বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০ শ্রাবণ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

বাড়ি ফেরার যুদ্ধ

34072_b2

ঢাকা ছাড়ছেন কর্মব্যস্ত মানুষেরা। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারও ঢাকা ছেড়েছেন লাখো মানুষ। দিনভর ঘরমুখো মানুষের ভিড় ছিল স্টেশনে, টার্মিনালে। কষ্ট, দুর্ভোগকে উপেক্ষা করে নাড়ির টানে ছুটছে মানুষ। রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, প্রথম দিনের চেয়ে ঈদ যাত্রার দ্বিতীয় দিন যাত্রীদের চাপ অনেক বেশি। শুক্রবারেও বেশ কিছু রুটের বাসের টিকিট পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। এদিকে অগ্রিম টিকিট না পাওয়া যাত্রীদের জন্য বিশেষ বাসেরও ব্যবস্থা করেছে বাস মালিক সমিতি। রাজধানীতে চলাচলকারী বেশ কিছু সিটি সার্ভিসের বাস পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন শুরু করেছে। তবে দ্বিতীয় দিনে এসে বিলম্বে বাস ছাড়ার অভিযোগ রয়েছে হানিফ, সোহাগ, ঈগল পরিবহনের মতো বড় বড় বাস কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পরিবহন কাউন্টারগুলো থেকে বলা হচ্ছে, ঈদ যাত্রার প্রথম দিনের অনেক গাড়িই ঢাকায় পৌঁছাতে পারেনি। তাই ঢাকা থেকে বাস ছাড়তে কিছুটা দেরি হচ্ছে। হানিফ পরিবহনের গাবতলী প্রধান কাউন্টারের ম্যানেজার জাকির হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার যেসব গাড়ি ঢাকা থেকে ছেড়ে গেছে তার অধিকাংশই এখনও ফিরে আসেনি। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের গাড়িগুলো। এ গাড়িগুলো ফিরে আসলেই আবার ঢাকা থেকে রওনা হবে। তবে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা দেরি হচ্ছে। সোহাগ পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার মোসলেম উদ্দিন জানান, সকাল থেকে যে গাড়িগুলো ছাড়ার কথা তা নির্ধারিত সময়েই ছাড়ছে। কিছুট দেরি হচ্ছে কারণ আরামবাগ, মালিবাগ, পান্থপথ, কল্যাণপুর, শ্যামলীর যাত্রীদের আলাদা বাসে করে গাবতলী আনা হচ্ছে। সব যাত্রী না পৌঁছানো পর্যন্ত বাস ছাড়া যাচ্ছে না। প্রতিটি বাস ছাড়ার আগে বারবার চেক হচ্ছে সব যাত্রী আসছে কি না। এদিকে অগ্রিম টিকিট না পাওয়া যাত্রীদের জন্য বিশেষ বাসের সুবিধা থাকলেও ভাড়া গুনতে হচ্ছে স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। তানভির নামে অগ্রিম টিকিট না পাওয়া এক যাত্রীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি মাগুরা যাব। সকালে এসে কাউন্টারগুলোয় খোঁজ নিয়ে দেখি কোন টিকিট নেই। পরে টার্মিনালের সামনে দেখি বেশ কিছু বাসের হেলপার পাটুরিয়া ঘাট বলে যাত্রী ডাকছে। এই বাসগুলোর ঢাকার মধ্যে চলে। এমনি বিআরসিটিসহ পাটুরিয়া রুটের বাসের ভাড়া ৬০ টাকা করে। কিন্তু ঈদ উপলক্ষে আমার কাছে দেড় শে’ টাকা ভাড়া চাইছে। ট্রেনে ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শেষ হলেও স্ট্যান্ডিং টিকিটের জন্য ছিল দীর্ঘ লাইন। আসন সংখ্যার বিপরীতে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে রাজধানী ছাড়ছে প্রতিটি ট্রেন। কিছু কিছু লোকাল ট্রেনের ছাদও ছিল ভরা। গতকাল কমলাপুর রেলস্টেশন ঘুরে দেখা যায়, গত ২১শে জুলাই অগ্রিম টিকিট বিক্রির দ্বিতীয় দিন যেসব যাত্রী টিকিট পেয়েছেন তারা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে যার যার গন্তব্যে যাত্রা করেছেন। কিছু কিছু ট্রেনে সিট না পেয়ে ছাদে চড়ে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন অনেকেই। দুপুরে কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় চোখে না পড়লেও যাত্রীদের আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যস্ত ছিল রেলস্টেশন। প্লাটফরমে প্লাটফরমে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে ছিলেন ঘরমুখো মানুষেরা। নির্দিষ্ট সময়ের দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আগেই স্টেশনে এসে ভিড় করেছেন তারা। যথাসময়ে বাড়ি যাওয়ার আশায় রেলস্টেশনে শত শত যাত্রীর চোখেমুখে ছিল আনন্দের ছাপ। অধিকাংশ ট্রেন সঠিক সময়ে ছাড়লেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কিছু ট্রেনের যাত্রীকে ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়। গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত ২৫টি ট্রেনের মধ্যে ৩টি ট্রেন বিলম্বে যায়। