শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

লঞ্চ উদ্ধারের আশা নেই!

pic-10_115015

মেঘনার বুকে ১৯৯৫ সালে যাত্রীসহ ডুবে যায় দিনার নামে একটি লঞ্চ। এর সাত বছরের মাথায় ২০০২ সালে এই মেঘনায় ডুবে যায় যাত্রীবোঝাই লঞ্চ এমভি নাসরিন খান-১। এতে তিন শতাধিক যাত্রী মারা যায়। কয়েক দিন ধরে টানা অনুসন্ধান চালানোর পরও লঞ্চটির কোনো হদিস মেলেনি। পরে লঞ্চ দুটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে উদ্ধার তৎপরতায় ক্ষান্ত দেয় কর্তৃপক্ষ। ২০০৫ সালে আরিচায় যমুনা নদীতে যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় এমএল রায়পুরা। মারা যায় শতাধিক যাত্রী। এ লঞ্চেরও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। শেষে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে উদ্ধার কার্যক্রম শেষ করা হয়। মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে পদ্মা নদীতে গত সোমবার ডুবে যাওয়া এমএল পিনাক-৬ লঞ্চটিরও গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত কোনো খোঁজ মেলেনি। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে পাঁচ দিন। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে দিনরাত অনুসন্ধান চলছে। কিন্তু লঞ্চের কোনো পাত্তা নেই। সময় যত গড়াচ্ছে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে আশা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো সময় উদ্ধার কার্যক্রম পরিত্যক্ত ঘোষণা হতে পারে।
নৌযান উদ্ধার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত কোনোভাবে পিনাক-৬-এর সন্ধান মিললেও তা উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। এ জন্য উদ্ধারকাজের শুরুতে কর্তৃপক্ষের সঠিক পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতার অভাবকে দায়ী করছেন তাঁরা।
তবে গতকাল বিকেলে উদ্ধার সম্পর্কে কালের কণ্ঠের প্রশ্নের মুখে নৌপরিবহনমন্ত্রী মো. শাহাজান খান বলেন, ‘যতক্ষণ সম্ভব উদ্ধারের চেষ্টা চলবে। উদ্ধার টিমে যারা আছে তারা যখন অপারগতা জানাবে, কেবল তখনই অভিযান সমাপ্ত হবে।’ জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘দেশের সব শক্তি ও দক্ষ জনবল এ অভিযানে রয়েছে। তাই দক্ষতা বা পরিকল্পনার ঘাটতির বিষয়টি ঠিক নয়। আমরা এখনো আশা ছাড়িনি। কারণ কেবল বাংলাদেশেরই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তিই ব্যবহার হচ্ছে এখানে।’
বিশেষজ্ঞরা জানান, পদ্মায় যে হারে পলি প্রবাহিত হয়, তাতে গত পাঁচ দিনে লঞ্চটি নদীর যে জায়গাতেই থাকুক না কেন, এত দিনে পলি-বালুর নিচে চাপা পড়ার আশঙ্কাই বেশি। পরে লঞ্চটি শনাক্ত করা গেলেও এটি উদ্ধারের মতো অবস্থা থাকবে না কিংবা বর্তমানেও সেটি উদ্ধারের অবস্থায় আছে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে তল্লাশির পরও লঞ্চটি পাঁচ দিনে শনাক্ত না হওয়া নিয়েও এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। আগের বিভিন্ন ঘটনার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তাঁরা এমন মতামত দিয়েছেন।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানও এমন আশঙ্কার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, নদীর এ এলাকার তলদেশ সমতল নয়। একেক স্থানে একেক রকম গভীরতা। বিভিন্ন স্থানে গর্তও রয়েছে। লঞ্চটি এমন কোনো গর্তে পড়েছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ক্যাপ্টেন শফিকুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ উদ্ধার অভিযানের শুরুতে অনেকটাই অপরিকল্পিতভাবে কাজ করেছে বলে মনে হয়। বিশেষ করে নদীর স্রোত, গভীরতা কিংবা পলি-বালু প্রবাহের হার সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের স্বাভাবিক ধারণা আছে। এ ক্ষেত্রে তারা আগে কেন বুঝতে পারল না যে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম বা নির্ভীক দিয়ে কাজ হবে না। তারা কেন আগেভাগেই আরো উন্নত প্রযুক্তি ডাকেনি। এখন লঞ্চটি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) সাবেক একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা শুনেছি প্রথম দিনেই স্থানীয় একজন ডুবুরি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে লঞ্চটি খুঁজে বের করে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল। কিন্তু উপস্থিত প্রশাসনের লোকজন তাঁকে কাজে খাটায়নি, বরং সরিয়ে দিয়েছে।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, এর আগে বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে কর্তৃপক্ষের উদ্ধার টিম ডুবে যাওয়া নৌযান শনাক্ত করতে না পারলেও স্থানীয় ডুবুরিরা ঠিকই তা খুঁজে বের করেছেন। যেমনটা ঘটেছিল বলেশ্বর নদে একটি লঞ্চডুবির ঘটনায়ও। এ ক্ষেত্রেও যেহেতু সব চেষ্টাই বিফল হচ্ছে তখন স্থানীয় ডুবুরিদের দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে অসুবিধা ছিল না। তাই এখন প্রশাসন হয়তো উদ্ধার অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি ঘোষণার সুযোগ খুঁজছে। এমনকি যেকোনো সময় লঞ্চটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণাও করা হতে পারে।
