শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

সম্প্রচার নীতিমালা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক

36720_f3

জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালা সংবিধান ও তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে (টিআইবি)। প্রতিষ্ঠানটি এ নীতিমালা সংশোধনের দাবি জানিয়ে বলেছে, এটা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে। একই সঙ্গে নীতিমালায় ‘কিছু ইতিবাচক’ দিক থাকলেও সার্বিকভাবে তা গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা বলে মনে হচ্ছে। এ নীতি একুশ শতকের উপযোগী নয়। তাই নিবর্তনমূলক এ নীতি গ্রহণযোগ্য নয়। গতকাল রাজধানীর হোটেল অবকাশে জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালা ২০১৪ বিষয়ে সংগঠনটির অবস্থান তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রচলিত বিধি, আইন ও নীতিসমূহ থেকে বিভিন্ন ধারা সংকলন করে একটি নিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণমূলক নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়টি দুঃখজনক। সম্প্রচার নীতিমালায় কমিশন স্বাধীন হবে বলা হলেও তা নিশ্চিত করার কোন সুর্নিদিষ্ট দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়নি। যে সার্চ কমিটির মাধ্যমে চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ নির্বাচিত হবেন সেই সার্চ কমিটিতে ১০ ধরনের পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব থাকছে। কিন্তু চেয়ারম্যান এবং সদস্যগণের যোগ্যতার মানদণ্ড সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে ৬টি
সুপারিশ তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া এই সমপ্রচার নীতিমালার তৃতীয় অধ্যায়ে সংবাদ ও অনুষ্ঠান অংশের ৩.২.১ ধারায় উল্লেখ রয়েছে সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশবিরোধী কিংবা জনস্বার্থবিরোধী কিছু প্রদর্শন করা যাবে না। কিন্তু এ ধারাটিতে এটি উল্লেখ নেই যে দেশবিরোধী কিংবা জনস্বার্থবিরোধী বিষয়গুলো কি কি হতে পারে। এতে সরকার বা ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালায় বলা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের মানহানি হয় এমন কিছু প্রদর্শন করা যাবে না। তার মানে কি যারা দুর্নীতি করবেন তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না? এর মানে তো গণমাধ্যমের স্বাধীনতাই আর রইলো না। এ রকম বেশ কিছু সাংঘর্ষিক বিষয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান নীতিমালা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। প্রায় একই আশঙ্কার কথা জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, এ নীতিমালা নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এভাবে গণমাধ্যম চলতে পারে না। নীতিমালায় গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাই নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, তথ্য অধিকার আইনে বিশেষ বাহিনীর বিষয়ে কোন তথ্য জানার সুযোগ রাখা হয়নি। আর এ নীতিমালায় জুড়ে দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এর মাধ্যমে আইনের ঊর্ধে রেখে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হবে। তখন তারা দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, দেশে যে সরকারই আসে, তারা ‘দেশ, সরকার ও রাষ্ট্রকে’ একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। তারা মনে করেন, সরকারের বিরদ্ধে কথা বলা মানে দেশের বিরদ্ধে কথা বলা। এ নীতিমালা কার্যকর হলে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থাহীনতা আরও বেড়ে যাবে। নীতিমালার শর্তগুলোতে ‘অস্পষ্টতার’ কারণে সবাইকে ঝুঁকির মধ্যে রেখে দেয়া ‘বিপজ্জনক’ বলেও জানান তিনি। সম্মেলনে জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালা ২০১৪ বিষয়ে সংগঠনটির অবস্থান তুলে ধরেন টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) রিজওয়ান-উল-আলম।
৬ সুপারিশ
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে টিআইবি তাদের পক্ষ থেকে ৬টি সুপারিশ তুলে ধরে। এগুলো হচ্ছে- ১.অনতিবিলম্বে একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর সম্প্রচার কমিশন গঠন করে উক্ত কমিশনের মাধ্যমেই এই নিয়মাবলী চূড়ান্ত হলে বর্তমান নীতিমালা সম্পর্কে অংশীজনদের মধ্যে যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তার নিরসন হবে। ২. সম্প্রচার সংক্রান্ত আইন ও বিধি প্রণয়নে সকল অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করে সর্বসম্মতভাবে এমনভাবে অগ্রসর হতে হবে যেন এ নিয়ে কোন বিতর্ক সৃষ্টি না হয়। ৩. সার্চ কমিটির গঠনের সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা না হলে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত সম্প্রচার কমিশন বিতর্কের সম্মুখীন হবে। এ ক্ষেত্রে সকল ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের সুযোগ বন্ধ করতে হবে।
