রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা মামলার রায়ে মুফতি হান্নানসহ আট জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ছয় আসামিকে। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রুহুল আমিন গতকাল এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় কারাগারে আটক ৯ আসামি আদালতের কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন। বাকি ৬ আসামি এখনও পলাতক। আইনানুযায়ী পলাতকদের অনুপস্থিতিতেই তাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। তারা গ্রেপ্তার কিংবা আত্মসমর্পণের দিন থেকে রায় কার্যকর হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। রায়ে বিচারক বলেন, জনমনে ত্রাস, আতঙ্ক ও ভয় সৃষ্টি করার জন্যই রমনা বটমূলে বোমা হামলা করে ১০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। অনেকেই আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। তাই আসামিদের বিরুদ্ধে কোনরকম অনুকম্পা দেখানোর কোন সুযোগ নেই। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৮ আসামি হলেন- মুফতি আবদুল হান্নান, মাওলানা আকবর হোসাইন ওরফে হেলালউদ্দিন, মুফতি আবদুল হাই (পলাতক), হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর (পলাতক), মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার (পলাতক), মুফতি শফিকুর রহমান (পলাতক), মাওলানা আলহাজ তাজউদ্দিন (পলাতক) ও আরিফ হাসান সুমন। আদালত ঘোষিত রায়ে বলেন, এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে পেনাল কোড-এর ৩০২/৩৪/১২০বি ধারার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হলো। উল্লিখিত আসামিদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন বিচারক। এছাড়া অপরাপর আসামি হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা সাব্বির ওরফে আবদুল হান্নান, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মাওলানা আবদুর রউফ ও শাহাদাতউল্লাহ জুয়েলকে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪/১২০বি ধারার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের প্রত্যেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ঘোষিত রায়ে দণ্ডপ্রাপ্তরা সকলেই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা ও কর্মী। গত ১৬ই জুন আলোচিত এই হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য থাকলেও ‘রায় প্রস্তুত করা হয়নি’ মর্মে ২৩শে জুন রায় ঘোষণার দিন পুনঃনির্ধারণ করেছিলেন বিচারক। এর আগে ২৮শে মে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকা এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়। ২০০১ সালের ১৪ই এপ্রিল রাজধানীর রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই ৯ জন নিহত হন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরও একজন। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন অনেকে। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের দিন নীলক্ষেত বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র চন্দ বাদী হয়ে রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা করেন। দেশ-বিদেশে আলোচনার ঝড় তোলা এই বোমা হামলার ঘটনার প্রায় ১৩ বছর পর হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হলো। আদালত সূত্রে জানা গেছে, রমনায় বোমা হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হলেও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলাটি ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এখনও বিচারাধীন। রায় ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পক্ষান্তরে আদালতে উপস্থিত সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও তাদের নিযুক্ত আইনজীবীরা ঘোষিত রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এসএম জাহিদ সরদার জানিয়েছেন, অভিযোগপত্র অনুযায়ী আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য ও তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে আমরা ঘটনার বিস্তারিত প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি বলেই আসামিদের বিরুদ্ধে আদালত এ শাস্তি দিয়েছে। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন অনেকদিন পর রায় ঘোষিত হয়েছে। এই রায়ে আমরা খুশি। পক্ষান্তরে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মাদ রায় ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। তাই আসামিরা খালাস পাবেন বলে আশা করেছিলাম। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো।
সুদীর্ঘ তের বছরের অপেক্ষার অবসান হচ্ছে স্বভাবতই রমনা বোমা হামলায় হত্যা মামলার রায় শুনতে সকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে পুরান ঢাকার আদালতপাড়া লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। গণমাধ্যম কর্মী, আইনজীবী, বোমা হামলায় নিহতদের স্বজন, সাধারণ মানুষ সহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ ভিড় জমাতে থাকে আদালত চত্বরে। আদালত জুড়ে ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিপুল পরিমাণ পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা পুরো আদালত চত্বরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরই মধ্যে সকাল ৯টায় এই মামলার প্রধান আসামি মুফতি আবদুল হান্নানসহ কারাগারে আটক অন্য আসামিদের একটি নীল রঙের প্রিজন ভ্যানে করে আদালত চত্বরে নিয়ে আসা হয়। প্রথমে তাদের রাখা হয় আদালতের নিজস্ব হাজতখানায়। সেখান থেকে সকাল এগারটায় তাদের নিয়ে যাওয়া হয় মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের দোতলায় অবস্থিত দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের এজলাসে। এ সময় আসামিদের বেশির ভাগের পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় গোল সাদা টুপি। কারও মাথায় ছিল পাগড়ি। চোখে