আসন্ন বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ থাকছে। দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের কারণে ব্যাংকগুলো এখন চরম মূলধন সঙ্কটের মুখে। তাই লুটপাটজনিত ঘাটতি মেটাতে জনগণের করের টাকায় তৈরি বাজেট থেকে বরাদ্দ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
সূত্র মতে, আগামী বাজেটে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মোকাবেলায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। জানতে চাইলে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, মূলধন ঘাটতির কারণ ব্যাংকগুলো বলতে পারবে কেন, কি কারণে ঘাটতি হল। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি ব্যাংকের বেশি মূলধনের ঘাটতি রয়েছে। কারণ সুদ ও ঋণ মওকুফ করতে গিয়ে এ ঘাটতির মুখে পড়েছে। সব সরকারের আমলে এ ধরনের সুদ মওকুফ করা হয়েছে। তবে এ ধরনের ঘাটতি যেগুলো আছে তা পূরণ করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, লটুপাটের কারণে ব্যাংকগুলোতে যে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে তা মেটানোর জন্য বরাদ্দ পেতে কয়েকটি শর্ত আরোপ করা হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর। বিশেষ করে গত বছর ঘাটতি মূলধন দেয়া হয়েছে। ওই অর্থ নেয়ার সময় বেশ কিছু শর্ত দেয়া ছিল। এগুলো ঠিকমতো পালন করা হয়েছে কিনা অর্থ মন্ত্রণালয় সেটি দেখবে। যেসব ব্যাংক শর্ত পালন করেছে তাদের অনুকূলে অর্থছাড় করা হবে।
জানা গেছে, শীর্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ৫১৯৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকা। অন্যান্য ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে হলমার্ক সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এছাড়া বিসমিল্লাহ গ্র“পসহ অন্যান্য কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধনের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফা ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থতার কারণে ৮০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা জরিমানা দিয়েছে, যা ব্যাংকের তারল্য সঙ্কটের প্রকৃত চিত্র। এছাড়া বহির্নিরীক্ষক কর্তৃক ঋণ ও অগ্রিমের মধ্যে ৯৩৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা বিরূপমানে শ্রেণীকরণ করে এর বিপরীতে ৫৪১ কোটি ৭০ লাখ টাকার সংস্থান নিরূপণ করা হয়েছে। একইভাবে যোগ্য আমানতের মূল্য বেশি দেখিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় ২১৬ কোটি ৯০ লাখ টাকার সংস্থান কম করা হয়েছে।
ব্যাংকের কার্যক্রমের অসঙ্গতির মধ্যে আরও দেখা যায়, আদায় ছাড়া স্থগিত সুদ হিসাব থেকে ৩০ কোটি ৩০ লাখ টাকা আয় খাতে স্থানান্তর এবং অন্যান্য সম্পদ খাতে ৫৩৬ কোটি ২০ লাখ টাকা সংস্থানের জন্য আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু সর্বমোট ১৩২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকার কোনো প্রতিফলন ব্যাংকের নিরীক্ষা ব্যালেন্সশিটে প্রদান করা হয়নি। এতে ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক প্রতিফলন হয়নি। ব্যাংকের বহির্নিরীক্ষক কর্তৃক নিরূপিত সংস্থান ঘাটতি প্রায় ১৩২৫ কোটি টাকা হিসাবে আনা হলে ব্যাংকের নিট ক্ষতি দাঁড়ায় ৪৪৮০ কোটি ২১ লাখ টাকা। মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫১৯৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এছাড়া ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের কারণেও মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। সর্বশেষ হিসেবে মার্চে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দা ঋণ হচ্ছে ১৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এসব অর্থ ফেরত প্রায় অনিশ্চিত, যা মূলধন ঘাটতি হিসেবে দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ অডিট রিপোর্টে সোনালী ব্যাংকে বড় ধরনের ২২টি ঘটনায় ৬৬৩ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকে ২৪টি ঘটনার মাধ্যমে ৭১৩ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে। এছাড়া জনতা, রূপালী, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি ব্যাংকসহ সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে বিভিন্নভাবে আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। সবগুলো ব্যাংকে আর্থিক অনিয়মের পরিমাণ ৭৯৬ কোটি টাকা। ফলে এসব ঘটনায় ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাজেট থেকে টাকা দেয়া মানে জনগণের টাকা। বাজেটের অর্থ আসছে জনগণের কর থেকে। উল্টো দিকে যদি দেখা যায় ব্যাংকগুলো বসে গেল। তাহলে লাখ লাখ গ্রাহকের বিষয়ে কি হবে। এটিও ভাবতে হবে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঘাটতি মূলধন ঋণ হিসেবে দেয়া উচিত। ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা উচিত। পরে এই অর্থ ডিভিডেন্ট বা ঋণ হিসেবে পরিশোধ করবে।