শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

স্মৃতিবিজড়িত মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি দিনের স্মৃতিকথা

index1

মেজর মোহাম্মদ মোস্তফার (অবঃ)বিএসএস-৭০৫ ঃ

১। ভয়াল মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলির-১ম দিন (একটি শোকাহত স্বরনীয় ঘটনা)-
১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ- যশোর সেনানিবাসে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (সিনিয়ার টাইগার) হতে বিদ্রোহ করে প্রাণে বেচে সম্মুুখ মুক্তিযুদ্ধ শুরু করি। যশোর সেনানিবাসে ১০৭ পদাতিক ব্রিগেডের অধীনে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল সহ পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার র্ফোস এবং বেলুচ রেজিমেন্টের দুইটি ব্যাটালিয়ান ছিল আরো ছিল আটিলারি, ইঞ্জিনিয়ার্স, সিগনাল ই-এম-ই, ফিল্ড এম্বুলেন্স, সাপ্লাই ও সিএমএইচ সহ অনেক ইউনিট। এই সকল ইউনিট বাঙ্গালি সৈনিকে ভরপুর ছিল। ১ম ইষ্ট বেঙ্গলে (সিনিয়ার টাইগার) শতভাগ বাঙ্গালি সৈনিক ছিল। ব্যাটালিয়ান কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লেঃ কর্ণেল রেজাউল জলিল তিনি ছিলেন সিলেট জেলার অধিবাসী। সিনিয়র টাইগার্স ১টি ঐতিহ্যবাহি ব্যটালিয়ান। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে শিয়ালকোটের খেমকানন সেক্টরে রয়েছে এই ব্যাটালিয়ানের বীরত্বগাথা যুদ্ধের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে দেশের জনসাধারন যখন উত্তাল তখনই ১০৭ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ডুররানি (পাঞ্জাবী) ভয়ে এবং কৌশলগত দিক বিবেচনা করে আমাদের এই সিনিয়র টাইগার্সকে যশোর সেনানিবাসের অধুরে চৌগাছা এলাকায় প্রশিক্ষনের ভান করে সেনানিবাসের বাহিরে থাকতে বাধ্য করেন। ২৬-২৯ই মার্চ পর্যন্ত দেশব্যাপী সকল সেনানিবাসে, ই পি আর, পুলিশ ও জনসাধারনের উপর পাক বাহিনীর বর্বর আক্রমনের শিকার হয়ে বাঙ্গালীগন বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতে বাধ্য হয়। চৌগাছাতে থাকা সিনিয়র টাইগার্সের সকল সৈন্য নিরাপদে বিদ্রোহ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিল। লেঃ কর্ণেল রেজাউল জলিল ২৯ই মার্চ ব্যাটালিয়নকে সেনানিবাসে ফেরত আনেন। তিনি পরের দিন ৩০শে মার্চ ১৯৭১ইং ছুটি ও মেইনটেনেন্স ডে ঘোষনা করেন। ঐ দিন সকাল ১০ ঘটিকার সময় ব্রিগেড কমান্ডার ডুররানি সহ আরো কয়েকজন ব্রিগেডের ষ্টাফ অফিসারসহ সিনিয়ার টাইগার্সের কমান্ডিং অফিসারের অফিসে এসে সভা ও কথপোকথনকালে ব্যাটালিয়ানের সকল বাঙ্গালী জুনিয়ার অফিসার ও নন কমিশন অফিসারগন অফিস এলাকাতে হাজির হয়ে কি ঘটছে এবং ঘটতে যাচ্ছে তা অতিব সতর্ক অবস্থায় পর্যবেক্ষন ও অবলোকন করতে থাকেন। ব্রিগেড কমান্ডারের সাথে প্রায় ১ ঘন্টা সভা ও কথোপকথনের পরে লেঃ কর্ণেল রোজাউল জলিল ব্যাটালিয়ানের সুবেদার মেজর (বিহারী) এর মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের গুদামগুলির সকল চাবিগুলো এনে ব্রিগেড কমান্ডারের হাতে তুলে দিলেন। এই খবর শুনার পর সকল পদবীর সৈনিকগন যে যেই অবস্থায় ছিলেন সে অবস্থান থেকে ভেংগুলের মত উড়াল দিয়ে গোলাবারুদ ও অস্ত্রগার গুদাম ভেঙ্গে নিজ নিজ হাতে রাইফেল, এসএমজি ও এলএমজিসহ প্রয়োজনীয় গুলি বের করে ব্যাটালিয়ান এলাকায় পজিশান নিয়ে পাকবাহিনীর সাথে খন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হন। অস্ত্রাগার ভাঙ্গার মুহুর্তে পূর্বের তাক করা বেলুছ ও ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের হেভি মেশিন গানের গুলি ও মর্টারের গোলা অনবরত ব্যাটালিয়ানের অবস্থান ও বিদ্রোহীদের উপর পড়তে থাকে। প্রায় তিন ঘন্টার খন্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। দুই দিক থেকে বৃষ্টির মত গুলি আসতে থাকে পাকবাহিনীর এফ এফ এবং বেলুচ রেজিমেন্টের তাক করা অস্ত্র থেকে। অনেক হতাহত হয়। অগনিত বাঙ্গালি সৈনিক বন্দী হয়ে হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। আমি, ক্যাপ্টেন হাফিজ (বর্তমানে মেজর হাফিজ, সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান) এবং অনেক বাঙ্গালি সৈন্য প্রানে রক্ষা পেয়ে মহান আল্লাহ তা’আলার কৃপায় যশোর সেনানিবাসের উত্তর পার্শ্বের বিশাল খিতুবদিয়া মাঠ/বিল দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে সর্বশেষে ঐ রাত্রে বনগাঁওর উল্টোদিকে মাসলিয়া বিওপিতে পৌছি। লেঃ আনোয়ার পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। আমাদের ব্যাটালিয়ানের সৈনিকসহ যশোর সেনানিবাসে প্রায় ১৩০০ মত বাঙ্গালি সৈনিক ছিল (সকল পদবির)। এই সংখ্যার মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশ হয়তো বের হতে পেরেছিল। আর সবাই পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বন্দি হয়ে হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন। লেঃ কর্ণেল রেজাউল জলিল এর জঘন্নতম ভুল ও লোভ লালসার কারনে মহা সুবর্ণ সুযোগের সৎ ব্যবহার না করে তার অধীনস্থ এবং যশোর সেনানিবাসের সকল বাঙ্গালী সৈনিকদেরকে জীবননাশ ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে ফেলে দেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য এই প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত বাঙ্গালী অফিসার ও সৈনিকগন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহনের সুযোগ থেকেও তিনি (লেঃ কর্ণেল রেজাউল জলিল) বঞ্চিত করেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠটি তাকে বহুবার শোনানো হয়েছে। ইতোমধ্যে মেজর ওছমানের নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনী এবং জনসাধারন কুষ্টিয়াতে অবস্থানরত পাঠান ও পাঞ্জাবীদের বেলুচ রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানীর সকল পদবীর সৈনিকগনকে মেরে ফেলা হয়েছে। মেজর ওছমান, অনেক বাঙ্গালী পদস্থ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এবং যশোরের কিছু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বারংবার লেঃ কর্ণেল রেজাউল জলিল-কে অনুরোধ করেছিলেন ব্যাটালিয়ানকে সেনানিবাসের ভিতরে প্রবেশ না করিয়ে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন, বাঙ্গালী সৈনিকদেরকে প্রানে রক্ষা করিয়ে পাকিস্তানিদেরকে প্রতিহত করার জন্য ইহা ছিল তাঁর জন্য একটি পবিত্র দায়িত্ব এবং ব্যাটালিয়নের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু মহা দুঃখের বিষয় তিনি তা গ্রহন করেননি। ঐ সেনানিবাসের মধ্যে অন্যান্য সকল ইউনিটের বাঙ্গালি অফিসার ও সৈনিকগন শুধু তার সিদ্ধান্তের দিকে তীর্থের কাকের মত চেয়েছিলেন। সেনা ছাউনিতে ফিরে গিয়ে অস্ত্রাগার ও গোলাবারুদের চাবি পাঞ্জাবী ব্রির্গেড কমান্ডারের নিকট জমা দেওয়ার পর অগত্যা দিশেহারা হয়ে অগোছালো ও পরিকল্পনাহীনভাবে নিজ নিজ উদ্যোগে প্রাণে বাঁচার তাগিদে সিনিয়র টাইগার্সের সৈনিকগন ঐ দিন (৩০শে মার্চ ১৯৭১) অস্ত্রের গুদাম ভেঙ্গে লুট করে যুদ্ধ শুরু করার পরেও আমি ব্যক্তিগতভাবে সেনানিবাস থেকে পালানোর সময় অনুনয় বিনয় করে বলি যে আমরা পালিয়ে জীবন বাঁচাই। তিনি উত্তরে বললেন যে তোমরা যাও, যা ইচ্ছা তাই করো কিন্তু তিনি পালিয়ে যাবেন না। এমতাবস্থায় ঐ সেনানিবাসে অন্যান্য ইউনিটগুলোর অগনিত বহু বাঙ্গালি সৈনিক এবং অফিসারগন পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হয়ে হত্যার শিকার হয়েছিল।

