকে। বলা হয়েছে, ‘সম্রাট আকবরের নামটি শুধু মুসলিমদের অনুরূপ ছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি মুসলিম ছিলেন না। আকবর স্বয়ং কপালে চন্দন তিলক ব্যবহার করতেন। সূর্য বন্দনা করতেন।’ রেফারেন্স ও নিজের প্রকাশিত বইয়ের একটি তালিকা উল্লেখ করে শেষ করা হয়েছে ৩৩ ফর্মার এই বইটি।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঘটনাটি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উসকানিমূলক কিছু থাকলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে বইটি।’