সিম রিপ্লেসমেন্টের নামে ৬৪৭ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়েছে মোবাইল অপারেটর রবি। এ টাকা উদ্ধারে এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। গত ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসির কারিগরি সহায়তায় রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি নিশ্চিত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে এনবিআরের বিশেষ তদন্ত কমিটি।
কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, রবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি টিম বিটিআরসিসহ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এই অর্থ না দেয়ার জন্য তদবির শুরু করেছে। এখন খোদ এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে পর্যন্ত ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যার কারণে ৫ মাস আগে তদন্ত রিপোর্টটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও সেটিকে যথাযথ স্থানে উপস্থাপন করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, ইতিমধ্যে ওই ফাইল থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাতা গায়েব করেও দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, এ কাজে বড় ধরনের বাজেটও রয়েছে রবির। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এ বিষয়ে তারা কোনো ছাড় দেবে না। শিগগিরই তারা পুরো টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য চিঠি দেবে রবিকে। অন্যথায় তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হবে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০১৩ সালের জুন মাসে এনবিআর সেলফোন অপারেটরগুলোর সিম রিপ্লেসমেন্টের নামে নতুন সিম বিক্রি করে রাজস্ব ফাঁকির বিষয় তদন্তের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। একজন কমিশনারকে (ভ্যাট) প্রধান করে গঠিত ওই তদন্ত কমিটিতে ছিলেন এনবিআরের প্রথম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাসহ বিটিআরসি, অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) ও সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর প্রতিনিধি।
বিশেষ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, রবি ৬৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মূল দলিলাদি যাচাইয়ের মাধ্যমে সিম রিপ্লেসমেন্টের আগে ও পরে মালিকানা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে রবি এ অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য। এ প্রসঙ্গে এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সিম রিপ্লেসমেন্টের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। দ্রুতই বিষয়টির সমাধান করা যাবে। টাকা না দিলে প্রয়োজনে রবির ব্যাংক হিসাবও জব্দ করে দেয়া হবে।
এদিকে বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, কোনো কারণে ফোন হারিয়ে গেলে বা সিম নষ্ট হয়ে গেলে সংযোগ অপরিবর্তিত রেখে সিম বদলে নিতে পারেন গ্রাহক। এ জন্য কোনো রাজস্ব দিতে হয় না। অর্থাৎ প্রথম যিনি সিম কিনবেন, তিনিই শুধু সুযোগটি পাবেন। ভিন্ন গ্রাহকের ক্ষেত্রে এ সুবিধা প্রযোজ্য নয়। কিন্তু একমাত্র রবি সংশ্লিষ্ট সিমটি প্রথম গ্রাহকের নামে ইস্যু না করে পরিবর্তিত গ্রাহককে একই নম্বরের সিম বিক্রি করছে। এতে নতুন গ্রাহক তৈরি হলেও এ জন্য কোনো রাজস্ব না দিয়ে পুরো অর্থ ফাঁকি দিয়ে আসছিল।
সিম রিপ্লেসমেন্ট তদন্তসংক্রান্ত বিশেষ কমিটি বিটিআরসির কারিগরি সহায়তায় প্রায় পাঁচ হাজার সিম নতুনভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখেন। এর মধ্যে রবির ১ হাজার ২০০সহ ৩টি অপারেটরের ৩৬৯৭টি সিম রয়েছে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে এ পরীক্ষায় রবির প্রায় ৯৫ শতাংশ সিমের ক্ষেত্রে রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া যায়।
এক্ষেত্রে যে বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, সেগুলো হল সেলফোন অপারেটরগুলোর প্রদর্শিত ডাটাগুলো অবিকৃত নাকি মডিফাইড, সিম নম্বরের আলোকে ডাটাবেজের মালিকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া, সিম রিপ্লেসমেন্টের আগের ও পরের মালিক অভিন্ন কিনা। এ ধরনের যাচাই-বাছাই শেষে ৭৮ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন এনবিআরের কাছে জমা দেয় বিটিআরসি। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, সেলফোন অপারেটররা সিম বদলের আড়ালে নতুন কার্ড ইস্যুর বিপরীতে বিদ্যমান ট্যারিফ মূল্য অনুযায়ী সম্পূরক শুল্ক ও মূসক ফাঁকি দিচ্ছে। কারণ বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী, সাধারণ আদেশ নং-৬/মূসক/২০০৬-এর মাধ্যমে সেবার কোড এস-০১২.২০ অর্থাৎ সিম কার্ড সরবরাহকারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ট্যারিফ মূল্যের ওপর ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়যোগ্য।
তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, রবির রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ৬৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে ২০১১-এর জুন পর্যন্ত ৫২ লাখ ৬১ হাজার ৫৪১টি সিম রিপ্লেসমেন্টের নামে নতুন গ্রাহকের কাছে সিম বিক্রি করে এ অর্থ ফাঁকি দেয়া হয়েছে বলে এনবিআর দাবি করছে। এ প্রসঙ্গে রবির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদুর রহমান (কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বলেন, তিনি শুনেছেন, এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টটি বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আছে। কিন্তু যে রিপোর্টটি এনবিআর পাঠিয়েছে, সেখানে মোবাইল ফোন অপারেটর ও অ্যামটবের কোনো সদস্যের স্বাক্ষর নেই। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক রিপোর্টটিতে তাদের সবার স্বাক্ষর ছিল। ওই রিপোর্টের পর চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরির জন্য যে সব টার্মস অব রেফারেন্স গঠন করা হয়েছিল তদন্তে সেগুলোর কিছুই ফলো করা হয়নি। যার কারণে তারা রিপোর্টে স্বাক্ষর করেননি। তা হলে রিপোর্টটি একতরফাভাবে তৈরি করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এনবিআরের তদন্ত সংস্থার দাবি, সিম পরিবর্তনের নামে নতুন সিম বিক্রি করলেও এজন্য নির্ধারিত শুল্ক দেয়নি রবি। সংস্থাটির হিসেবে জুন ২০০৭ থেকে ডিসেম্বর ’১১ পর্যন্ত অপারেটরগুলো ৩ লাখের বেশি রিপ্লেসমেন্ট সিম ইস্যু করে। এর মধ্যে রবি তাদের সিম কার্ডের বিপরীতে ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং আদায়কৃত ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ করেনি। এ কারণে রাজস্ব ফাঁকির বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাটের টাকার ওপর আরও ২ শতাংশ অতিরিক্ত কর ধরে রবির কাছে মোট ৬৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা দাবি করে এনবিআর।
এ বিষয়ে মোবাইল অপারেটরটি বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছে, ২০০৫ সালের ১৩ জুন করা আইন অনুযায়ী সিম বদলের (রিপ্লেসমেন্ট) জন্য কোনো কর দিতে বাধ্য নয় তারা। কিন্তু তাদের এ দাবি মানতে নারাজ এনবিআর। সংস্থাটির মত হল, যেহেতু বদলি সিম যে কেউ নতুন সিম হিসেবেই ব্যবহার করতে পারে, তাই অপারেটরটি নতুন সিম বিক্রি করে যে কর দেয় বদলি সিমের ক্ষেত্রেও তাই দিতে হবে। সে হিসাবে ২০০৭ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রবির কাছে সিমকার্ড রিপ্লেসমেন্ট বাবদ কর পাওনা রয়েছে এনবিআরের।