hWwS5FA
২। মাচলিয়া বিওপি ক্যাম্প থেকে বর্বর হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা-এপ্রিল ১৯৭১ ইং এর ১ম এবং ২য় সপ্তাহে যশোরের চৌগাছা এবং তার পার্শ্ববর্তী প্রধান সড়কগুলো যেমন-যশোর থেকে ঝিনাইদাহ, চৌগাছা থেকে জীবন নগর রাস্তাগুলোতে আমরা ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে পাক সেনাদের গতি প্রতিরোধ করি এবং অনেক জায়গায় সম্মুখ যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমাদের সাথে স্থানীয় জনসাধারণ অকুতোভয়ে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন। নিজ ভূখন্ডে স্বীয় অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হওয়ায় ভারতীয় বিএসএফ এর সহযোগীতায় ভারতের বনগাও এলাকায় প্রবেশ করে পুনরায় নিজেদেরকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে নিয়মিত বাহিনীতে পরিবর্তিত হয়ে পাক সেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যশোর সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে খন্ড ও গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে পদোন্নতি লাভ করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষে ক্যাডেট হিসেবে ভারতের মুর্তি নামক একটি সেনানিবাসে প্রশিক্ষন শেষে ৯ই অক্টোবর ১৯৭১ ইং প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স এ কমিশন প্রাপ্ত হয়ে ৮ নং সেক্টরে যোগদান করি। পরবর্তীতে সাব-সেক্টর বানপুরে আমার পোষ্টিং হয়। এই স্থান থেকে পূনরায় শুরু হয় আমার মুক্তিযুদ্ধে স্বক্রিয় অংশগ্রহন ও নেতৃত্ব।

