পবিত্র মাহে রমজান উম্মতে মোহাম্মদীর (সঃ) জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ পাকের প্রদত্ত এক অনন্য নিয়ামত। মাহে রমজানের অশেষ মহিমার ও মর্যাদার কথা পবিত্র কোরআন ও হাদীসে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আরবী ‘রমজান’ শব্দটির মূল ধাতু হচ্ছে ‘রমদ্ব’। এর অর্থ হলো দহন করা, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া। যেহেতু রমজান মাসে রোযা রাখলে রোযাদার ব্যক্তির গোনাহগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই হয়ে যায় সেজন্য এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘রমজান’। পবিত্র তৌরাত গ্রন্থে রোযাকে ‘হাত্ব’ ‘যবুর’ গ্রন্থে রোযাকে ‘ক্বোরবত’ এবং ইনজিল গ্রন্থে রোযাকে ‘ত্বার’ বলা হয়েছে। ‘হাত্ব’ শব্দের অর্থ পাপ ধ্বংস করা, ‘ক্বোরবত’ শব্দের অর্থ নৈকট্য লাভ করা, এবং ‘ত্বার’ শব্দের অর্থ কলুষমুক্ত হওয়া, পবিত্র হওয়া। যেহেতু রোযার মাধ্যমে রোযাদার ব্যক্তি পাপ হতে মুক্তি লাভ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হয় সে জন্যই রোযাকে উল্লেখিত শব্দ দ্বারা বিশেষিত করা হয়েছে।
বারটি মাসের মধ্যে সর্বোত্তম মাসের নাম হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। মহান রাব্বুল আলামীনের তরফ হতে মুসলিম মিল্লাতের জন্য এক অনুপম রহমত, বরকত ও মুক্তির পয়গাম নিয়ে আবির্ভূত হয় পবিত্র মাহে রমজান। আমাদের প্রিয় নবী (সঃ) রজব মাস থেকেই এই দোয়া করতেন- হে আল্লাহ রজব ও শাবানের অবারিত কল্যাণ ও বরকত আমাদেরকে দান কর এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছার তৌফিক দান কর। নবী (সঃ) এর এই দোয়া থেকেই মাহে রমজানের মহিমা ও মর্যাদার কথা বিশেষভাবে অনুধাবন করা যায়।
এই মাস সবর, ধৈর্য্য, সাধনা এবং পাপ হতে মুক্ত ও পবিত্র হওয়ার মাস। এই মাসে রোযা রাখা মুসলমানদের উপর ফরজ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন-‘হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া ও পরহেজগারীসহ সাবধান হয়ে চলতে পার।’ (সুরা বাকারা ঃ আয়াত-১৮৩)। পবিত্র মাহে রমজান এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ মাস যাতে মুসলমানদের জীবন বিধান মহাগ্রন্থ আল-কোরআন নাযিল করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-‘রমজান মাস, এমন একটি মাস যে, এ মাসেই কোরআন মজিদ নাজিল হয়েছে।’ (সুরা বাকারা ঃ আয়াত-১৮৫)। এই পবিত্র মাসে কেবলমাত্র কোরআনই নাজিল হয়নি; বরং বহু আসমানী কিতাব ও এ মাসেই নাজিল হয়েছিল। করুণাময় আল্লাহপাক রমজান মাসকে অশেষ রহমত ও বরকত দ্বারা মহিমান্বিত করেছেন।
বিশিষ্ট সাহাবী হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-রাসূল (সঃ) বলেছেন-যখন রমজান মাস উপস্থিত হয় তখন আকাশ সমূহের দরজাসমূহ খোলে দেয়া হয়, অন্য বর্ণনায় আছে জান্নাতের দরজা সমূহ খোলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং বিতাড়িত শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। আর অন্য বর্ণনায় আছে রহমতের দরজা খোলে দেয়া হয়। (বুখারী ও মুসলিম) অন্য এক হাদীসে রাসূল (সঃ) বলেছেন-যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাস ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় রমজানের রোযা রাখবে তাঁর পূর্ববর্তী সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে, আর যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাস ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় রমজান মাসে ইবাদত করে (তারাবীহ নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত) তাঁর পূর্ববর্তী সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে, আর যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে পূর্ণ বিশ্বাস ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ইবাদত করবে (যথা-তেলাওয়াত, জিকির বা নামাজে দন্ডায়মান হয়) তাঁরও পূর্ববর্তী সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারী ও মুসলিম)।