৪. লাইসেন্সিং ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার স্বার্থে এ সংক্রান্ত নীতিমালার বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
৫. সাংবাদিকতা ও সম্প্রচার মাধ্যমের পেশাগত মানের উৎকর্ষে স্ব-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই সর্বোত্তম হিসেবে বিশ্বে পরিগণিত হয়ে থাকে। সম্প্রচার খাতের সঙ্গে সংযুক্ত নেতৃত্ব এবং কর্মীদেরকে স্ব-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উদ্ভাবনে নিজস্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করতে পারেন। এই আচরণবিধি প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা তা তদারকের দায়িত্ব সাংবাদিকদের সম্প্রচার খাতের পেশাজীবী সংগঠনের ওপর ন্যস্ত হতে পারে। সবশেষ সুপারিশে বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপন নীতিমালাকে সম্প্রচার নীতিমালা থেকে আলাদা করে বিস্তৃত পরিসরে গবেষণা করে ও সংশ্লিষ্ট অংশীজন যেমন, পণ্য প্রস্তুতকারী, বিজ্ঞাপন নির্মাতা, কলাকুশলী ও সম্প্রচার মাধ্যমের প্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারি সকল গণমাধ্যমের জন্য প্রযোজ্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে।
নিয়ন্ত্রণের নামে অনলাইন নীতিমালা
এদিকে অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিয়ন্ত্রণের নামে সরকার এর নীতিমালা করতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে টিআইবি জানায়, নিয়ন্ত্রণের নামে অনলাইনের জন্য আলাদা নীতিমালা এখানকার সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে খর্ব করবে। এ প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেন, যে খসড়া তৈরি হয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে তার বেশ কিছু ধারা অনলাইন গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে হরণ করবে। অনলাইন নিউজ পোর্টালের জন্য দেশে আলাদা নীতিমালা বা আইনের প্রয়োজন নেই। প্রচলিত আইনেই এর ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য নীতিমালার কথা বলা হলেও মূলত গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণের জন্যই এগুলো করছে সরকার। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, টিআইবি জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা’র খসড়ার ওপর ২০১৩ সালের ২রা অক্টোবর তথ্য মন্ত্রণালয় বরাবর বেশ কিছু সুপারিশ পেশ করে। এর প্রেক্ষিতে ২১শে অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে টিআইবিকে ধন্যবাদ জানিয়ে গণমাধ্যমে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে। সুপারিশসমূহের প্রেক্ষিতে তথ্য মন্ত্রণালয় কি পদক্ষেপ নিয়েছে জানতে চেয়ে টিআইবি গত ২৯শে জানুয়ারি তথ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। এর উত্তরে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আর কিছু টিআইবিকে জানানো হয়নি।
টিআইবির পর্যবেক্ষণ
নীতিমালা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, যে ১৩ টি লক্ষ্য ও চারটি কৌশলের মাধ্যমে সম্প্রচার নীতিমালা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে অনেকগুলোর ব্যাখ্যা নীতিমালায় নেই। সংবাদ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচার অংশের ৩.২.১ ধারায় অনুষ্ঠানে সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনভাবেই দেশবিরোধী এবং জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না (নতুন সংযোজন)। নতুন করে গৃহীত এই ধারাটিতে দেশবিরোধী এবং জনস্বার্থ বিরোধী বক্তব্য সম্পর্কে নীতিমালায় স্পষ্ট করে কিছু বলা না থাকায় এর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার একটা সুযোগ তৈরি হবে। এতে সম্প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত বিষয় নিয়ে সরকার নিজস্ব মতামত দিয়ে যে কোন পদক্ষেপ নিতে পারবে। এতে আরও বলা হয়েছে, সরকার স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের গবেষণামূলক তথ্য-উপাত্ত প্রচারের ওপর এক ধরণের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেই ধারাটি অপরিবর্তিত অবস্থায় রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পঞ্চম অধ্যায়ে উল্লিখিত ১২ টি বিষয়ের মধ্যে যে ৭টি বিষয় ‘করা যাবে না’ মর্মে সম্প্রচার নীতিমালায় বলা হয়েছে তার বেশির ভাগই বাক্‌স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকারেরই শুধু পরিপন্থি নয়, তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তথ্যের অধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ।