রমজান দোরগোড়ায়। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা সারা দিন সিয়াম সাধনার পর সন্ধ্যায় ইফতার করেন। ইফতারে ফলমূল, শরবত, মুড়ি, ছোলাসহ নানারকম মুখরোচক খাবার গ্রহণের রেওয়াজ বহুদিনের। পেশার কারণে কর্মজীবীদের পাশাপাশি গৃহিণীরাও এখন ইফতারিতে বৈচিত্র্য আনতে পাড়া-মহল্লার দোকান ও রেস্টুরেন্ট থেকে ইফতারি সমাগ্রী কিনে থাকেন। কিন্তু ঘরের বাইরে বিক্রি হওয়া ইফতারিতে কয়েক বছর ধরে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আশঙ্কাজনকহারে ভেজাল মেশাচ্ছে। এমনকি যারা ভাজাপোড়া না খেয়ে ফলমূল দিয়েই ইফতার সারতে পছন্দ করেন ভেজালের দৌরাত্ম্য থেকে তারাও রেহাই পান না। আশার কথা এই যে, সম্প্রতি প্রশাসনের ভেজালবিরোধী অভিযানের পর ফলমূলে ফরমালিনের মাত্রা অনেকটাই কমে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ফরমালিন আতঙ্কে ফল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ক্রেতাদের অনেকেই। পুষ্টিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা পরামর্শ দিয়েছেন সাধারণত যেসব স্থানে ফরমালিনমুক্ত ফল ও ভালোমানের খাবার পাওয়া যায় রোজায় সেসব স্থান থেকেই ইফতারি সামগ্রী কিনতে। এ ছাড়া খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের বিষয়টি ‘জিরো টলারেন্সে’ নিয়ে আসতে হবে। এ জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে।
সারা দিন অভুক্ত থাকার পর মানবদেহের প্রয়োজন পর্যাপ্ত পুষ্টিকর ও নির্ভেজাল খাবার। কিন্তু টাকা দিয়ে ক্রেতারা কিনছেন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ও ভেজাল মেশানো ইফতারি সামগ্রী। আপাতদৃষ্টিতে এ ইফতারির আইটেমগুলো দেখে মচমচে, মজাদার ও সুস্বাদু মনে হলেও পুষ্টিবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা জানান, বাইরে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন ইফতারি আইটেমে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কার্বাইড, ফরমালিন, কাপড়ে ব্যবহৃত কেমিক্যাল রং এবং মবিলসহ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর সব রাসায়নিক পদার্থ। আর বিষাক্ত এ পদার্থগুলো শরীরে ঢুকে বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে জটিল সব রোগে।
ভেজালবিরোধী অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি (অপারেশন) সাহেদ আল মাসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এত দিন ফলে ফরমালিন আছে কি না তা পরীক্ষা করা হলেও আসছে রমজানে মাছ ও ইফতারি সামগ্রীর জন্য ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হবে। তিনি আরও জানান, সাম্প্রতিক অভিযানে অভিযুক্তদের জরিমানাসহ সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, গত এক সপ্তাহে বাজারে বিক্রি হওয়া ফলে ফরমালিনের উপস্থিতি অনেক কমে এসেছে। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরে থেকে যেসব ট্রাকে ফল আনা হচ্ছে তাতে এ রাসায়নিকটির ব্যবহার বন্ধ হয়েছে। তবে অভিযানে ব্যবহৃত ফরমালিন যন্ত্রটি সঠিক ফলাফল দিচ্ছে না- এমন মন্তব্যের সঙ্গে একমত নন অভিযান-সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, ফরমালিন শনাক্তকরণ যন্ত্রটি আন্তর্জানিক মানের এবং অভিযানে যারা এটি ব্যবহার করছেন তাদেরও যন্ত্রটি ব্যবহারের আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
পিয়াজু-বেগুনিতে রং ও মবিল : অনুসন্ধানের জানা যায়, ইফতারের মুখরোচক খাবার পিয়াজু, বেগুনি, সবজিবড়া, বিভিন্ন কাবাব, আলুর চপ ও জিলাপির রং আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষতিকারক সিনথেটিক রং। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খাবার আকর্ষণীয় করতে লাল রং মেশানো হয়। সাধারণত খাবারে নির্দিষ্ট মাত্রায় রং (খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত) মেশানোর নিয়ম থাকলেও দাম বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা কম দামি কাপড়ে ব্যবহৃত রং ব্যবহার করছেন। এমনকি যে তেলে এগুলো ভাজা হচ্ছে তাতেও মবিল ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে খাবার মচমচে হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, কম দামি টেঙ্টাইল রং কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তা ছাড়া মবিলে ভাজা খাবার খেলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে দেহের ক্ষতি হয়। এতে ক্যান্সারের আশঙ্কা থাকে এবং পরিপাক-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি হয়। জানতে চাইলে মগবাজারের এক রেস্টুরেন্টের মালিক জানান, রং ব্যবহার না করলে খাবার সুন্দর হয় না। ক্রেতারাও খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয় না।