index_941833225

৩। জীবন বাজি রেখে শত্রুর আস্তানায় ঃ ৮ নং সেক্টরের অধীনে সাব-সেক্টর বানপুর ক্যাম্প থেকে ঘোগা বিওপি হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জীবন নগর এলাকায় কলা বিক্রেতা সেজে পাক বাহিনীর অবস্থান নির্ণয় ও পর্যবেক্ষন- ৮ নং সেক্টর কমান্ডারের ৩টি নির্দেশ ছিল আমার প্রতি। (ক) জীবন নগর বর্ডার এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমনের প্রস্তুতির লক্ষে ভিতরে প্রবেশ করে শত্রুর প্রকৃত অবস্থান, শক্তি ও সংখ্যা নির্ণয় করা। (খ) নিজস্ব সেনা শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পথ নির্ণয় করা। (গ) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলাসহ আশপাশ এলাকাসমুহে গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করা। উদ্দেশ্যসমূূহকে মাথায় রেখে ১৮ই অক্টোবর ১৯৭১ ইং তারিখে দুইজন সাহায্যকারী সহযোদ্ধা গাইডসহ সন্ধাবেলা পায়ে হেটে পথচলা শুরু করি। রাত ১২টায় ঘোগা নামক বিওপি এলাকার পাশ দিয়ে বর্ডার পার হয়ে প্রায় ৫০০ গজ ভিতরে প্রবেশের পথে একটি কালভার্টে পাহারারত ২জন পোশাকধারী অস্ত্রবিহীন শান্তিবাহিনীর মুখোমুখী হই। আমাদের পরনে ছিল লুঙ্গি, গামছা এবং বেশভূষণ ছিল অনেকটা কৃষক/মজদুরের মতন। আমাদেরকে দেখে তারা চিৎকার করে বাঁশি বাজানো শুরু করলে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিলে উভয়ে ভয়ে পালিয়ে যায়। আমরা ঐ পথে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ভোর ৫টায় সহযোদ্ধা গাইডের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিই। ইহা জীবননগর থানার অর্ন্তগত একটি প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন গ্রাম। পরের দিনগুলোতে ঐ এলাকায় জনৈক বৃদ্ধ লোকের সাহায্য নিয়ে জীবননগর থানা সদর বর্ডার এলাকায় ফেরিওয়ালার খোঁজে বের হই। অবশেষে এক বৃদ্ধ কলা বিক্রেতার সাহায্যকারী সেজে তাকে কলা ব্যবসার জন্য ২০০ টাকা পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করি এবং তার সাহায্যকারী হিসেবে দুুই ছড়া কলা ১টি বাঁশের দুই মাথায় বেঁধে কাঁদে নিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রধান সড়ক ও বাজার এলাকায় নিয়ে ফেরী করি। পর পর তিন দিন এভাবে ফেরীওয়ালার বেশে পাক সেনাদের অবস্থান ও চলাচল স্বচক্ষে অবলোকন ও পর্যবেক্ষন করি। ৪র্থ দিন দিবাগত রাতে পুনরায় পায়ে হেটে বর্ডার পার হয়ে ভারতের বানপুর ক্যাম্পে ফেরত আসি। উক্ত ৪ দিনের প্রতি রাতই আমাদেরকে থাকার স্থান অনবরত পরিবর্তন করতে হয়েছিল। ভারতে ফেরত গিয়ে আমার সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান (পরে সেনাপ্রধান) এবং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ মঞ্জুর-কে (পরে মেজর জেনারেল) বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি।