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রায় ৫টি ট্রেন বিলম্বে ছাড়ে। রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম জানান, ট্রেন আসতে দেরি হবে এ চিন্তা মাথায় নিয়েই স্টেশনে এসেছেন। কিছুটা দেরিতে হলেও ট্রেনে চেপে বসতে পেরে খুশি বলে জানান তিনি। কমলাপুর রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক খায়রুল বশীর জানান, ট্রেনের সময়সূচি ঠিক রাখার ব্যাপারে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এবার তারা ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঠেকাতে পারছেন। কোন ট্রেনেরই খুব একটা দেরি হচ্ছে না। যাত্রী ভিড় সামলাতে সব ধরনের ব্যবস্থা আগে থেকেই নেয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, শুক্রবার ১৩০টি ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাবে। ঈদে রেল যাত্রীদের ভ্রমণ নির্বিঘ্ন করতে রেল কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা ও চেষ্টার অভাব নেই। সব ট্রেনই নির্ধারিত সময়ে ছাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। কমলাপুর রেলস্টেশন ছাড়াও বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ছিল যাত্রীদের ভিড়। এই স্টেশন থেকে ট্রেনের ছাদে করে ঢাকা ছেড়েছেন অনেক মানুষ। এদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ শ্রমজীবী। সকাল থেকেই বিমানবন্দর স্টেশনে ঘরমুখো মানুষেরা ভিড় করতে থাকেন। অগ্রিম টিকিট না পাওয়ায় স্ট্যান্ডিং টিকিট নিয়ে ট্রেনে উঠছেন অধিকাংশ মানুষ। ট্রেনের ভেতরে সংকুলান না হওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাদে উঠেছেন অনেকে। স্টেশন কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে এ ঘটনা ঘটলেও কোন প্রকার বাধা দেয়া হয়নি। এদিকে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে উপকূল ট্রেনটি নোয়াখালীর উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও, বগি বিকল হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পরও ট্রেনটি কমলাপুর ছাড়তে পারেনি। আর এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। প্লাটফরম মাস্টারের কক্ষে গিয়ে এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জানতে পারেননি যাত্রীরা। উল্টো প্লাটফরম মাস্টার তাদের ধমক দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ যাত্রীদের। একই কারণে স্টেশন মাস্টার ও স্টেশন ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এসেও তাদের পাওয়া যায়নি বলে জানান যাত্রীরা। কোন ট্রেন কখন ছাড়বে এ বিষয়ে তার কাছে কোন তথ্য নেই। স্টেশন মাস্টার নিতাই চন্দ্র জানান, ট্রেনটির একটি বগি বিকল হয়ে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ে ছাড়া সম্ভব হয়নি। তবে ৫টার দিকে ট্রেনটি সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেতে পারে বলে জানান তিনি। এদিকে দিকে আজ থেকে শুরু হচ্ছে ঈদ উপলক্ষে বাড়তি ট্রেন সার্ভিস। কমলাপুর স্টেশন মাস্টার সাখাওয়াত হোসেন জানান, ঈদের পর সাতদিন পর্যন্ত ঢাকা থেকে পার্বতীপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও খুলনার উদ্দেশে তিনটি বাড়তি ট্রেন চলাচল করবে। শনিবার সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে দেওয়ানগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে দেওয়ানঞ্জ স্পোশাল সার্ভিস। এরপর বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে খুলনার উদ্দেশে খুলনা স্পেশাল সার্ভিস এবং বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে পার্বতীপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে পার্বতীপুর স্পেশাল সার্ভিস। রেল কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী, ঈদের সময় এবার বিভিন্ন গন্তব্যের ট্রেনে ১৬৬টি অতিরিক্ত কোচ এবং অতিরিক্ত লোকোমোটিভ সংযোজন করা হবে।
পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বরিশাল বিভাগ ও উপকূলীয় জেলার লোকজন সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। গতকাল সকালে সদরঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাস্তাটি বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। যেন ঘরমুখো মানুষ দ্রুত সদরঘাটে যেতে পারে। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকা সত্ত্বেও প্রচণ্ড ভিড় লক্ষ্য করা গেছে সদরঘাটে। বেলা বেড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকে। তবে গত বছরের চাইতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অধিক সতর্ক অবস্থায় থাকতে দেখা গেছে। পুলিশের পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্যাডেট কোরের সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবকরা দায়িত্ব পালন করছেন। ঘরমুখো মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়েছে। সদরঘাটের আশপাশে মাইক লাগানো হয়েছে। সেখান থেকে ঘরমুখো যাত্রীদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। সম্রাট-২ নামে লঞ্চে যাত্রী আজিজুল ইসলাম জানান, তার গ্রামের বাড়ি বরগুনার আমতলী এলাকায়। একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করি। অফিস থেকে অগ্রীম দুইদিন ছুটি নিয়েছি। তিনি আরো বলেন, ছুটির দিনেও প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়েছে। ধাক্কাধাক্কি করে সদরঘাটের মধ্যে প্রবেশ করেছি। সদরঘাটের মধ্যে আবার হকারদের উৎপাত বেশি। কেউ আবার জোর করে জিনিস ব্যাগের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে টাকা চায়। এতে সাধারণ যাত্রীরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ এদিকে কোন নজর দিচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, অফিসে ব্যস্ত থাকার কারণে টিকিট সংগ্রহের সুযোগ হয়নি। সদরঘাটের প্রবেশপথে দুইজন টিকিটের দালাল আমাকে ঘিরে ধরে। তারা আমাকে জোর করে টিকিট কিনার জন্য বলে। তখন আমি বিষয়টি পুলিশকে জানানোর কথা বললে তারা আমার কাছ থেকে পালিয়ে যায়। এমভি টিপু-৫ নামে লঞ্চের যাত্রী রফিকুল ইসলাম জানান, তার গ্রামের বাড়ি ভোলার চরফ্যাসন এলাকায়। ভিড় ও ধাক্কাধাক্কি করে সদরঘাটের মধ্যে এসেছেন তিনি। ইসলামপুরের রাস্তাটি রিকশা চলাচলের কারণে যাত্রীরা সদরঘাটের মধ্যে প্রবেশে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছে। যোগাযোগ করা হলে ঢাকা নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, সদরঘাট থেকে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাবে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যেন সুষ্ঠুভাবে সদরঘাট থেকে গ্রামের বাড়ি যেতে পারে এজন্য ঢাকা নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ কয়েকটি উদ্যোগ করেছে। তবে কিছু কিছু যাত্রী তাদের বিভিন্ন দুর্ভোগের অভিযোগ আমাদের জানাচ্ছে। তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি বলে তিনি দাবি করেন। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে লালবাগের জোনের পুলিশের ডিসি হারুনুর রশীদ জানান, অজ্ঞান, মলম ও টানা পার্টির সদস্যরা যেন যাত্রীদের মালামাল না নিতে পারে এজন্য পুলিশ সতর্ক আছে। টিকিট কালো বাজারীদের ব্যাপারে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এবছর পুলিশ সতর্ক থাকায় টিকিট কালোবাজারিরা সদরঘাটের আশপাশে।

উৎস- মানবজমিন