মংলা শিল্প এলাকায় ‘মংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি’র ভেতরে নির্মাণাধীন একটি ভবনের ছাদ ধসে ছয়জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। তিনজনের নাম জানা গেছে। মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে কমপক্ষে ৫০ জন। শ্রমিক ও স্বজনদের দাবি আহত-নিহতের সংখ্যা আরো বেশি।গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। কারখানাটি সেনাকল্যাণ সংস্থার মালিকানাধীন। দুর্ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি করা হয়েছে।গুরুতর আহতদের খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ আবু নাসের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সংকটাপন্নদের ঢাকায় পাঠানোর জন্য সেনাবাহিনীর কাছে হেলিকপ্টার চাওয়া হয়েছে। অন্যদের মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল ও রামপালের ঝনঝনিয়া হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।ধসে পড়া নির্মাণসামগ্রীর নিচে ৩০-৩৫ জন আটকে আছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিকরা দাবি করেছে। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি আটকে পড়া শ্রমিকের সংখ্যা ১৫-১৬ জন হতে পারে। দুর্ঘটনার পরই নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। এলাকার সংসদ সদস্য, খুলনার বিভাগীয় কমিশনার ও স্থানীয় সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে উদ্ধার তৎপরতায় সহযোগিতা করেন।আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ধ্বংসস্তূপ থেকে ইতিমধ্যে ৪৪ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন মারা গেছেন। আহত ৩৮ জনকে মংলা বন্দর হাসপাতাল, রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও খুলনার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা সিএমএইচ, যশোর সিএমএইচ ও খুলনায় নৌবাহিনী হাসপাতাল প্রস্তুত রয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার ও আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দুর্ঘটনা তদন্তে সেনাকল্যাণ সংস্থা একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।মংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরির ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ক্যাপ্টেন সৈয়দ হেলাল হোসেন জানান, ফ্যাক্টরির ভেতরে ৩ নম্বর বল মিল হাউসের নির্মাণকাজ চলছিল। সকালে ছাদের ঢালাই শুরু হয়। প্রায় দেড় শ শ্রমিক এ কাজে অংশ নেয়। দুপুর পৌনে ১টার দিকে হঠাৎ নির্মাণাধীন ছাদ ধসে পড়ে। প্রায় সব শ্রমিক, সুপারভাইজার ও রাজমিস্ত্রি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে। তৎক্ষণাৎ আশপাশে থাকা শ্রমিক-কর্মচারীরা উদ্ধারকাজ শুরু করে।ক্যাপ্টেন হেলাল জানান, কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসে উদ্ধার কাজে অংশ নেন। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া বেশ কিছু শ্রমিককে উদ্ধার করে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে নেওয়া হলে তাদের মধ্যে চারজনকে মৃত ঘোষণা করেন ডাক্তার। তিনজনের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন আমির হোসেন, মোহাম্মাদ মারুফ ও আল আমিন। তাঁদের সবার বাড়ি খুলনায়। ঢালাই কাজে শ্রমিকদের সহকারী আজগর জানান, গতকাল সকালে তাঁরা ৯৫ জন সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজের জন্য খুলনা থেকে যান। পরে আরো দুজন মারা যায়।মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে দুর্ঘটনায় আহত ১৩ জন ভর্তি রয়েছেন। এ ছাড়া রামপালের ঝনঝনিয়া হাসপাতাল, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ আবু নাসের হাসপাতালে ৩৭-৩৮ জনকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়েছে বলে জানান মংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরির ডেপুটি ডাইরেক্টর জেনারেল ক্যাপ্টেন সৈয়দ হেলাল হোসেন। তিনি জানান, সংকটাপন্নদের ঢাকায় স্থানান্তরের জন্য সেনাবাহিনীর কাছে হেলিকপ্টার চাওয়া হয়েছে।শ্রমিক আবদুল বারেক জানান, সব মিলিয়ে দেড় শতাধিক শ্রমিক ঢালাই কাজ করছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে নির্মাণসামগ্রী ধসে পড়ে। প্রায় সবাই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে। দুই-চারজন বেরিয়ে আসতে পারলেও অন্যদের উদ্ধারকর্মীরা বের করে আনেন। ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসা শ্রমিক বারেক হাওলাদার জানান, দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা কর্তৃপক্ষ কম করে বলছে। প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। ঘটনাস্থলে রামপাল-মংলার সংসদ সদস্য তালুকদার আবদুল খালেক ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদের কাছে স্থানীয় ঠিকাদার মো. জাহিদ অভিযোগ করেন, নির্মাণকাজে শিডিউল মোতাবেক নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার না করায় এবং কাজে ত্রুটির জন্য দুর্ঘটনা ঘটেছে।খুলনা অফিস জানায়, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আহত ২৪ শ্রমিককে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রামপাল উপজেলার শিহাব শেখকে (৪০) উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।ভর্তি অন্য শ্রমিকরা হলেন খুলনার বটিয়াঘাটার ভাণ্ডারকোটের নাজিম, এমদাদ, মনসুর; কয়রার এমদাদুল হক; দাকোপের রবিউল, দেবাশীষ; নিরালার মজিদ গাজী; বাগেরহাটের রামপালের মোজাফফর গাজী, মাহফুজুর রহমান, তরুণ চৌধুরী, সামিউল শেখ, রাজু; সাতক্ষীরার আনিস, সাহেব আলী, আল-আমিন, মোমিনুল, লিয়াকত আলী, শহীদুল, ইউনুস; সুনামগঞ্জের মাসুদ; দিনাজপুরের মিজানুর রহমান ও মংলার হৃদয় শেখ।আহত শ্রমিকদের অভিযোগ, পাঁচতলা উঁচু ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের জন্য পর্যাপ্ত সাপোর্ট না থাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। ঢালাইয়ের জন্য ওপরে দুটি মেশিনও ব্যবহার করা হয়। সেসবের ঝাঁকুনি নিচের ভিত্তি সামাল দিতে পারেনি। ঢালাই প্রায় শেষের দিকে ছিল। ধসে পড়া ঢালাইয়ের নিচে আটকে পড়াদের জমাট বেঁধে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তাঁরা।খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আরএমও ডা. মাহবুব আলম ফরাজী বলেন, হাসপাতালে ২৪ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। অধিকাংশ রোগীর হাত, পা ও মাথায় আঘাত লেগেছে। কারো কারো হাত-পা ভেঙে গেছে। নির্মাণাধীন ভবনটির কাজ করছিল চীনের সিএনবিএম নামের একটি কম্পানি। শ্রমিকদের নিয়োগও দেয় তারা।
উৎস: কালেরকন্ঠ