স্থানীয় ডুবুরি ব্যবহার না করার বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহনমন্ত্রী বলেন, ‘এমন কোনো বিষয় স্থানীয় কেউ আমাদের জানায়নি। আমরা তো চাই যেভাবেই হোক লঞ্চটি উদ্ধার হোক।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পিনাক-৬ উদ্ধারকাজে একে একে বিআইডাব্লিউটিএর জরিপ নৌযান তিস্তা, ওয়ার্ক বোট বদ্বীপ, বিআইডাব্লিউটিসির ভিআইপি ভেসেল সন্ধানী, টাগ বোট আইটি ৯৭, উদ্ধার জাহাজ রুস্তম, নির্ভীক, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের জরিপ বোট কাণ্ডারী-২, জরিপ ১০ অংশ নিয়েছে। এ ছাড়া নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব আরো কয়েকটি বোট উদ্ধার অভিযানে কাজ করছে। আকাশ থেকে হেলিকপ্টারে চলছে তল্লাশি। অভিযানে আধুনিক সাইড স্ক্যান সোনারের মতো অনুসন্ধান যন্ত্রের পাশাপাশি ম্যানুয়াল বিভিন্ন উপকরণও রয়েছে। এ ছাড়া নৌমন্ত্রীর সরাসরি তদারকিতে বিভিন্ন সংস্থার প্রায় এক হাজার জনবল যুক্ত রয়েছে উদ্ধারযজ্ঞে। তার পরও পাঁচ দিনে লঞ্চের কোনো কূল-কিনারা হয়নি। অবশ্য এর আগে এর চেয়েও দীর্ঘ সময় উদ্ধার অভিযান চালিয়েও শেষ পর্যন্ত সফলতা মেলেনি।
যেকোনো লঞ্চডুবির পর সেটি উদ্ধারে মালিকপক্ষের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক হলেও পিনাক-৬-এর ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টো ঘটনা। মালিককে ধরতে পারছে না প্রশাসন। বিআইডাব্লিউটিএ সূত্র জানায়, লঞ্চডুবির ঘটনায় লঞ্চটি উদ্ধারের যাবতীয় ব্যয় বহন করতে হবে লঞ্চের মালিকপক্ষকে। কিন্তু এবার যে ব্যয়বহুল অভিযান তাতে এত খরচ আদৌ মালিকপক্ষের কাছ থেকে সরকার আদায় করতে পারবে কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
এদিকে পিনাক-৬ লঞ্চডুবির সময় ওই স্থান অতিক্রমকারী ফেরি কেতকীর নোঙর না করা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিআইডাব্লিউটিসির ওই ফেরিটি থামিয়ে যাত্রী উদ্ধারে ভূমিকা রাখলে হতাহতের ঘটনা আরো কম ঘটত বলেও মনে করছে অনেকে।
সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ফকরুল ইসলাম বলেন, ‘ফেরিটি কেন থামায়নি তা বোধগম্য হচ্ছে না। আমাদের নির্দেশনা অনুসারেও যেকোনো নৌযান দুর্ঘটনার সময় আশপাশে থাকলে সেটি থামিয়ে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।’
তবে মাওয়ায় ফেরি সার্ভিস দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিআইডাব্লিউটিসির ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) শেখর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেন, ‘কেতকী দুর্ঘটনাস্থল অতিক্রম করার সময় তাৎক্ষণিক বয়া ফেলে ডুবে যাওয়া লঞ্চটির যাত্রীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু নদীর অবস্থা ভালো না থাকায় ওই স্থানে ফেরিটি থামানোর মতো অবস্থা ছিল না।
তবে ফেরি বিভাগের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ফেরিটি অবশ্যই থামানো যেত। এমনকি ফেরিটি লঞ্চটির কাছাকাছি গিয়ে একটি রশি ফেলে বেঁধে ফেললে লঞ্চটি নিখোঁজ হতো না, ফেরিরও কোনো সমস্যা হতো না। কারণ ফেরির সক্ষমতা অনেক বেশি ছিল।
ফেরি না থামানোর বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল বলেন, তদন্তের সময় এ বিষয়টি খুঁজে দেখা হবে। ফেরিটি যদি না থামানো হয়ে থাকে তবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পদ্মার যে এলাকায় এমএল পিনাক ডুবে গেছে সেখানে পানির গভীরতা ৬০-৭০ ফুটের বেশি নয়। আবার এখানে স্রোত বেশি হলেও চাঁদপুরের মোহনার চেয়ে ভয়ংকর অবস্থা সাধারণত দেশের আর কোথাও নেই। সেখানে নদীর গভীরতাও ১৬০ ফুটের ওপরে। সেখানেই ডুবেছিল নাসরিন খান-১। তবে চাঁদপুরের মোহনাতেও দেশের প্রচলিত পুরনো প্রযুক্তি ব্যবহার করেই ডুবন্ত নৌযান খুঁজে বের করার নজির আছে। ২০০২ সালে চাঁদপুরের ষাটনলে মেঘনা মোহনায় ডুবে যাওয়ার পর দেড় শ ফুটেরও বেশি গভীরে এমভি সালাউদ্দিন-২ নামে একটি লঞ্চের সন্ধান মিলেছিল। তাও অনুসন্ধানের চার দিনের মাথায়। কিন্তু এবার আগের চেয়ে বহুগুণ বেশি ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও লঞ্চটির হদিস না পাওয়ার কথা নয়। তাই উদ্ধারকাজ নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় দেখা দিতে পারে।

উৎস- কালেরকন্ঠ
্ু