শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

অনড় শ্রমিক বিজিএমইএ

35258_b1

আজ তোবা গার্মেন্টের শ্রমিকদের তিন মাসের বকেয়া বেতন ও বোনাস দেয়া ও নেয়ার প্রশ্নে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকার ঘোষণা দিয়েছেন বিজিএমইএ ও শ্রমিকরা। শ্রমিকদের দাবি, মে-জুন নয় তিন মাসের বেতনই তাদের দিতে হবে। আর বেতনের জন্য বিজিএমইএ’র কাছে নয়। সমস্ত বকেয়া তোবা গ্রুপে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সারা দেশে ধর্মঘটসহ হরতাল-অবরোধ পালন করা হবে। অন্যদিকে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে বিজিএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেছেন, বিজিএমইএ কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়। কোন প্রতিষ্ঠানকে বেতন দেবার নিয়ম নেই বিজিএমইএ’র। কিন্তু মানবিক কারণে তোবা গ্রুপের শ্রমিকদের জন্য আজ ২ মাসের বেতনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদি তারা বেতন না নেন, তবে এর দায় বিজিএমইএ নেবে না।
সব পাওনা না পেলে হরতাল: আজ বুধবার তোবার কারখানায় এসে তিন মাসের বকেয়া বেতন ও বোনাস দেয়ার দাবি জানিয়েছেন শ্রমিকেরা। দাবি না মানলে হরতাল ও অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তারা। গতকাল রাজধানীর কাওরান বাজারে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন (বিজিএমইএ) ভবন এলাকা দুই ঘণ্টা ঘেরাও করে শ্রমিকেরা। তোবা গ্রুপ শ্রমিক সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত ঘেরাও কর্মসূচি চলে। সম্পূর্ণ বকেয়া বেতন পরিশোধ না করলে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন শ্রমিকেরা। বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে এই হুমকি দেন তোবা গ্রুপ শ্রমিক সংগ্রাম কমিটির নেতা মাসুদ করিম পথিক। তিনি বলেন, শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিয়ে মালিকরা নানা ধরনের তালবাহানা করে যাচ্ছেন। ঈদে যখন শ্রমিকরা না খেয়ে ছিলেন, তখন মালিকরা দেশের বাইরে গিয়ে ফুর্তি করেছেন। তাদের নতুন রঙ-তামাশা হলো তোবা গ্রুপের কারখানা বাড্ডায় থাকলেও বেতন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বিজিএমই ভবনে। এটা শ্রমিকদের সঙ্গে নেহায়েত তামাশা ছাড়া কিছুই না। মাসুদ করিম বলেন, শ্রমিকরা কোনভাবেই আজ বুধবার বিজিএমইএ ভবনে বেতন নিতে আসবেন না। বেতন দিতে হলে তোবা গ্রুপের কারাখানাতেই দিতে হবে। গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহ-সাধারণ সম্পাদক জনি তালুকদার বলেন, যেসব শ্রমিক আন্দোলন করেছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে বিজিএমইএ নেতারা তাদের লালিত শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বেতন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওই সিদ্ধান্ত তোবা গ্রুপের শ্রমিকরা আগেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদি বুধবারের মধ্যে বেতন-বোনাস না দেয়া হয়, তবে তোবা গ্রুপের শ্রমিকসহ সারা দেশের শ্রমিকদের নিয়ে কঠোর আন্দোলনে যাবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি। সমাবেশে শ্রমিক নেতারা ঘোষণা দেন বুধবার সকাল ১০টায় বাড্ডায় তোবা গ্রুপের কারখানায় হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে আন্দোলন করবেন শ্রমিকরা।
বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও: রাজধানীর কাওরান বাজারের বিজিএমইএ ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবিতে তোবা গ্রুপ শ্রমিক সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শ্রমিকরা। এদিন বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে তোবা গ্রুপের শ্রমিকরা পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও করতে যান। এই সময় তারা ভবনের মূল ফটকে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। পরে বেলা পৌনে ১২টার দিকে ওই ভবনের বাইরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করেন শ্রমিকরা। এ সময় সেখানে পুলিশ সতর্ক অবস্থান নেন। তিন মাসের বকেয়া বেতন-ভাতা আদায়ের দাবিতে মঙ্গলবার বেলা ১১টায় বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেন তোবা শ্রমিকরা। গত রোববার বাড্ডার হোসেন মার্কেটে অবস্থিত তোবা কারখানা থেকে আন্দোলনরত শ্রমিকরা এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বকেয়া বেতন, ওভারটাইমসহ ঈদ বোনাসের দাবিতে গত নয় দিন ধরে বাড্ডায় কারখানা ভবনে অনশন করছেন তোবা গ্রুপের ৫টি কারখানার শ্রমিকরা।
