দেশে একের পর এক ব্যাংকিং খাতে কেলেঙ্কারি, সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় উদ্যোক্তারা আস্থা হারিয়ে দেশের অর্থ বাইরে পাচার করছেন। কেউ কেউ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থও পাঠাচ্ছেন দেশের বাইরে। ফলে বৈধ বা অবৈধ পথে অনেকেই দেশের বাইরে অর্থ পাঠানোর সুযোগ নিচ্ছেন। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধির পেছনে এমন কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বৃহস্পতিবার সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের ২০১৩ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক দেশের আমানত যেখানে ২০১৩ সালে কমেছে, সেখানে বাংলাদেশীদের আমানত ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বেড়েছে। ব্যাংকটিতে বাংলাদেশীদের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭ কোটি ২০ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, যখন এ ধরনের রিপোর্ট সুইস ব্যাংক প্রকাশ করেছে তখন বাংলাদেশ সরকারের উচিত তা পরিষ্কার করা। কারণ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক উভয়ের মানি লন্ডারিং বিভাগ রয়েছে। অর্থ পাচারের বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত বছরের শেষদিকে খাদ্য এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এটি অস্বাভাবিক। তিনি বলেন, একদিকে বলা হচ্ছে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অন্যদিকে আমদানি বাড়বে। এটা হতেই পারে না। এছাড়া দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ একেবারে শূন্যের কোঠায়। এ অবস্থায় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়তে পারে না। এর অর্থ হলো- ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা মনে করেন, এই রিপোর্ট সুইস ব্যাংক প্রকাশের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশের কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তা করেনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান মানবজমিনকে জানান, অর্থ পাচারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত করা উচিত। একই সঙ্গে যেসব ক্ষেত্রে আইন ভঙ্গ করা হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি।বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, দেশে একের পর এক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ সুশাসনের অভাবে অনেকে দেশে অর্থ রাখা বা বিনিয়োগে আস্থা রাখতে পারছেন না। ফলে অনেকেই বিদেশের ব্যাংকে অর্থ জমা করছে। তারা সেখানেই তাদের অর্থ নিরাপদ মনে করছে। সালেহ উদ্দিনের মতে, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সুইজারল্যান্ডের ব্যাংককে গচ্ছিত অর্থ সব পাচারের তা নয়। কিছু থাকতে পারে। বাকিগুলো বৈধ অর্থ। কেননা, বিদেশে কর্মরত অনেক বাংলাদেশীর বৈধ অর্থ সুইজারল্যান্ডে তাদের ব্যাংক হিসাবে জমা থাকে। তিনি বলেন, তবুও কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হলে মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী শাস্তি হতে পারে। কারণ বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার নিয়ন্ত্রণে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন আছে, তা জোরালোভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে এখন ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটও গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, যদি কেউ দেশ থেকে টাকা পাচার করে থাকে এ ক্ষেত্রে সুইস ব্যাংক থেকে সঠিক তথ্য বের করে আনতে হবে। এতে সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। তাছাড়া এজন্য প্রয়োজন দু’-একটি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। অবশ্য আন্তর্জাতিক চাপের কারণে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোও এখন আগের মতো কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করছে না। বরং গচ্ছিত অর্থের তথ্যাদির বিষয় কিছুটা শিথিল করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ মানবজমিনকে জানান, সুইস ব্যাংকের এ রিপোর্ট অসম্পূর্ণ। এভাবে গোপন তথ্য প্রকাশের বিধান নেই। তবুও এন্টি মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার খতিয়ে দেখতে পারে। যেন ভবিষ্যতে এমনটি না হয়। এ ধরনের অপরাধে কি ধরনের শাস্তি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পৃথিবীর কোথাও এমন রিপোর্ট প্রকাশ কিংবা শাস্তির নজির নেই।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বৃহস্পতিবার বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসএনবি’র তথ্যে দেখা গেছে, ২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী টাকা পাচার রোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর করা হয়। ওই সময় থেকেই সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক পাচার করা টাকার তথ্য প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে তারা ২০০২ সাল থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। ওই প্রতিবেদনে কোন দেশের কত টাকা জমা আছে সে তথ্য তারা প্রকাশ করছে। এখানে বাংলাদেশের গ্রাহকদের রাখা আমানতের চিত্রও তুলে ধরা হয়।
সুইস ব্যাংকে গত ১২ বছরের মধ্যে ২০১৩ সালেই সবচেয়ে বেশি আমানত বাংলাদেশীদের। ২০১৩ সালে ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্রাঁ, যা স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকা। আগের বছর ২০১২ সালে ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্রাঁ বা ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকটিতে বাংলাদেশীদের আমানত বেড়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ ফ্রাঁ বা ১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। তবে কোন বাংলাদেশী তার নাগরিকত্ব গোপন রেখে আমানত রেখেছে তা এই প্রতিবেদনে আসেনি। একইভাবে স্বর্ণালঙ্কার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না।
প্রতিবেদন দেখা গেছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশীদের আমানত ২০০২ সালে ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ ফ্রাঁ। ২০০৪ সালে ৪ কোটি ১০ লাখ, ২০০৫ সালে ৯ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৬ সালে ১২ কোটি ৪০ লাখ, ২০০৭ সালে ২৪ কোটি ৩০ লাখ, ২০০৮ সালে ১০ কোটি ৭০ লাখ, ২০০৯ সালে ১৪ কোটি ৯০ লাখ এবং ২০১০ সালে ২৩ কোটি ৬০ লাখ ফ্রাঁ।
এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে ভারতের ১৯৫ কোটি ফ্রাঁ, পাকিস্তান ১০১ কোটি, শ্রীলঙ্কা ৮ কোটি ২০ লাখ, নেপাল ৮ কোটি ৪৮ লাখ, মিয়ানমার ১ কোটি, মালদ্বীপ ১ কোটি ৩০ লাখ. আফগানিস্তান ১ কোটি ২১ লাখ এবং ভুটান ৫৬ হাজার ফ্রাঁ’র আমানত জমা আছে।
প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৩ সালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আমানত কমলেও বাংলাদেশের বেড়েছে। ২০১৩ সালে সুইস ব্যাংকে বিদেশীদের মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি ফ্রাঁ। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি ফ্রাঁ। এ হিসাবে ব্যাংকগুলোর মোট আমানত কমেছে ৬ হাজার কোটি ফ্রাঁ। ২০১১ সালে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি, ২০১০ সালে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি এবং ২০০৯ সালে ছিল ১ হাজার ৩৩ হাজার কোটি ফ্রাঁ।
উৎস- মানবজমিন