index22

৪। ঝিনাইদাহ ও মাগুরা জেলায় গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা ঃ গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষে পুুনরায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ, গেরিলা যুুদ্ধ পরিচালনা ও অংশগ্রহন- সেক্টর কমান্ডার থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নিয়ে আমি এবং ক্যাপ্টেন ওহাব, ইএমই (পরে মেজর জেনারেল) সহ দুই প্লাটুন সেনা ও নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধার দল নিয়ে ঘোগা এলাকা দিয়ে বর্ডার পার হয়ে ৪দিন ও ৪রাত পায়ে হেটে অক্টোবর ১৯৭১ ইং এর ৪র্থ সপ্তাহে কোর্ট চানপুর, হরিনাকুন্ড, ঝিনাইদাহ এবং শৈলকুপা পার হয়ে মাগুরা জেলার অর্ন্তগত কামান্না গ্রামে পৌছি। প্রত্যেকের মাথায় ও পিঠে গুলি সহ নিজস্ব অস্ত্র, রকেট ল্যান্সারের গোলা, ব্রিজ ধ্বংসের বারুধ, গাড়ি ধ্বংসের এন্টি ট্যাংক মাইন ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ বহন করে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ঐ স্থানে পৌছি। পুরো নভেম্বর মাস এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর যুদ্ধ ঘোষনার পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময় আশপাশ এলাকাগুলোতে আমার নেতৃত্বে, দিক-নির্দেশনা এবং অংশগ্রহনে পাক সেনাবাহিনী ও তাদের পোষ্য রাজাকার, মুজাহিদ, শান্তিবাহিনীর উপর আক্রমন করে প্রচুর ক্ষতিসাধন ও মনোবল নষ্ট করি যা সংক্ষেপে নি¤œরুপঃ-
(ক) ঝিনাইদহ হইতে মাগুরা জেলা শহরের মধ্যবর্তী প্রধান সড়কে পাকসেনাদের গাড়িবহরে বহুবার অতর্র্কিত হামলা। তিনটি ব্রিজ ও এন্টি ট্যাংক মাইন পুঁতে অসংখ্য গাড়ি ধ্বংস।
(খ) ঝিনাইদাহ হইতে শৈলকুপা থানার প্রধান সড়কে গাড়ি চলাচলে বাঁধার সৃৃষ্টি ও আক্রমন।
(গ) শৈলকুপা থানা হেডকোয়ার্টারে অবস্থানকৃত মিলিশিয়া ও রাজাকার ক্যাম্পে হামলা, ধ্বংস ও দখল।
(ঘ) মাগুরার শ্রিপুর থানা হেডকোয়ার্টারে অবস্থানকৃত মিলিশিয়া ও রাজাকার ক্যাম্পে অতর্র্কিত হামলা, দখল এবং বিতাড়িত করা।
(ঙ) শৈলকুপা থেকে লাংগলবান্দ হয়ে কামারখালী ঘাট রাস্তায় পাকবাহিনীর চলাচলে অতর্র্কিত হামলা ও বাঁধা প্রদান।
(চ) মধুমতি নদী পার হয়ে রাজবাড়ি জেলার অর্ন্তগত পাংশা থানায় অবস্থিত রাজাকার ও মিলিশিয়া ক্যাম্পে অতর্কৃত হামলা, দখল ও বিতাড়িত করি।
(ছ) আত্মরক্ষার্থে প্রতিনিয়ত নিজেদের অবস্থান বা হাইড আউট পরিবর্তন করি।

index3

৫। মাগুরা জেলার কামান্নায় এক হৃদয় বিদারক ঘটনার বর্র্ণনা- গেরিলাযুদ্ধ হচ্ছে জনসাধারনের কাতারে মিশে গিয়ে, প্রতিনিয়ত হাইড আউট পরিবর্তন করে হিট এন্ড রান পদ্ধতিতে শত্রুর উপর আক্রমন, ক্ষতিসাধন, ব্রিজ/কালভার্ট ধ্বংস, শত্রুর চলাচলের রাস্তাগুলো বিচ্ছিন্ন করা এবং শত্রুর অবস্থান ও চলাচলকে শংকিত ও আতংকিত করে রাখা ইত্যাদি। পুরো নভেম্বর মাসব্যাপী জীবনবাজি রেখে এই কাজগুলো সফলতার সহিত করলেও কামান্নার হৃদয় বিদারক ঘটনাটি যখন মনে পড়ে তখন বুক ভরা দুঃখ নিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি।