রোযাদারগণ অতি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। রোযাদারগণের নিদ্রা ইবাদতের মধ্যে শামিল, তাঁর নিশ্চুপ থাকা তাছবীহ পাঠের মধ্যে পরিগণিত, তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুরকৃত এবং তাঁর কাজকর্ম দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী।
পবিত্র রমজান মাসের এক সুন্নত বা নফল কাজ অন্য মাসের ফরজ ইবাদত আদায়ের সমান। যে লোক এই মাসে একটি ফরজ আদায় করবে সে অন্যান্য মাসের সত্তরটি ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবে। হাদীস শরীফে রাসূল (সঃ) বলেছেন-বনি আদমের প্রতিটি নেক কাজের ফলাফল দশগুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেয়া হবে। কিন্তু রমজানে এর ব্যতিক্রম হবে। কেননা আল্লাহ স্বয়ং বলেন : বান্দাহ আমার সন্তুষ্টির জন্যই রোযা রেখেছে এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দিবো। (বুখারী ও মুসলিম)।
রোযাদারগণের গৌরব ও মর্যাদা বর্ণনা করে শেষ করা অসম্ভব। অন্য এক হাদীসে নবী (সঃ) বলেছেন-যে ব্যক্তি ঈমান এবং আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে রমজানের রোযা রাখে সে গোনাহ হতে এমনভাবে নিষ্পাপ হয়, যেমন মা তাঁকে আজ নিষ্পাপ জন্ম দিল। রোযাদার ব্যক্তির মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম।
মিশকাত শরীফের একখানা হাদীসে আছে রাসূল (সঃ) বলেছেন-রোযা ও কোরআন উভয়ই বান্দাহর জন্য (কিয়ামতের দিনে) সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আমার রব, আমি এই লোকটিকে (রমজান মাসে) দিনের বেলায় খানাপিনা ও ভোগলালসা থেকে নিষেধ করেছিলাম; সে তা মেনে নিয়েছিল। এখন তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল কর।
আর কোরআন বলবে হে আমার রব, আমি তাঁকে রাতের বেলায় নিদ্রা থেকে নিষেধ করেছিলাম। সে তা শুনেছিলো। (অর্থাৎ রাতের নিদ্রা ভঙ্গ করে তারাবীর নামাজে কোরআন তিলাওয়াত করেছে)। আল্লাহ পাক তখন উভয়ের সুপারিশই কবুল করবেন। ইবনে মাজাহ শরীফের একখানা হাদীসে রাসূল (সঃ) বলেছেন-প্রত্যেক জিনিসের যাকাত রয়েছে। আর শরীরের যাকাত হচ্ছে রোযা। রমজান মাস এমন এক মাস যে, এর প্রথম দশদিন রহমত ও বরকতের বারিধারায় পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় দশদিন ক্ষমা ও মার্জনার জন্য নির্ধারিত এবং শেষ দশদিন জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভের উপায় হিসেবে চিহ্নিত।
এই মাসে মুমিনদের রিযিক প্রশস্ত করে দেয়া হয়। এই মাসে যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে, এর ফলস্বরূপ তাঁর গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে, জাহান্নাম হতে তাঁকে মুক্তি দেয়া হবে এবং তাকে আসল রোযাদারের সমান সওয়াব দেয়া হবে। রাসূল (সঃ) বলেছেন-যে লোক কোন রোযাদারকে একটা খেজুর, দুধ বা এক ঢোক সাদা পানি দ্বারাও ইফতার করাবে, সে লোককেও আল্লাহপাক এই সওয়াব দান করবেন। আর যে লোক একজন রোযাদারকে পূর্ণমাত্রায় পরিতৃপ্ত করবে, আল্লাহপাক তাকে আমার হাওজ হতে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না। বুখারী ও মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে আছে-রোযাদারের জন্য খুশীর সময় দুটি। একটি হলো ইফতারের সময়, আর অপরটি হলো (বেহেশতে) আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। তিরমীযি শরীফের একটি হাদীসে আছে তিন দল লোকের দোয়া আল্লাহ পাক ফেরত দেন না (তিন দলের দোয়া কবুল) তাঁরা হচ্ছেন-রোযাদার ইফতারের সময় যখন দোয়া করে, ন্যায়পরায়ন নেতা বা বাদশার দোয়া এবং মজলুমের দোয়া।
