‘গভীর রাতে হইচই ও চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যায়। জেগে দেখি প্রবল বেগে ঘরে পানি ঢুকছে। দ্রুত ঘরের দরজা খুলে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পাকা রাস্তায় চলে আসি। ঘরে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র, ধান-চাল, ডাল, সন্তানদের বইপত্রসহ সবকিছু ভেসে গেছে। একবেলা খাওয়ার জন্য কিছুই নেই। খোলা আকাশের নিচে ত্রাণের অপেক্ষায় আছি। সরকারিভাবে যে শুকনা খাবার দেয়া হয়েছে তা পাইনি। এখন কিভাবে দিন কাটবে বুঝতে পারছি না’- শুক্রবার দুপুরে সারিয়াকান্দির রৌহাদহ এলাকায় বগুড়া-চন্দনবাইশা সড়কে আশ্রয় নেয়া ৭০ বছরের বৃদ্ধ নবাব মিয়া সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ২টার দিকে যমুনা নদীতে প্রবল স্রোত ও ঘূর্ণাবর্তে সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৩০০ মিটার অংশ ভেঙে যায়। এতে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের হাজারও মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। সবার কণ্ঠেই নবাব মিয়ার মতো হাহাকার।
বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে নদীর পানি সারিয়াকান্দির চারটি ইউনিয়নের ২০ গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী ধুনট, গাবতলী, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, কাজীপুর ও শাহজাদপুরে ঢুকে পড়েছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার হেলাল উদ্দিন, বগুড়ার জেলা প্রশাসক শফিকুর রেজা বিশ্বাস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। কিছুসংখ্যক দুর্গতের মাঝে সামান্য চাল, চিড়া ও গুড় বিতরণ করা হয়েছে। বানভাসী মানুষের মাঝে ত্রাণের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। কোনো নৌকা এলেই তারা সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। ত্রাণের জন্য নাম লেখানোর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী, বন্যা দুর্গত লোকজন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। নদীতে প্রবল স্রোত ও ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়। বৃহস্পতিবার বিকালে পানি বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রাত পৌনে ২টার দিকে কামালপুর ইউনিয়নের রৌহাদহ বাজারের উত্তর পাশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে যায়। এরপর ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করতে থাকে। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত বাঁধের প্রায় ৩০০ মিটার ভেঙে যায়। ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে যমুনা নদীর পানি মানাস খাল হয়ে প্রবল বেগে জনপদে প্রবেশ করে। পানি বাড়িঘরে ঢুকে পড়লে হাঁস-মুরগিসহ গবাদিপশু, চাল, ডাল ও অন্যান্য খাবার এবং আসবাবপত্র মুহূর্তে পানিতে ভেসে যায়। পানিবন্দি হয়ে পড়েন সারিয়াকান্দির কুতুবপুর, কামালপুর, চন্দনবাইশা ও ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। কড়িতলা বাজারসহ আশপাশের পাকা রাস্তা ভেঙে গেছে। শুধু সেতুর উপরের অংশ দেখা যাচ্ছে। দুর্গত এলাকার কাঁচা-পাকা সড়ক, সেতু, কালভার্টগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। আশপাশের বাড়িঘরে হাঁটু থেকে বুক পর্যন্ত পানি। দুর্গতরা ঘরবাড়ি ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন। উপজেলা কৃষি অফিসের সূত্র মতে আউস, আমনসহ ৯ হাজার ২৫০ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।
শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিন বন্যা দুর্গত এলাকায় দেখা গেছে, মানুষজন তাদের গবাদিপশু ও সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন। শত শত মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে বগুড়া-চন্দনবাইশা সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন। সবাই খোলা আকাশের নিচে রয়েছেন। আশপাশের লোকজন নৌকা নিয়ে পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করছেন। ঘরে থাকা ধান, চাল, গম, ডাল ভেসে যাওয়ায় খাবার সংকটে রয়েছেন তারা। দুর্গত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বগুড়া-চন্দনবাইশা সড়কের কয়েকটি স্থান ভেঙে প্রবল বেগে পানি বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে পড়ছে।
