বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০ শ্রাবণ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

বন্যার্ত লাখ লাখ মানুষের মানবেতর জীবনযাপন

1_140228

‘বাবাগো মরি যাইগো, হামাক গুলাক বাঁচানগো। দুই সপ্তা থাকি পানিত পড়ি আছি। এমপি চেয়ারম্যান কাইয়ো দ্যাখবার আইসে না। মোর নামটা নেকো বাহে।’ সাংবাদিকদের নৌকা দেখে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের জলঙ্গারকুটি গ্রামের বিধবা জমিলা একবুক পানি পাড়ি দিয়ে এসে দীর্ঘশ্বাসে এসব কথা বলেন।
একই গ্রামের আজাহার আলী, রূপালী বেগম, রোকেয়া, আকলিমা, রহিমা, মনোয়ারা, ময়না জানান ঘরে ঘরে খাদ্য সংকটের কথা। দিনমজুর শ্রেণীর এ মানুষগুলোর হাতে কাজ নেই ১৫ দিন থেকে। হাতে নেই টাকা। ধারদেনা করে চলছে সংসার। একই অবস্থা হাতিয়া ইউনিয়নের গাবুরজান গ্রামে। বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ায় সবার ঘরে সরকারি ত্রাণ পৌঁছেনি। ফলে বানভাসি মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে।
উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ও বুড়াবুড়ি ইউনিয়নে বুধবার গিয়ে দেখা যায় বানভাসি মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ। ঘরে ঘরে খাদ্য সংকট। নেই জ্বালানি ও বিশুদ্ধ পানি। ঘরে মাচা করে কিংবা ভেলায় হচ্ছে রান্না। গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও বাড়ি সবই ডুবে আছে পানিতে। যে দিকে দৃষ্টি যায় পানি আর পানি। এই পানিতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে মানুষ। ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ। নারী ও শিশুদের দেখা দিয়েছে হাতে-পায়ে ঘা। স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় চরম বিপাকে পড়েছে তারা।
এদিকে ২৪ ঘণ্টায় ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, দুধকুমোরসহ জেলার ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জেলার ৫৫ ইউনিয়নের ২৭০টি গ্রামে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৩ লাখ মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু তাহের জানান, বুধবার বিকালে চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া তিস্তায় বেড়েছে ১৭ সেন্টিমিটার ও দুধকুমোর নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ সেন্টিমিটার।
হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন জানান, বুধবার ভোর থেকে হাতিয়া বাজারের কাছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। প্রায় এক হাজার ফিট বাঁধ এখন পানির নিচে। ফলে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে শ্যামপুর, ভাটিগ্রাম, নয়াগ্রাম, কাচারিয়ারঘাট, মিয়াজিপাড়া, কারীপাড়া, চরময়াপাড়া, দীঘলহাল্ল্যাহ, রামরামপুর, বালারচর, উচা ভিটা, দাড়ারপাড় গ্রামের নিুাঞ্চল। সড়ক যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে কদমতলা, গাবুরজান, ভাটিগ্রাম, নয়াগ্রাম, হিজলিপুর, তাঁতিপাড়া, মাঝিপাড়া, সরকারি গ্রাম, দীঘলহাল্ল্যাহ গ্রাম ও বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের পূর্ব প্রান্তের কয়েক হাজার মানুষ।
উলিপুরে তিস্তা নদীর প্রবল সে াতের কারণে চরবজরা বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে পানি ঢুকে বজরা-কাশিম বাজার সড়কের হাঁস খাওয়া ব্রিজসহ ৪শ’ মিটার পাকা সড়ক হুমকির মুখে পড়েছে। পানির চাপে ব্রিজের উত্তর অংশের দুই পাশে ৫০ ফুট সড়কে ফাটল দেখা দিয়েছে। মাটি ধসে যাওয়ায় ব্রিজটি যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ার আশংকা রয়েছে। ৪ দিন ধরে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয় আইয়ুব ও মাইদুলসহ অনেকে জানান, বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষের অসহায়ত্ব ঘিরে চলছে এখন রমরমা দাদন ব্যবসা। হাতে কাজ ও ঘরে খাবার না থাকায় দরিদ্র মানুষগুলো প্রতি হাজারে মাসে ১৫০ টাকা সুদের চুক্তিতে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে।
বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন চাঁদ জানান, বন্যায় ২ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তিনি ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন মাত্র ৩ টন চাল।
জেলা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক প্রতীপ কুমার মণ্ডল জানান, ৪৫টি ইউনিয়ন এবং ২টি পৌরসভার ২৫ হাজার ২৪৭ হেক্টর জমির ফসল পানিতে ডুবে আছে।
কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন জয়নাল আবেদিন জিল্লুর জানান, বুধবার জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৪৮ জন ভর্তি হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় গঠন করা হয়েছে ৮৫টি মেডিকেল টিম।