স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। এখনো নতুন নতুন আবেদন পড়ছে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম লেখানোর জন্য। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরও খোঁজ মিলছে। যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত আছেন, তাঁদেরও নাম-ঠিকানাসহ সনদে ভুলভ্রান্তি রয়েছে। এসব সমস্যা নিরসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করতে আবারও তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। শুধু তাই নয়, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়েও যে বিতর্ক আছে তার সুরাহার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা যাচাই-বাছাই করবে। আজ ১৪ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সভায় এ-সংক্রান্ত চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়া হবে। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও পোষ্যদের বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। এই সুযোগ-সুবিধা নিতে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও অসৎ উপায়ে গেজেটে নাম উঠিয়ে সনদ নিয়েছে। এ নিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ বিতর্কে জড়িয়েছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। জানা গেছে, দেশের প্রতিটি উপজেলায় বাছাই কমিটি করা হবে। তারাই তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করবে।
সূত্র আরো জানায়, কমিটির সদস্যরা সবার উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করবেন। সনদপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরও যাচাই-বাছাই কমিটির মুখোমুখি হতে হবে। মৃত্যু, বিদেশে অবস্থান বা অন্য কোনো কারণে হাজির না হতে পারলে কমিটির সদস্যরা ওই ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা কি না তা উপস্থিতদের কাছে জানতে চাইবেন। স্বপক্ষে বললে তালিকায় তিনি অন্তর্ভুক্ত হবেন। নাম বাদ পড়লে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ওয়ারিশান জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আপিল করতে পারেন।
যাচাই-বাছাই শুরুর তিন সপ্তাহ আগে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রচার চালানো হবে। শুরুর থেকে দুই মাসের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ের তালিকার কাজ শেষ করা হবে। আর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে তিন মাসের মধ্যে। যাচাই-বাছাইয়ের পর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা চিহ্নিত হবেন তাঁদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে তার সব তালিকাই যাচাই-বাছাই করা হবে।
মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য নতুনভাবে যাঁরা আবেদন করেছেন তাঁদেরও যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে হাজির হতে হবে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে এক লাখ ৮০ হাজার গেজেটেড (সনদপ্রাপ্ত) মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। আর নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য যাঁরা আবেদন করেছেন নতুন যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে তাঁদেরও উপস্থিত হতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেকের সনদে বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। এগুলো নিয়ে তাঁরা মন্ত্রণালয়ে আসেন। কিন্তু আইনি সঠিক যাচাই-বাছাই ছাড়া আমরা সব সমস্যার সমাধান করতে পারি না। বাছাই কমিটি এসব সমস্যার সমাধান করবে। এ জন্য ৪২ বছর ধরে যত মুক্তিযোদ্ধা সরকারি সনদ নিয়েছেন, তাঁদের আবারও উপজেলা পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সঠিকতা প্রমাণের জন্য অনুরোধ করা হবে। আজ ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সভা শেষে ওই কমিটিগুলোর কার্যক্রম নিয়ে আদেশ জারি করা হবে।’ মন্ত্রী বলেন, নতুন যাঁরা আবেদন করেছেন তাঁদেরও কমিটির সামনে উপস্থিত হতে হবে।
যাচাই-বাছাই কমিটিতে যাঁরা থাকবেন : মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, উপজেলা পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য যদি মুক্তিযোদ্ধা হন তবে তিনি আহ্বায়ক হবেন। আর যদি সংসদ সদস্য নিজে মুক্তিযোদ্ধা না হন তবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেই কমিটির আহ্বায়ক হবেন। এ ছাড়া ওই কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিও থাকবেন। থাকবেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধকালীন একজন কমান্ডার প্রতিনিধি। পাঁচ থেকে সাত সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটির সামনে প্রকাশ্যে সবার সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে উপজেলাভিত্তিক ওই কমিটি এলাকার সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। মন্ত্রী বলেন, এ কাজ দুই মাসের মধ্যে শেষ করা