উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের (অভিশংসন) ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাই সংবিধান সংশোধনের জন্য ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন, ২০১৪’-এর খসড়ায় ভেটিং সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, মন্ত্রিসভায় সংশোধনীটি অনুমোদনের ফলে স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে এবং জনপ্রতিনিধিদের নিকট জবাবদিহি সমুন্নত হবে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের অনুমোদনের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের যে বিধান ছিল, সংবিধান সংশোধন করে সেটিই আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। পাশাপাশি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক অপসারণের নিয়মটি বাদ পড়ছে। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলেও পরে সামরিক সরকারের আমলে এক সামরিক ফরমানে ওই অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়। পরে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ কাছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের পদের মেয়াদ সংক্রান্ত বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ৯৬-এর-১ অনুচ্ছেদের বিধানবলী সাপেক্ষে কোন বিচারক ৬৭ বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। ৯৬’র-২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রমাণিত অসাদচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না। ৯৬’র-৩ অনুচ্ছেদে ছিল, এই অনুচ্ছেদের ২ দফায় অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবে। ৯৬’র-৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করে। উপস্থাপনকালে তারা জানায়, সংবিধান সংশোধনকল্পে এটি একটি আইন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মহান আদর্শের প্রতিফলনে ১৯৭২ সালে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হলো জনগণের অভিপ্রায়ের পর অভিব্যক্তি এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের-৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণের পক্ষে ক্ষমতার এই প্রয়োগ কেবলমাত্র সংবিধানের অধীন কার্যকর হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল স্পিরিট ছিল রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ- আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের চূড়ান্ত জবাবদিহি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদের ওপর ন্যস্ত ছিল। তারই আলোকে সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক বিধানগুলো আছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণের মেয়াদকাল নির্ধারণ বা অপসারণের বিধান সেই জনগণের মালিকানা এবং সংসদের সার্বভৌমত্ব এবং নির্বাচিত সংসদের কাছে জবাবদিহি নির্ধারিত হয়েছিল। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে সামরিক শাসন জারি করে সামরিক ফরমান বলে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়। ১৯৭৮ সালে জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে যে ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ছিল তা সামরিক ফরমানবলে সংবিধান সংশোধন করে এই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে অর্পণ করা হয়েছিল। আইনটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনকালে গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান ৭ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। কারণ, একজন অভিযুক্ত বিচারক যার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ আসছে এবং কাউন্সিলের যারা সদস্য তারা অনেক দিন একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার কারণে তারা যে সিদ্ধান্ত দেবেন তার নিরপেক্ষতা এবং যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। মন্ত্রিসভা আরও কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেছে, সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদ প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের বিধান আছে। সংসদ প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করতে পারে। দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের প্রস্তাবে প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করা যায়। সংবিধানের ৭৪-গ অনুচ্ছেদে স্পিকারকে অপসারণের বিধান আছে এবং ৫৭’র-২ অনুচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণের বিধান রয়েছে। সংসদ যদি সিম্পল মেজরিটি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বা মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করলে বহাল থাকতে পারেন না। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে অনাস্থা বা অভিশংসন বা অপসারণ করতে পারে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের মূল প্রভিশন ছিল প্রেসিডেন্টের অভিশংসন, স্পিকারের অপসারণ, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার অপসারণ। মন্ত্রিসভাকে অভিহিত করা হয়েছে, সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আইন কমিশন সংসদের হাতে ক্ষমতা দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। এখন একটি আইন করতে হবে। যে আইনে বলা থাকবে বিচারকদের অসামর্থ্য, অসদাচরণ, অভিযোগ সম্পর্কে কি প্রক্রিয়ায় তদন্ত হবে, সংসদ কিভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করবে, এবং প্রেসিডেন্ট কি প্রক্রিয়ায় তা অনুমোদন করবে। তিনি বলেন, এই সংশোধনের ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়ালের বিধান থাকবে না। সংসদের উপস্থিত মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ যদি মনে করে কোনো বিচারককে অপসারণ করা প্রয়োজন, তবে প্রেসিডেন্ট গ্রহণ করার পর তিনি অপসারিত হবেন। অন্যান্য দেশেও বিচারপতি অপসারণের সিস্টেম রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকার বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতে দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের দুই কক্ষের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুমোদনের পর প্রেসিডেন্টের কাছে গেলে অপসারণ করা হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাজ্যের দুই কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে তারপর রাজা বা রানীর অনুমোদন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে অভিশংসনের ক্ষমতা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিনিধি সভা ও সিনেট সভায় দুই-তৃতীয়াংশের মতামতের পর পাস হয়। প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট সবার জন্য এটি প্রযোজ্য। এ পদ্ধতিতে শ্রীলংকায় কিছুদিন আগে একজন বিচারপতিকে অপসারণ করা হয়েছে। এ বিষয়টি আপনারা দেখেছেন। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতিতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা আছে। মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ায় খসড়াটি এখন বিল আকারে সংসদে তোলা হবে। সংসদের অনুমোদনের পর আরেকটি আইন করা হবে, তাতে বিচারকদের অসামর্থ্য, অসদাচরণ ও অভিযোগ সম্পর্কে কিভাবে তদন্ত হবে, সংসদ কিভাবে প্রস্তাব নেবে এবং প্রেসিডেন্ট কোন প্রক্রিয়ায় তা অনুমোদন করবেন- এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা থাকবে। ওদিকে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিতে আওয়ামী লীগের গত সরকারের সময়ে প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর গত ১১ই আগস্ট অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী আইনটির অগ্রগতি সম্পর্কে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল হকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। এর আগে ২০১২ সালে জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সংসদ সদস্য হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন। এতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবি জোরালো হয়। অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে দিতে সমপ্রতি আইন কমিশন সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে একটি সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার পক্ষে মত দিয়ে আসছেন। গত ২৬শে জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সামরিক শাসকরা করেছিল। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, আগামী ১লা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া সংসদ অধিবেশনেই এ সংক্রান্ত বিলটি পাস হবে। কোন পদ্ধতিতে একজন বিচারককে অপসারণ করা যাবে তার বিশদ ব্যাখ্যাসহ একটি আইন করা হবে বিল পাসের তিন মাসের মধ্যে। তবে সরকারের এই উদ্যোগের সমালোচনা করে বিএনপি বলেছে, ‘একদলীয় শাসন’ প্রতিষ্ঠা করতেই বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের হাতে প্রত্যাবর্তনের আইন করছে সরকার। ৭২ সালে উনি আলোচনা করেননি কেন?বিচারপতিদের অপসারণে ৭২ সালের সংবিধানের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে ড. কামাল হোসেন বলছেন, আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী হওয়া প্রয়োজন। সংবিধান প্রণয়নের সময় এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনার কথা কি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন? উনি আলোচনা করেননি কেন? গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় অনির্ধারিত আলোচনায় এমন প্রশ্ন তোলেন সরকারের এক সিনিয়র মন্ত্রী। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের অনুমোদনের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের যে বিধান ছিল, সংবিধান সংশোধন করে সেটিই আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এ নিয়ে ওদের এত গাত্রদাহ কেন? একাধিক সিনিয়র মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্ত্রিসভায় অনির্ধারিত আলোচনায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক অংশ নেন। তোফায়েল আহমেদ বলেন, পত্রিকার পাতায় দেখলাম কেউ কেউ ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে কথা বলেছেন। আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে ঠিক করার কথা বলেছেন। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, সংবিধানে নতুন করে কিছু বসানো হচ্ছে না। আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক বলেন, আমি মনে করি বিচারপতিদের অপসারণের জন্য এখনই সংবিধান সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। তাদের আলোচনার পর মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া অন্য দলের কেউ মতামত দিতে চান কিনা প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রশ্নে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, এ আইনটি নিয়ে সংসদে আলোচনা করা যাবে। এখন আলোচনা না করলেও চলবে।