ঘটনাটি হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের চাকুলিয়া প্রশিক্ষন কেন্দ্র থেকে গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষন প্রাপ্ত হয়ে ৮ নং সেক্টরের ঘোগা বিওপি এলাকা দিয়ে বর্ডার ক্রস করে সুদীর্ঘ প্রায় ১৫০ কি.মি পথ পায়ে হেটে ২৯ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কামান্না গ্রামে এসে আমাদের হাইড আউটে হাজির হলেন। তারা মাদারিপুর এলাকার লোক এবং সেই এলাকাতে গিয়ে গেরিলাযুদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্যে। তারা অতীব ক্ষুদার্ত, ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। রাতে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করি। বিশাল বাঁশ ঝাড় সম্বলিত হাইড আউট এর স্থানটি ছিল পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়ি যারা বাড়ি ঘর ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল। এই হাইড আউটের রাতটি ছিল আমাদের তৃতীয় রাত। কনকনে শীত অনুভূত হলেও হাইড আউট এর চারদিকে প্রহরীর ব্যবস্থা করি। রাতের খাওয়ার পর ধানগাছের খড় বিছিয়ে সকলেই ঘুমিয়ে পড়ে। কামান্নার পশ্চিম পাশেই অবস্থিত কুমারিয়া নদী। রাত ১টার দিকে কুমারিয়া নদীর পশ্চিমের গ্রাম থেকে আমাদের সাহায্যকারী এক লোক এসে বললেন যে স্যার “শীত পড়ছে, আমার বাড়িতে কাঁথার ব্যবস্থা করব, আমার সাথে চলুন”। অগ্যতা দুই সহযোদ্ধাসহ তার সাথে গিয়ে তার বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরের দিকে হঠাৎ অসংখ্যগুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙ্গলে জেগে দেখি আশপাশের লোকজন ভয়ে ছোটাছুটি করে আত্মরক্ষার জন্য দিক-বেদিক পালিয়ে যাচ্ছে। আমি প্রথমে মাটিতে শুয়ে গুলির শব্দের দিক নির্নয়ের চেষ্টা করি। গুলির শব্দ বন্ধ হলে পুর্ব দিকে ফসলি জমির আইল ধরে এবং ফসলের মধ্যে দিয়ে সহযোদ্ধাগণসহ লুকিয়ে অগ্রসর হতে থাকি। এভাবে কুমারিয়া নদী পার হয়ে সেই হাইড আউট এর হিন্দু এলাকার স্থানটিতে এসে দেখি সব লাশগুলো ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। রাত্রিবেলায় যাদেরকে রেখে গিয়েছিলাম তারা সকলেই মৃত। মাগুরা জেলার স্থানীয় রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর সাহায্য নিয়ে জেলা শহর থেকে পাক সেনার একটি দল ভোরের আলোতে উক্ত বাড়ীতে এসে গুলি করে প্রত্যেক প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত এই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হত্যা করে। তখন থেকে ইহার সমুচিত জবাব ও প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্পে দৃৃঢ় হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকি।