তোবা নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়েছে: বিজিএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এসএম মান্নান কচি অভিযোগ করেছেন, তোবা শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়েছে। এতে রাজনৈতিক নেতারা লাভবান হবেন; তোবার শ্রমিকরা নন। মঙ্গলবার তোবা গ্রুপের শ্রমিকদের বকেয়া পাওনাদির বিষয়ে বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও করে তোবা গ্রুপ শ্রমিক সংগ্রাম কমিটি। পরে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই অভিযোগ করেন। এ সময় তিনি আজ বুধবার বেতন নিতে অনশনরত শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিজিএমইএ কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয় যে তারা তোবার শ্রমিকদের বেতন প্রদান করবে। এটা শধুমাত্র সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তবে মানবিক কারণে সংগঠনটি বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে শ্রমিকদের দুই মাসের পাওনা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। শ্রমিকরা বেতন নেবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আজ পর্যন্ত অপেক্ষা করব। যদি শ্রমিকরা না আসে, সে ক্ষেত্রে বিজিএমইএ’র আর কিছু করার থাকবে না। তোবার শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি না করার জন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তোবা গার্মেন্ট নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়েছে। প্রত্যেকটা দল চাচ্ছে তাদের ক্রেডিট প্রদর্শন করতে। যদি শ্রমিকরা টাকা না নিয়ে রাজনীতি করে। তবে তাতে শুধু শ্রমিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে; রাজনীতিবিদরা নন। তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ারের জামিন নিয়ে তিনি বলেন, সে গ্রেপ্তারের কারণে কারখানায় অর্ডার ও ব্যাংক ঋণ কমে গেছে বলে জানান তিনি। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কারখানাটি চলতি বছরের জুন মাস থেকে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করছে। যে কারখানার মাধ্যমে ঋণ কিংবা এলসি করা হতো ব্যাংক শুধু ওই কারখানাটিতে বেতন দিয়েছে। ব্যাংক বাকি কারখানাগুলোর ঋণ দিতে চায়নি। সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতীকী অনশন: তোবা গার্মেন্টের কর্মীদের পাওনা পরিশোধ ও মালিকের জামিন বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রতীকী অনশন ও সংহতি সমাবেশ করেছেন। মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এ কর্মসূচি শুরু হয়। চলে বেলা ৩টা পর্যন্ত। কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ থেকে ৩৫ জন শিক্ষক। কর্মসূচিতে তোবাসহ অন্যান্য গার্মেন্ট কর্মীদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধে ৫ দফা দাবি তুলে ধরা হয় শিক্ষকদের পক্ষ থেকে। দাবিগুলো হলো- শ্রমিকদের পাওনা বেতন ভাতা পরিশোধ, বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, দেলোয়ারের জামিন বাতিল, তাজরীন শ্রমিকদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ এবং আন্দোলনরত শ্রমিকদের মানসিক ও শারীরিক ক্ষতিপূরণ।