পবিত্র মাহে রমজান শ্রেষ্ঠতম মর্যাদার অধিকারী হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই যে, এই মাসেই পুণ্যময় রাত্রি শবে ক্বদর রয়েছে। দুনিয়ার বুকে এই রাতের মত মূল্যবান রাত আর নেই। এই রাতের মহিমা, মর্যাদা ও গুরুত্ব পরিপূর্ণভাবে অবগত হওয়া মানুষের সাধ্য-শক্তির বাইরে। এই রাতের গুরুত্ব সম্বন্ধে অবগত করানোর জন্যেই করুণাময় আল্লাহপাক পবিত্র কোরআন শরীফে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা অবতীর্ণ করেছেন। এই সুরা উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য এক শ্রেষ্ঠ নিয়ামত ও খোশখবর। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সুরায়ে ক্বদরে বলা হয়েছে-নিশ্চয়ই আমি কোরআন শরীফ ক্বদরের রাতে নাজিল করেছি। আপনি কি জানেন যে, ক্বদরের রাত্র কি? ক্বদরের রাত্র হাজার মাস হতে উত্তম। এই রাত্রে ফেরেস্তামন্ডলী ও রূহ সকল আল্লাহর নির্দেশে পৃথিবীর সর্বত্র অবতীর্ণ হয় এবং প্রভাত পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও ছালামতি বিরাজমান থাকে।
উপরোক্ত সুরার অর্থের দিকে তাকালে কয়েকটি বিষয় দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় যে, লাইলাতুল ক্বদরের রাতেই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। আর ক্বদরের রাত হাজার মাস হতেও উত্তম। এখানে ‘হাজার মাস’ কথাটা উল্লেখ আছে। কয় হাজার তা নির্দিষ্ট নেই। যদি ধরে নেয়া হয় এক হাজার মাস। আর এক হাজার মাস সমান তিরাশি বছর চার মাস। সুতরাং অর্থ হবে তিরাশী বছর চার মাস ইবাদতি করলে যে সওয়াব হয় ক্বদরের রাত্রে ইবাদতি করলে এর চেয়ে বেশী সওয়াব হবে। আর যদি হাজার মাসকে অনির্দিষ্ট ধরে নেয়া হয় তাহলে অর্থ হবে হাজার হাজার মাস বা হাজার হাজার বছর ইবাদত করলে যে সওয়াব হয়, ক্বদরের রাতে ইবাদত করলে এর চেয়ে বেশী সওয়াব হবে। আর আয়াতের মর্মার্থ মূলত ইহাই। অন্য একটি হাদীসে আছে-নিশ্চয়ই পাঁচ রাতের দোয়া আল্লাহর নিকট কবুল, এতে কোন সন্দেহ নেই। এ রাতগুলো হচ্ছে-শবে মেরাজের রাত, শবে বরাতের রাত, শবে ক্বদরের রাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত। হাদীসের মধ্যে আরো আছে-নবী (সঃ) বলেছেন সমস্ত রাত সমূহের মধ্যে ক্বদরের রাতই সর্বোত্তম। অন্য হাদীসে নবী (সঃ) বলেছেন-নিশ্চয়ই আল্লাহপাক ক্বদরের রাত দ্বারা পৃথিবীর রাত সমূহকে সৌন্দর্যমন্ডিত করেছেন।
মোট কথা, পবিত্র মাহে রমজান এর মহিমা, মর্যাদা ও গুরুত্ব অবর্ণনীয় ও অপরিসীম। এই মাস রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস। এই মাসের মহিমা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
পরিশেষে আমরা পরম করুণাময় মহান আল্লাহর নিকট একবাক্যে সর্বদা এই প্রার্থনা করি যে, হে আল্লাহ! আমাদেরকে পবিত্র রমজানের রোযা রাখার তৌফিক দান করুন, আমাদেরকে মাহে রমজানের সকল প্রকার রহমত ও বরকত দান করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে চিরশান্তির বাসস্থান জান্নাত দান করুন। আমিন।
হাফেজ শহিদুল্লাহ মিয়াজী, –
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট : উপদেষ্টা সম্পাদক : পাক্ষিক খবরিকা।