index4

৬। ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে মধুমতি নদী পার করার সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং আক্রমনে অংশগ্রহনঃ
যুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে বিজয়ের ঊষালগ্নে ভারতীয় মিত্র শক্তির সাথে কাঁেধ কাধঁ মিলিয়ে তাদের অগ্রযাত্রায় আমি এবং আমার গেরিলা ফোর্স অগ্রগামী ও সহযাত্রী গাইড হিসাবে মাগুরা থেকে ফরিদপুর মেইন রোড ধরে অফাধহপব ঃড় পড়হঃধপঃ ঢ়যধপব ড়ভ ধিৎ এ অবতীর্ন হই। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চৌগাছা হয়ে কালিগঞ্জ ও ঝিনাইদাহর প্রধান সড়ক হয়ে মাগুরা জেলা সদর এলাকায় পৌছার পূর্বে ৯ই ডিসেম্বর পাক সেনাগন মাগুরা ত্যাগ করে মধুমতি নদীর কামারখালি ঘাট পার হয়ে পুর্ব তীরে গিয়ে শক্ত ডিফেন্স (প্রতিরক্ষা বুহ্য) গড়ে তুলে। ঘাট পার হওয়ার সময় কামারখালি ঘাটের ফেরিগুলো ডুবিয়ে দেয়। ভারতীয় মিত্র বাহিনী ৯ই ডিসেম্বর মাগুরা শহরে পৌছে এবং মধুমতি নদীর পশ্চিম তীরে কৌশলগত স্থানে অবস্থান নিয়ে ১১ ও ১২ই ডিসেম্বর অনবরত দিনে/রাত্রে খড়হম ৎধহমব সড়ৎঃবৎ ংযবষষ ও আর্টিলারি কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। তার পূর্বে ৯ই ডিসেম্বর মাগুরা শহরে ওয়াপদার গুদামে রক্ষিত পাক বাহিনীর পেট্রোল ডিপোটি মিত্র বাহিনীর বিমান হামলার ব্যবস্থা করে পুড়িয়ে ও উড়িয়ে দিয়েছিলাম। উভয় পক্ষের সেই এক তুমুল স্থল ও আকাশ যুদ্ধের গোলা বিনিময় অবলোকন এবং নিজেদেরকে আত্বরক্ষার চেষ্টা করি। মিত্র বাহিনীর ১টি ডিভিশন এই এক্সিসে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে চলতে থাকে। সামনে মধুমতি নদী এখন বড় বাধা। ইহা একটি খরস্রোতা এবং বেশ চওড়া নদী যা ফেরি বা নৌকা দিয়ে পার হতে হয়। এই নদী দিয়ে লঞ্চ ও মালবাহী টাগ চলাচল করে। ১০ই ডিসেম্বর থেকে নিদ্রা ও বিশ্রামহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। সাথে রাখা কিছু চিড়া ও গুড় ছাড়া খাওয়ার কিছুই ছিলনা। ১০ থেকে ১২ইং ডিসেম্বর পর্যন্ত হেভি আর্মস, মর্টার, কামান ও যুদ্ধ বিমানের গোলা নিক্ষিপ্ত হয় মধুমতি নদীর উভয় তীরে অবস্থানরত পাক বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর কৌশলগত অবস্থান লক্ষ্য করে। সাথে সাথে প্রস্তুতি চলছে মধুমতি নদী পার হওয়ার। মিত্র বাহিনীর একটি ডিভিশনের দুইটি ব্রিগেড নদী পার হতে নির্দেশ পেলো। একটি ব্রিগেড কামারখালি ঘাট থেকে প্রায় দুই মাইল উত্তর দিক দিয়ে এবং অন্য ব্রিগেড কামারখালি ঘাট থেকে দুই মাইল দক্ষিন দিক দিয়ে। উত্তর দিকের ব্রিগেডের লিডিং ব্যাটালিয়ানের সাথে আমি আমার ফোর্স সহ গাইড হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। যুদ্ধের সরঞ্জামসহ একটি ব্রিগেড ফোর্স এবং আমার গেরিলা বাহিনীকে মধুমতি নদী পার করা ছিল একটি কঠিন ব্যবস্থাপনা এবং জীবন-মরনের ঝুঁকি। মিত্র বাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী আমি ১১ ও ১২ ইং ডিসেম্বর প্রায় ৫০ টি বড়-ছোট দেশীয় নৌকা যোগান দিই। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১২ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে নদী পার হওয়ার ডি-ডে হিসেবে রাত ১টা থেকে নদী পার হওয়া শুরু করি। মিত্র শক্তির লিডিং ব্যাটালিয়ানের পেছনে এক স্কোয়াড্রন ট্যাংক সহ নদী পার হওয়ার পথ নির্ণয় করা হলো। এই নদী পার হওয়ার সময় আর্টিলারী ফায়ারের কভারেজ চলছে। কামানের গোলার শব্দে কান ঝাঝরা হয়ে যাচ্ছিল। নদী পার হয়ে ১৩ই ডিসেম্বর সকাল বেলা ক্রস কান্ট্রি হেটে (শষ্যের মাঠ দিয়ে) মধুখালি সুগার মিল এলাকাকে টার্গেট করে মিত্র বাহিনীর লিডিং ব্যাটালিয়ানের সাথে অফাধহপব ঃড় পড়হঃধপঃ ঢ়যধপব ড়ভ ধিৎ শুরু করি। আনুমানিক সকাল ৮ঘটিকার সময় শত্রুর সাক্ষাতে আক্রমন ও পাল্টা আক্রমন শুরু হয়। শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষা বাংকার থেকে হেভী মেশিন গানের ফায়ারিং এর মধ্যে আমরা আক্রান্ত হই। এই অবস্থায় মিত্র বাহিনীর লিডিং ব্যটালিয়ানের লিডিং কোম্পানির বেশ কিছু সৈনিক হতাহত হয়। আমরা জমিতে পজিশান নিলাম। রি-গ্রুপিং ও রি-অর্গানাইজ করে আর্টিলারী কামানের ফায়ারিং