তোবাকর্মীদের বেতন পরিশোধে কাজ করছে সরকার: তোবা গ্রুপের গার্মেন্ট শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক। মঙ্গলবার শ্রম মন্ত্রণালয়ে সভাকক্ষে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদের (স্কপ) নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠকে এ কথা জানান প্রতিমন্ত্রী। শ্রম প্রতিমন্ত্রী তোবা গ্রুপের গার্মেন্টের সকল বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধে স্কপ নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা কামনা করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার ও শ্রমিক নেতারা।
চলছে অনশন: বকেয়া বেতন-বোনাস ও ওভারটাইমের দাবিতে ১০ম দিনের মতো অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন তোবা গ্রুপের শ্রমিকেরা। রাজধানীর বাড্ডার হোসেন মার্কেটের সপ্তম তলার কারখানায় এ অনশন চলছে। তিন মাসের বকেয়া বেতন ও বোনাসের দাবিতে শ্রমিকেরা ঈদের আগের দিন সোমবার থেকে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
প্রসঙ্গত, মে-জুন ও জুলাই মাসের বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে তোবা গ্রুপের শ্রমিকরা গত ২৮শে জুলাই থেকে অনশন করছেন। সোমবার অষ্টম দিনে অসুস্থ শ্রমিকের সংখ্যা দুই শতাধিক ছাড়িয়েছে। তাদেরকে স্যালাইন ও ভিটামিন দেয়া হচ্ছে। তোবার ৫ কারখানার ১৬০০ শ্রমিক বকেয়া বেতন ও বোনাস বাবদ ৪ কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ১২৭ টাকা পাওনা রয়েছে।
কোন শ্রমিক বেতন না নিলে দায় নিবে না বিজিএমইএ
আজ বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে তোবার ৫ কারখানার কোন শ্রমিক মে ও জুন মাসের বকেয়া বেতন না নিলে তার দায় নিবে না পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ। গতকাল সংগঠনের পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, গত ৩রা আগস্ট বিজিএমইএ অফিসে সরকার, গার্মেন্ট শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ এবং বিজিএমইএ নেতাদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত ত্রি-পক্ষীয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ বুধবার বিজিএমইএ কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে তোবা গ্রুপের ৫টি কারখানা- তোবা ফ্যাশন লি., বুকশান গার্মেন্ট লি., তাইফ ফ্যাশন লি., তোবা টেক্সটাইল লি. এবং মিতা ডিজাইন লি. কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদেরকে মে ও জুন মাসের বকেয়া বেতন প্রদান করা হবে। অবশিষ্ট বকেয়া মজুরি কারখানা কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে পরিশোধ করবে। এ প্রেক্ষিতে তোবা গ্রুপের ৫টি কারখানার সকল শ্রমিক-কর্মচারীদেরকে আজ বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে উপস্থিত হয়ে বেতন গ্রহণের জন্য বিজ্ঞপ্তিতে অনুরোধ জানায় বিজিএমইএ। উল্লেখ্য, তোবা গ্রুপের কোন শ্রমিক-কর্মচারী কোন কারণে মে ও জুন মাসের বকেয়া বেতন গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময়ে বিজিএমইএ অফিসে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে তার কোন দায় বিজিএমইএ’র ওপর বর্তাবে না।
তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার কারামুক্ত
তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির মামলায় জামিন পাওয়ার পর কারাগার থেকেও ছাড়া পেয়েছেন তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেন। হাইকোর্ট থেকে পাওয়া জামিন আদেশের কাগজপত্র আসার পর গতকাল রাত ৮টায় দেলোয়ারকে মুক্তি দেয়া হয় বলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুর রহমান নিশ্চিত করেছেন। এর আগে বেতনের দাবিতে তোবা গ্রুপের ৫ কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে ঈদের আগে ২৪শে জুলাই হাইকোর্ট থেকে জামিন পান দেলোয়ার। অভিযোগ রয়েছে জামিনে মুক্তি পেতে শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে তাদের আন্দোলনে নামানো হয়। বেতন-ভাতা না পাওয়ায় ঈদের আগে থেকে অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন তোবার শ্রমিকরা।