চশমা। আদালতের কাঠগড়ায় ঢোকার পর থেকেই আসামিদের সবাই দোয়া দরুদ পড়তে থাকেন। কেউ কেউ উচ্চ স্বরে দোয়া ও মোনাজাত করছিলেন। এর মধ্যে মামলার প্রধান আসামি মুফতি আবদুল হান্নান ছিলেন অনেকটাই নির্বিকার। রায় ঘোষণার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সোনালি ফ্রেমের চশমা, সাদা ফুল হাতা পাঞ্জাবি, পাজামা ও মাথায় গোল সাদা টুপি পরা মুফতি হান্নান ছিলেন বেশ সরব। দুপুর পৌনে এগারটায় বিচারক মো. রুহুল আমিন এজলাসে ওঠেন। পর মুহূর্তেই তিনি রায় পড়া শুরু করেন। এসময় তিনি রমনা বোমা হামলার ইতিবৃত্ত, মামলা দায়ের, অভিযোগপত্র দাখিলসহ সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও আলামতের ভিত্তিতে রায় ঘোষিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। প্রায় ৩৫ মিনিট ধরে পঠিত রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, ২০০১ সালের রাজধানীর রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান কোন ব্যক্তি, বা গোষ্ঠীর ছিল না। এটি ছিল বাঙালির চিরপরিচিত একটি উৎসব। সকল শ্রেণীর মানুষ বর্ষবরণের এই আনন্দে শামিল হতে আসে। এই দিন বাঙালি জাতি বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয়। তিনি বলেন, এটি একটি ভিন্ন ঘটনা। এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণি যে রমনায় ঐদিনের বোমা হামলার ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন বা আহত হয়েছেন তারা কেউ কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। এদের সবাই ছিলেন সাধারণ মানুষ। আসামিদের সঙ্গে তাদের কোনরকম শত্রুতা বা রাজনৈতিক সংশ্রব ছিল না। তথাপি তাদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে আসামিরা বোমা হামলা করে হত্যা করেছে। রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের জবানবন্দি, বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ আদালতে হাজির করেছেন। যা মামলায় আসামিদের দোষ প্রমাণে সহায়তা করেছে। পক্ষান্তরে আসামিপক্ষ সাক্ষীদের জেরা ও তথ্য-উপাত্তের উপস্থাপনের মাধ্যমে আসামিদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণ বক্তব্যের পরপরই বিচারক মো. রুহুল আমিন আসামিদের উদ্দেশ্যে দণ্ডাদেশ পড়ে শোনান। এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি তার এজলাস ত্যাগ করে খাস কামরায় চলে যান। তবে দণ্ডাদেশ ঘোষণার পরে কাঠগড়ায় থাকা মুফতি হান্নান সহ বেশ ক’জন আসামি উচ্চস্বরে রায়ের প্রতিবাদ করলেও কাউকে তেমন বিচলিত মনে হয়নি।
ফয়সালা হবে হাশরের ময়দানে: রায় ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় এই মামলার প্রধান আসামি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মুফতি আবদুল হান্নান উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন তিনি নির্দোষ। অন্যায়ভাবে তাকে সাজা দেয়া হয়েছে। তিনি উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। কোন সাক্ষীর বক্তব্য থেকে এটা প্রমাণিত হয়নি যে, আমরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছি। ইচ্ছাকৃতভাবে এই রায় দেয়া হয়েছে। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো। কাঠগড়ায় থাকা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হাফেজ মাওলানা আবু তাহের চিৎকার করে বলতে থাকেন, আমাদের অন্যায়ভাবে সাজা দেয়া হয়েছে। এই আদালতের বিচার শেষ বিচার নয়, বিচার হবে হাশরের ময়দানে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরিফ হাসান সুমন বলেন, ঘটনার সময় আমার বয়স ছিল ১৪। আমি তখন ভূঁইয়া একাডেমির শিক্ষার্থী ছিলাম। এই ঘটনার সঙ্গে আমার কোনরকম সম্পৃক্ততা ছিল না। আমি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এজন্য উচ্চ আদালতে আপিল করবো। কাঠগড়ায় থাকা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ বলতে থাকেন, আমি ’৯৯ সালের ৭ই জানুয়ারি থেকে দুবাই ছিলাম। ঘটনার তিন বছর পর দেশে আসি। কিন্তু আমাকে অন্যায়ভাবে এই মামলায় সংশ্লিষ্ট করে সাজা দেয়া হয়েছে।
দ্রুত রায় কার্যকর চান স্বজনেরারমনা বটমূলে বোমা হামলার দীর্ঘ ১৩ বছর পর ঘোষিত রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনরা। একই সঙ্গে তাদের দাবি, দ্রুত এই রায় কার্যকর হোক। ২০০১ সালের ১৪ই এপ্রিল পয়লা বৈশাখে রাজধানীর রমনা বটমূলে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন। এর মধ্যে পটুয়াখালীর বাউফলের গাজী বাড়ির তিনজন ছিলেন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন আল মামুন, রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ ও জান্নাতুল ফেরদৌসী শিল্পী। তারা পরস্পরের চাচাতো ভাইবোন। রায় শোনার জন্য সকাল থেকেই গাজী বাড়িতে ভিড় করতে থাকেন আশপাশের লোকজন। নিহত আল মামুনের মা নূরজাহান বেগম (৭০) রায় শোনার জন্য ঘরে টেলিভিশনের সামনে অধীর অপেক্ষায় বসে ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন অন্য স্বজনরাও। রায় শুনে তিনি অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন তিনি। পরে বাবা মা মিলে যান আল মামুনের কবরে, সেখানে তারা সন্তানের রুহের মাগফিরাত কামনায় মোনাজাত করেন। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় নিহত মামুনের বাবা কাসেম গাজী (৮০) বলেন, দীর্ঘ অপেক্ষা করেছি এই শোনার জন্য। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের একটাই দাবি, কবরে যাওয়ার আগে যেন এই রায় কার্যকর দেখে যেতে পারি। তবে নিহতদের কবরগুলো মেরমাতের অভাবে ভেঙে পড়ছে বলে জানা তাদের পরিবারের সদস্যরা। পারিবারিক কবরস্থানে শায়িত মামুন, রিয়াজ ও শিল্পীর কবরের ইটও খসে পড়তে শুরু করেছে। এলাকার লোকজন বাউফলের নিহত তিনজনের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় করা হত্যা মামলার রায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নানসহ আটজনকে ফাঁসির আদেশ ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রুহুল আমিন।