রৌহাদহ গ্রামের আলী আজগর ফটিক জানান, সরকারিভাবে যে পরিমাণ ত্রাণ দেয়া হয়েছে তা খুবই অপ্রতুল। আর যেভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে তাতে সবাই ত্রাণ পাচ্ছেন না। ফলে ওই সড়কে গবাদিপশুসহ আশ্রয় নেয়া সহস্রাধিক পরিবারের অনেকেই অনাহারে আছেন। আটবাড়িয়া গ্রামের বৃদ্ধ মানাস ফকির জানান, সবকিছু হারিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন। তার ছেলে রঞ্জু ফকির এবার জেএসসি পরীক্ষা দেবে, কিন্তু বানের পানিতে বইগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। দুপুরে সড়কে বাবা-মার সঙ্গে আশ্রয় নেয়া ২ বছরের শিশু সজনী খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছিল। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জানান, বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এক লাখ ৫০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শুক্রবার দুপুুরে ৪ হাজার পরিবারের ২০ হাজার মানুষের মাঝে চাল, চিড়া ও গুড় বিতরণ করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল মোতালেব জানান, গত ২ মাস ধরে বাঁধটি রক্ষায় তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। কিন্তু ঘূর্ণাবর্তের কারণে বাঁধটি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। বিকালে সারিয়াকান্দির যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তারা জানান, পানি না কমা পর্যন্ত বাঁধ মেরামত করা সম্ভব নয়।
কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ : খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন হাজারও মানুষ। তাদের দুর্ভোগ যখন চরমে তখন বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত নারী-পুরুষ আধুনিক পোশাক পরে ও সেজেগুজে সেখানে যান। ভাঙা বাঁধ আর মানুষের দুর্দশা যেন তাদের কাছে চিত্তবিনোদন। তাদের দেখে বানভাসীরা উপহাস করেন। অন্যদিকে বন্যা দুর্গত এলাকায় প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে। একদিকে মানুষ হাহাকার করছেন অন্যদিকে অনেকে জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন। আবার বন্যার কারণে সড়কগুলো ডুবে যাওয়ায় নৌকা ছাড়া চলাচলের আর কোনো মাধ্যম নেই। এ কারণে নৌকা দিয়ে সেখানে অনেকে ব্যবসা শুরু করেছেন।
সিরাজগঞ্জে রিং বাঁধে ধস : সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কাজিপুর উপজেলার মেঘাই রিং বাঁধের ৩০ মিটার এলাকাজুড়ে ধস নেমেছে। যমুনায় অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির ফলে শুক্রবার সকালে বাঁধে আকস্মিকভাবে ধস নামে। এতে অন্তত ৬০০ বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। এসব অঞ্চলের মানুষ তাদের বাড়িঘরের আসবাবপত্রসহ কোনো কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। আকস্মিকভাবে বাড়িঘরে পানি উঠায় তারা দুপুর পর্যন্ত কোনো খাবারের ব্যবস্থাও করতে পারেনি। এ ছাড়া বাঁধ ভাঙার কারণে যমুনার পানিতে কাজিপুর-সোনমুখী আঞ্চলিক সড়কটিও তলিয়ে গেছে। সড়ক দিয়ে যে কোনো মুহূর্তে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বাঁধ এলাকা পরির্দশন করেছেন।
গাইবান্ধায় ওয়াপদা বাঁধে ফাটল : গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, ঘাঘট নদীর পানির চাপে শহরের পূর্ব কোমরনই মিয়া পাড়ায় ওয়াপদা বাঁধে শুক্রবার সকালে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে বাঁধের ওপর দিয়ে গাইবান্ধা-গিদারী চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। পাউবো বাঁধ রক্ষায় কাজ শুরু করেছে।
উৎস- যুগান্তর