কভারেজ নিয়ে শত্রুপক্ষের উপর হেস্টি-এ্যাটাক পরিচালনা করি। এই ঘটনায়ও আমাদেরকে ব্যাপক হতাহতের শিকার হতে হয়। ১৪ই ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে মিত্র বাহিনীর অন্য আর একটি ব্যটালিয়ান নদী পার হয়ে একটি ট্যাংক স্কোয়াড্রনসহ পুনরায় অফাধহপব ঃড় পড়হঃধপঃ ঢ়যধপব ড়ভ ধিৎ শুরু করি। এভাবে মধুখালি সুগার মিলের নিকটে পৌছালে পুনরায় শত্রুর সাথে সাক্ষাত হয় এবং এ অগ্রগামী ব্যাটালিয়ান হেস্টি (ঐধংঃু) এ্যাটাক পরিচালনা করেন। শত্রু পক্ষ পিছুহটে মধুখালি চিনি কল এলাকাতে পুনঃরায় প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও আমাদের আক্রমনে টিকতে না পেরে ক্রমাগত ফরিদপুর শহরের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। ফরিদপুর যাওয়ার প্রধান সড়কে বেলা ৩টা নাগাদ আমরা উঠে পড়ি। শত্রু পক্ষের ল্যান্ড ফোনের ফেলে যাওয়া তার ও ওয়ারলেস সেট এর সংওযাগগুলোর মাধ্যমে আমরা মিত্র বাহিনীর ব্রির্গেড কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করি। যাওয়ার পথে রাস্তায় হাজার হাজার গুলি পড়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পাই। শত্রুপক্ষ পিছু হঠতে থাকে এবং আমরা সামনে এগুতে থাকি। অনেক লম্বা কথোপকথন ও তর্ক/বির্তকের পর পাক বাহিনীর জেনারেল আনছারি আত্মসমর্পনে রাজি হয়ে বললেন যে মিত্র বাহিনীর কোর কমান্ডারের নিকট আত্মসমর্পন করবেন। কিন্তু মিত্র বাহিনী এতে রাজি না হওয়ায় সর্বশেষ ব্রির্গেড কমান্ডার এর নিকট আত্মসমর্পন করার ইচ্ছা পোষন করেন। এই রকম পরিস্থিতিতে ও বিতর্কে বিকেল ৪ টা বেজে গেলো। মিত্র বাহিনীর ব্রিগের্ড কমান্ডারের সাথে আমি সবকিছু প্রত্যক্ষ করছিলাম। এক পর্যায়ে পাক বাহিনীর জেনারেল আনছারিকে আল্টিমেটাম দেওয়া হল যে মিত্র বাহিনীর লিডিং ব্রিগেড কমান্ডারের নিকট আত্বসমর্পন করুন অন্যথায় লড়াই করে আপনাকে আত্মসমর্পন করাতে বাধ্য করা হবে। তখন বেলা প্রায় ৪ ঘটিকা। এমতাবস্থায় আমি আমার ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের (পরবর্তিতে মেজর জেনারেল) সাথে যোগাযোগ করে সার্বিক অবস্থা ব্রিফ করি এবং পাক বাহিনীর পরাজিত জেনারেল আনছারিকে মুক্তি র্ফোস কমান্ডারের নিকট আত্মসমর্পন করার প্রস্তাব করি। তিনি (আমার সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর) সবকিছু ভেবে চিন্তে ও মিত্র বাহিনীর সাথে আলোচনা করে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত দেন যে জেনারেল আনছারি মুক্তি ফোর্স কমান্ডারের নিকট তথা মিত্র বাহিনীর লিডিং ব্রিগেডের সাথে থাকা মুক্তি ফোর্স কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ মোস্তফার নিকট আত্মসমর্পন করবেন। কিন্তু জেনারেল আনছারি বাঁধ সাধল সে মুক্তি ফোর্স কমান্ডারের নিকট মোটেই আত্মসমর্পন করবেননা। পরে মিত্র বাহিনীর নিকট আকুতি মিনতি করে অনুরোধ করলেন যে কমপক্ষে মিত্র বাহিনীর ব্রিগের্ড কমান্ডার এবং সর্বশেষে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদবীর যে কোন অফিসার ফরিদপুর সার্কিট হাউজে পাঠানোর জন্য। এতে আমার সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর রাজি না হয়ে পূর্র্বের সিদ্ধান্তে অটল থেকে আমার নিকট জেনারেল আনছারির আত্মসমর্পনের প্রত্যয় ব্যাক্ত করেন। সর্বশেষ ইহাই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসাবে বলবৎ রহিল। আমি ৪/৫ দিনের নির্ঘুম অবস্থায় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় দুইজন গেরিলা সহযোদ্ধাসহ মধুখালি সুগার মিলের ১ টি জিপ গাড়ি ও ১জন ড্রাইভার যোগাড় করে গাড়ীতে বড় ১টি সাদা কাপড়ের পতাকা বেধেঁ বেলা ৪.৩০টার সময় মধুখালি সুগার মিল থেকে ফরিদপুর শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে বিকাল ৫টার দিকে ফরিদপুর সার্কিট হাউজের সামনে পুলিশ লাইন মাঠে পৌছাই। এই সুদীর্ঘ পথে শতশত ল্যান্ড টেলিফোন লাইন হাজার হাজার গুলি, বোমা, শতশত পাকসেনা ও অফিসারগন রাস্তার দুই পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখি। জেনারেল আনছারি আমাকে স্বাগত জানিয়ে তার সকল কমান্ডার সহ বিকেল প্রায় ৫.৩০ টার সময় আত্মসমর্পন সম্পর্র্ণ করেন।

