বপ্নপূরণের আনন্দ যেমন প্লাবিত করে হৃদয়কে, আশাভঙ্গের বেদনায় তেমনি হৃদয় হয় বিদীর্ণ। জীবনের মতো ফুটবলেও অঘটন-চক্রান্ত ওঁৎপেতে থাকে আশপাশে। জীবনের মতো ফুটবলেও দুর্ঘটনা-দুর্বিপাক হানা দেয় অকস্মাৎ। কত স্বপ্ন নিয়ে সেলেকাওরা সাজিয়েছিল বিশ্বকাপের সংসার। সেই সংসার সুখে থৈ থৈ করছিল হলুদ-সবুজের সমারোহে।
হঠাৎ সাত গোলের প্লাবনে ভেসে গেল আনন্দের খড়কুটো। আমাজন অরণ্যের নিঃসীম শূন্যতা সাও পাওলো থেকে রিও ডি জেনিরোতে।
ঘরভর্তি অতিথি, অথচ কর্তা নিঃসঙ্গ! নিজেদের আঙিনায় বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিল দর্শক। সাত গোলের অঙ্গারে পুড়ছে। মারাকানায় রবিবাসরীয় দ্বৈরথ। সেখানে আর্জেন্টিনা-জার্মানি লড়বে প্রাণপাত। জীবনের চাইতেও বড় যুদ্ধ। মেসি-মুলাররা নিজেদের নিংড়ে দেবেন মুকুট মাথায় তুলতে। সেখানে ব্রাজিল নেই। নেইমার নেই। ৬৪ বছর আগে মারাকানায় যে অঘটনের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ব্রাজিলে, তার আঁচ এতদিন পরও ডেভিড লুইজরা পাচ্ছেন সাত গোলের লজ্জায় পুড়ে।
‘তোমার চন্দনা মরে গেছে। ওকে আর ডেকে কী হবে …।’
ব্রাজিলের স্বপ্নটা মরে গেছে। ওকে আর মনে রেখে কী হবে। অতএব, ক্ষতে প্রলেপ বোলানোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দরকার। সেটি বোধহয় আবিষ্কার করে ফেলেছেন নেইমার। ব্রাজিল ছিটকে পড়ার আগে যিনি নিজে ছিটকে গিয়েছিলেন। স্বপ্নের সমাধির আগেই হয়ে গিয়েছিল তার ড্রেস রিহার্সেল। তা নেইমারের সেই পথ্যটা কী? লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা যেন বিশ্বকাপটা জেতে। শেষ মহারণে যেন ‘মরণ’ হয় জার্মানির। আমি পারিনি, তুমি পারো- এটাই বোধহয় বন্ধুর প্রতি বন্ধুর বার্তা।
ব্রাজিলীয়রা বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছে, না কার কাছ থেকে কে জানে, হলুদ-সুবজের দেশ এখন কান্নারও দেশ। বেলো হরিজন্তেতে বিষের বাঁশি শেষ হতেই অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন ডেভিড লুইজরা। বৃহস্পতিবার তেরেসপোলিসে কান্নায় ভেঙে পড়লেন নেইমার। নিজেদের ষষ্ঠ শিরোপা জয়ের স্বপ্ন আটলান্টিক মহাসমুদ্রে বিসর্জন দিয়েছে পেলের দেশ।
অন্যের স্বপ্ন চোখের সামনে পূরণ হতে দেখে কী ভয়ানক কষ্টের সুনামিতে তোলপাড় হয় হৃদয়, নেইমারের চেয়ে এটা ভালো আর কে বুঝবেন। তাই তো শিরদাঁড়ার প্রচণ্ড চোটে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার আশংকা যাকে ঘিরে ধরেছিল, তিনি এখন আর্জেন্টিনাকে ঘিরে ধরেছেন স্বপ্নের বেষ্টনী দিয়ে। কেন এই অনিচ্ছাকৃত আলিঙ্গন? নেইমার মেসির হাতে ট্রফিটা দেখতে চান এজন্যই যে, বার্সেলোনায় তারা সহযোদ্ধা। এদিন এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে কান্নাভেজা চোখে এবং আকুতিঝরা কণ্ঠে নেইমার যেন নিজের হৃদয়টা খুলে দেখালেন, ‘ফুটবলে মেসির ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ট্রফি জিতেছে সে। আমি ওর জন্যই গলা ফাটাব। সে আমার বন্ধু, আমার সতীর্থ। ওর জন্য আমার শুভকামনা রইল।’
কলম্বিয়া ম্যাচের সেই দুঃস্বপ্ন স্মরণ করতে গিয়ে চোখ মুছলেন ব্রাজিলের দুঃখী স্ট্রাইকার। জুনিগার হাঁটু তার পিঠে আঘাত করতেই ভয় পেয়েছিলেন। হয়তো সারা জীবনের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। ‘আর মাত্র দুই সেন্টিমিটার উপরে আঘাত লাগলেই আমার ঠিকানা হতো হুইলচেয়ারে’, বললেন তিনি। সেটা হয়নি। ব্রাজিল চলে গেল ‘হুইলচেয়ারে’। ‘আমার ক্যারিয়ারের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এই ঘটনাটি ঘটল। আমার ভাগ্য ভালো যে, মারাÍক কিছু ঘটেনি। তবুও, মনটা মেনে নিতে পারছে না। যারা ফুটবলটা বোঝেন, তারা দেখেছেন সেই বাধাদান স্বাভাবিক ছিল না’, নেইমারের হতাশা পরিষ্কার। এখন নেইমারকে ছয় সপ্তাহ মাঠের বাইরে থাকতে হবে। ফিফা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি জুনিগার বিপক্ষে। নাপোলির এই ডিফেন্ডার ক্ষমা চেয়েছেন ব্রাজিলীয় সুপারস্টারের কাছে। নেইমার তাকে মাফ করে দিয়েছেন।
আগামীকাল মারাকানায় ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা লড়বে জার্মানির বিপক্ষে। নেইমার চান মেসির হাতে যেন ট্রফিটা শোভা পায়। আর্জেন্টিনা যেন চ্যাম্পিয়ন হয়।
‘বিশ্বকাপ মেসিরই জেতা উচিত’, বললেন নেইমার। স্বপ্নের যখন অকালমৃত্যু হয়, সেই শোক ভুলতে তখন ইচ্ছা- অনিচ্ছারও মৃত্যু ঘটাতে হয়। ব্রাজিল আজ তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হবে। এই ম্যাচ নিয়ে যেন কোনো মাথাব্যথাই নেই নেইমারের। তিনি এখন চান তার বন্ধু ও ক্লাব সতীর্থ মেসির মুখে হাসি। অথচ, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী।
ফুটবল কখনও কখনও জীবনের মতো এমন বঞ্চনার মঞ্চ সাজায়, যেখানে প্রধান অতিথি হয়ে যান দর্শক। তখন অন্যের গলায় ফুলের মালা দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হয় তাকে। সেই ইচ্ছায় হয়তো মনের সায় থাকে না। পাগল মন, তাকে বশ মানানো যায় নাকি!
নেইমারের হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সেটা তো বোঝাই যায়!