হবে। কেউ যদি বাদ পড়ে থাকেন তাঁরা নতুন করে তালিকাভুক্ত হবেন। আর যদি কেউ ভুয়া সনদ নিয়ে থাকেন তাও আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পাওয়া যাবে : স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সংজ্ঞা নিরূপণ করতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। ১৪ সেপ্টেম্বর (আজ) জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের বৈঠকে কাদের মুক্তিযোদ্ধা বলা হবে তার সংজ্ঞা প্রকাশ করা হবে। তবে লাল বার্তা বা মুক্তিবার্তাকে এ বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। এর আগেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাইয়ে চারটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সে সব নির্দেশনার আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংজ্ঞা নিরূপণ করা হবে।
চূড়ান্ত তালিকার পর আর হয়রানি পোহাতে হবে না : ‘আমার স্বামী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা হিসেবে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৮৭ সালের আগস্টে তিনি মারা যান। বিভিন্ন কারণে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সনদটি নেওয়া হয়নি। বর্তমানে আমাদের একমাত্র কন্যাসন্তানের প্রয়োজনে তার বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে মুক্তিযোদ্ধা সনদটি একান্ত প্রয়োজন। আমার স্বামীর মুক্তিবার্তা নং-০৭০০০০১২৭২ এবং লাল বইতে স্মরণীয় বরণীয় তালিকায় (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের) তাঁর নাম ৩১ নম্বরে তালিকাভুক্ত আছে। তাঁর নাম যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। ময়মনসিংহে তাঁর গ্রামের বাড়ির এলাকা থেকে একটি সরেজমিন প্রতিবেদনও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে এখনো পর্যন্ত আমি বাংলাদেশ বেতার থেকে পেনশন পাচ্ছি। আপনার কাছে আমার আবেদন, আমার স্বামীকে তালিকাভুক্ত করে সনদ ইস্যু করুন।’
এভাবে আকুতি-মিনতি করে ৯ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সামনে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাবেক কর্মকর্তার স্ত্রী রেহানা সালাম। তিনি জানান, এক বছর ধরে মন্ত্রণালয়ে আবেদন নিয়ে ঘোরাঘুরি করলেও কেউ তাঁর সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলতে চাননি। আজ সাহস করে মন্ত্রীর কাছে এসেছি। কিন্তু মন্ত্রীও সেই আবেদনের ওপর লিখে দিলেন, পরীক্ষান্তে ব্যবস্থা নিন। কিন্তু কী পরীক্ষা করবে, কার কাছ থেকে পরীক্ষার রিপোর্ট নিবে তা মন্ত্রী স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। পরে মন্ত্রীর লেখা কাগজ নিয়ে রেহানা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সলিমুল্লাহর কাছে গেলে তিনি প্রথমে তাঁকে তাঁর কক্ষে ঢুকতে দেননি। পরে মন্ত্রীর কথা বলার পর যাও ঢুকতে দিলেন, দরখাস্তে মন্ত্রীর লেখা দেখে বললেন, ‘আমাদের কিছু করার নেই। আমরা যখন প্রয়োজন মনে করব আপনার বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।’
এভাবে শুধু রেহানাই নন জাতীয় প্রেসক্লাবের পাশে অবস্থিত সরকারি পরিবহন পুলের ছয় ও সাততলায় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি কক্ষে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সীমাহীন দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত মঙ্গলবার সকালে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা এস এম ইয়াসীন জানান, তাঁদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এভাবেই দুর্ব্যবহার করেন। কথা বলতে চাইলেও শোনেন না। উল্টো প্রশ্ন করেন- কেন বারবার আসেন? দিনের পর দিন এসেও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কোনো ভালো ব্যবহার পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, ‘এত সব অপমান সহ্য করি শুধু ভবিষ্যৎ প্রজম্মের জন্য স্মৃতিটা রেখে যেতে।’
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কেউ নতুন করে সনদের আবেদন-নিবেদন বা নাম সংশোধন বা অন্য কোনো সমস্যা নিয়ে এলেই মন্ত্রী পাঠিয়ে দেন সচিবের কাছে। সচিব পাঠান যুগ্ম সচিবের কাছে আর যুগ্ম সচিব পাঠান উপসচিবের কাছে। এভাবেই ঘুরতে হয়। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি- মুক্তিযোদ্ধা বা তাঁদের স্বজনরা হয়রানির শিকার- এ অভিযোগ ঠিক নয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সলিমুল্লাহ এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো প্রকার দুর্ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিদিন মন্ত্রণালয়ে তাঁর দপ্তরে শত শত লোক আসে। সবাইকে একসঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না বিধায় একজন একজন করে দেখা করতে বলা হয়। এতে একটু ঘোরাঘুরি করতে হয়। তিনি বলেন, যাচাই-বাছাই শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা হলে আর এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি কাউকে হতে হবে না।