index5
৭। ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন(কাঙ্খিত মহান বিজয়ক্ষণ) যদিও ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাক বাহিনী চুড়ান্ত আত্মসমর্পন করেন কিন্তু ঐতিহাসিক বাংলাদেশের দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলের পাক সেনাবাহিনীর জিওসি জেনারেল আনসারী ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ ইং তারিখে তার সকল কমান্ডারগনসহ ফরিদপুর শহরের পুলিশ লাইন মাঠে আমার নিকট আত্মসমর্পন করেন। এই কারনে ঐ দিনটি (১৪ই ডিসেম্বর) আমার মনের কোঠায় এক অবিস্বরনীয় আনন্দ ও বিজয় উল্লাসের দিন হিসেবে আমৃৃতু্যু স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ এক ঐতিহাসিক অমৃৃত স্বাদ আস্বাদনের দিন, এক বুক বিজয় বাতাস প্রাণভরে গ্রহণের দিন, পাকবাহিনীর অবনত মস্তক দেখার ক্ষণ যা সহজে ভূূলবার নয়। জেনারেল আনছারি ১ম সাক্ষাতে আমাকে দেখে বললেন “ইড়ু, ুড়ঁ ভধঁমযঃ বিষষ, বিষষ ফড়হব” উত্তরে ইংরেজিতে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে তাদেরকে আমার সাথে কামারখালী ঘাটে যাওয়ার নির্দেশ দিই। তারা আমার সাথে কামারখালি ঘাটে আসার অপারগতা প্রকাশ করে, পরের দিন সকালে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। আমি বারংবার বলার পরেও তারা যেতে রাজি না হয়ে উল্টো আমাকে তাদের সাথে রাত কাটানোর অনুরোধ করেন। যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার এই ঊষালগ্নে তাদের সাথে আমার রাত কাটানো চরম ঝুঁকিপূর্ন ছাড়া আর কিছুইনা। এ ধরনের কোন ঝুঁকি নিতে আমার মন কোনভাবে সায় দিচ্ছিলনা। আমি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম। তিনি বারংবার আমাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে যদি কিছু ঘটে তাহলে তার পুরো দায়-দায়িত্ব তিনি বহন করবেন। বিষয়টি আমার সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরকে এবং মিত্র বাহিনীর ফোর্স কমান্ডারকে অবগত করলাম। তাদের সাথে জেনারেল আনছারির কথোপকথন হলো। বিগত ৫দিনের নিদ্রাহীন ক্লান্ত, শ্রান্ত ও অভুক্ত শরীর নিয়ে অগত্যা বাড়াবাড়ি না করে তাদের সাথে ফরিদপুর সার্কিট হাউজে রাত্রি যাপনে রাজি হলাম। তারপরও মনের মধ্যে সবর্দা একটাই ভয় কাজ করল এই ভেবে যে ৯ মাস যুদ্ধ করার পর বিজয়ের এই রাতে যদি কোন বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত পাক সেনা বা অফিসারের হাতে মৃৃতু্যুর দামামা বেজে উঠে তাহলে মরেও শান্তি পাবনা। তারপরও আল্লাহকে একমাত্র সহায় করে দরজা জানালা ভালোভাবে বন্ধ করে দুই সহযোদ্ধাসহ শুয়ে পরলাম। ৫ দিন যাবত মরণপন সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাদের আতিথেয়তায ভাল খাওয়ার খেয়ে সার্কিট হাউজের বিছানায় পিঠ লাগিয়ে আরামের স্বাদ গ্রহন করাটাও ছিল আমার কাছে একটি স্বরণীয় বিষয়। সার্কিট হাউসের ল্যান্ড ফোন দিয়ে ইতিপূর্বে ফরিদপুরের ডিসি ও এসপিকে নির্দেশ দিলাম যে এই জেলার সম্ভাব্য সকল স্থানে মাইক দিয়ে ঘোষনা করুন যে পশ্চিম অঞ্চলের পাক বাহিনী আত্মসর্মপন করেছে। সুতরাং এখন থেকে যুদ্ধ ও হানাহানি বন্ধ এবং ঈবধংবভরৎব অবলম্বন করার জন্য।
জেনারেল আনছারি ঐ ব্যক্তি যিনি ২৬শে মার্চ ১৯৭১-এ চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ব্রিগেডিয়ার পদবীতে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে বাঙ্গালি ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার (সিলেট নিবাসী) সেন্টার কমান্ডেন্ট এর স্থলাবিসিক্ত হয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাস ও শহরে নিরীহ বাঙ্গালি অফিসার, সৈনিক ও জনসাধারনের উপর বর্র্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। ইহার বদৌলতে তাকে পাকিস্তান সরকার মেজর জেনারেল পদে উন্নিত করে বাংলাদেশের (তখনকার ইষ্ট পাকিস্থানের) দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলের এরিয়া কমান্ডার হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই ডিসেম্বর সকাল বেলা জেনারেল আনসারি ও তার সকল অফিসারসহ কামারখালী ঘাটে মিত্র বাহিনীর স্থাপন করা ক্যাম্পে নিয়ে হাজির হই এবং প্রতিশোধের নেশায় মাগুরার কামান্না এলকায় সেই ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারীর নায়ক ও জীবননগর থানায় পাক বাহিনীর এক কুখ্যাত ক্যাপ্টেনকে খুঁজতে থাকি যিনি স্থানীয় অনেক লোকের হত্যাকারী এবং নারী ধর্ষনকারী। তাদেরকে সহ আরো কয়েকজন চিহ্নিত পাক সেনা অফিসারদেরকে বের করে মনের দুঃখ, ক্রোধ ও জ্বালা মেটানোর নেশায় চরম প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগটির সৎ ব্যবহার করেছিলাম যদিও ভারতীয় মিত্র বাহিনী ইহাতে বাঁধা সৃষ্টি করার চেষ্ঠা করেছিল। ———-

path20151201094256

৮। উপসংহারঃ ১৯৮২ ইং তে স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদ জোরপূর্বকভাবে বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতা দখলের পর, তার ক্ষমতা কুখ্যিগত, মজবুত এবং দীর্ঘায়িত করার লক্ষে পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা বাঙ্গালী সামরিক অফিসারদের সাহায্য নিয়ে অগনিত এবং তার অপছন্দ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদেরকে অকালীন অবসর করিয়ে দেন, তাদের মধ্যে আমি নিজেই একজন।