জিলাপি ও ছোলায় হাইড্রোজ : জানা যায়, জিলাপির খামির জমতে কিছুটা সময় লাগে। আর একশ্রেণির বিক্রেতা চটজলদি জিলাপি বানাতে এতে হাইড্রোজ ব্যবহার করে। ফলে জিলাপি মচমচে হয়। অন্যদিকে কালো ছোলা সাদা করতে দোকানিরা হাইড্রোজ দিয়ে তা সিদ্ধ করে বলে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্রে জানা যায়। জিলাপি আকর্ষণীয় করতে অনেক সময় এতে লাল ও হলুদ কাপড়ের সিনথেটিক রং মেশানো হয়।
মুড়িতে ইউরিয়া : ইফতারে মুড়ি প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য। অথচ বহুদিন ধরে এটি ভাজা হচ্ছে হাইড্রোজ বা ইউরিয়া সার দিয়ে। মূলত আকারে বড় ও সাদা করতেই বিক্রেতারা এমনটি করে। এ বিষয়ে যাত্রাবাড়ীর এক মুড়ি বিক্রেতা জানান, ইউরিয়া সার ছাড়া মুড়ি ভাজলে তা লাল হয় আর লাল মুড়ির ক্রেতা নেই বলে তিনি মুড়িতে সার ব্যবহার করেন।
ফল ছাড়া রাসায়নিকে জুস : বাজারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন ফলের জুসে ফলের রস বা রসের নূ্যনতম উপাদান না থাকলেও নির্দিষ্ট ফলের রং, গন্ধ, চিনি ও পানি মিশিয়ে জুস হিসেবে তা প্যাকেট বা বোতল জাত করা হচ্ছে। চিনির বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে স্লাইকোমেট নামের ক্ষতিকর রাসায়নিক তরল পদার্থ। এ ছাড়া ইফতারে শরবত হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্লাস্টিকের প্যাকেটে তৈরি গুঁড়া শরবত দেহের জন্য ক্ষতিকর। এগুলোয় শুধু চিনি বা কৃত্রিম মিষ্টি ও রং মেশানো হয়।
ফল ও দুধে ফরমালিন : ইফতারে ফল ও দুধ দুটি অত্যাবশ্যকীয় খাবার কিন্তু আতঙ্কের বিষয়, এ খাবার দুটিতেও এখন মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর ফরমালিন। বিশেষ করে আম, মালটা, খেজুর, আপেল, আঙুর ও কমলায় এর ব্যবহার বেশি হচ্ছে। এ ছাড়া তরল দুধে এ ক্ষতিকর রাসায়নিকটি মেশানো হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক, বিএসটিআইর সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. গোলাম মাওলা বলেন, ‘কোনো ফলে এখন আর স্বাদ পাওয়া যায় না। কার্বাইড ও ফরমালিন মেশানোর ফলে এমনটি হচ্ছে। ফরমালিনযুক্ত ফল খাওয়ার কারণে ধীরে ধীরে আমাদের কিডনি ও যকৃৎ নষ্ট হতে শুরু করে। এর ফলে মুখের স্বাদও নষ্ট হয়ে যায়।’ অন্যদিকে আইসিডিডিআরবির গবেষণায় দেখা যায়, ফল গাছে থাকা অবস্থাতেই ফরমালিন, কার্বাইডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার শুরু হয়। জানা যায়, ব্যবসায়ীরা সময়ের আগে কাঁচা ফল পাকাতে, আকর্ষণীয়, তাজা ও সুন্দর দেখাতে ফলে রাসায়নিক ব্যবহার করে। বাজারের ফলগুলোয় ব্যবহৃত রাসায়নিকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথিফেন ও ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া ফলে আরও ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ও জুতার রং। সাধারণত কার্বাইড দিয়ে কলা পাকানো হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, রাসায়নিক-মিশ্রিত এসব ফল খেয়ে মানুষের ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার সমস্যা, আর্সেনিক, স্নায়ু সমস্যা, পাকস্থলী সংক্রমণ, গর্ভজাত সন্তানের প্রতিবন্ধকতা, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা আছে।
বিএসটিআইর ঊধর্্বতন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, প্রতিবারই রমজানে রাজধানীর বিভিন্ন মেগাশপ ও রাস্তার পাশের দোকানে ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে অভিযান চালানো হয়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিওর ফুড অর্ডিন্যান্সে জরিমানা মাত্র ৮০০ টাকা। এ অর্থ দিয়ে ভেজাল খাদ্যের রমরমা ব্যবসা থামানো সম্ভব নয়। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক মাহমুদুর রহমান বলেন, পরীক্ষায় মানুষের দেহে আগের তুলনায় বেশি কার্বাইড, ফরমালিন, অর্গানো ফসফরাস ও হেভি মেটালের পরিমাণ পাওয়া গেছে। রোজায় এ রাসায়নিক পদার্থগুলো মানবদেহে আরও বেশি পরিমাণে প্রবেশ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় মানুষের কিডনি ও যকৃৎ তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সম্প্রতি প্রশাসনের পরিচালিত ফরমালিনবিরোধী অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক (আইন) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সাবেক মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ফরমালিনবিরোধী উদ্যোগটি ইতিবাচক হলেও এতে পুরোপুরি সফলতা আসবে বলে আমি মনে করি না। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসন ও ব্যবসায়ীদের প্রতি সাধারণের যে আস্থার সংকট রয়েছে তাও কাটিয়ে উঠতে হবে।’ তিনি বলেন, রাজধানীর বাইরের জেলা-উপজেলাগুলোয় বিচ্ছিন্নভাবে ফরমালিনবিরোধী কিছু অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু অভিযানটি ফলপ্রসূ করতে হলে সারা দেশে একসঙ্গে ফরমালিনবিরোধী অভিযান শুরু করা উচিত।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা বলেন, রমজান মাসে তারা একজন ফরমালিন বিশেষজ্ঞ ও ডিসিসির খাদ্য পরিদর্শক সহযোগে ভেজাল খাদ্য অভিযান পরিচালনা করবেন। এতে অভিযুক্তদের তাৎক্ষণিক অর্থদণ্ড দেওয়া হবে।