মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

নতুন বেতন কাঠামো: সচিব কমিটির সুপারিশ অর্থমন্ত্রীর হাতে

image_221408.4

 

চার মাস পর জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশনের সুপারিশ চূড়ান্ত করে আজ বুধবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদসচিবের নেতৃত্বে গঠিত ছয় সদস্যের পর্যবেক্ষণ কমিটি। এই সুপারিশ প্রয়োজনে সংশোধন করে তা আগামী সোমবার অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করা হতে পারে। সেখানে অনুমোদনের পর প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আগামী অর্থবছরের প্রথম দিন ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন গত বছরের ২১ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রীর কাছে সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন জমা দেয়। এর ১০ দিন পর ওই সুপারিশ পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণের জন্য মন্ত্রিপরিষদসচিবকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়। পরে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে নেয় কমিটি।অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি চাকরিজীবী, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য বাহিনী এবং উন্নয়ন প্রকল্পে থাকা জনবলসহ মোট প্রায় ২১ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা জাতীয় বেতন কাঠামো অনুযায়ী হয়ে থাকে। তাতে প্রায় শতভাগ বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নতুন কাঠামো বাস্তবায়নে শুধু মূল বেতন বাবদই বছরে অতিরিক্ত ব্যয় হবে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। পাশাপাশি অন্যান্য ভাতা বাবদ দরকার হবে আরো প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। একসঙ্গে এত অর্থের সংস্থান দুরূহ হবে বিধায় আগামী ১ জুলাই থেকে শুধু বর্তমান বেতন-ভাতার সঙ্গে বর্ধিত মূল বেতন এবং পরের অর্থবছরে বর্ধিত ভাতা দেওয়া হবে।তবে আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন কাঠামো কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গে ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে দেওয়া ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা বাতিল হয়ে যাবে। একই সঙ্গে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টও কিছুটা সমন্বয় করা হবে। তাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রকৃত বেতন-ভাতা বাড়বে প্রায় ৬০ শতাংশের মতো। অর্থাৎ এখন যিনি ১০০ টাকা পান, নতুন কাঠামোয় তিনি পাবেন ১৬০ টাকার মতো।চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ১২ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর (বিভিন্ন বাহিনীর লোকবল বাদে) বেতন-ভাতা খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২৩ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। দেশে শিল্প-বিনিয়োগে গতি না থাকায় আগামী অর্থবছর ও পরের অর্থবছরে বেতন-ভাতা বাবদ যে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি দরকার হবে, তার জোগান দেওয়া কঠিন হলেও জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় এটি কার্যকরে কৌশল নির্ধারণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, বর্ধিত বেতন-ভাতার অর্থের জোগান দিতে গিয়ে বড় ধরনের চাপে পড়বে এনবিআর। তবে বেতন-ভাতা বাড়ানো ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো পথ খোলাও নেই।এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতের সঙ্গে তুলনা করলে আগেই তা করা উচিত ছিল। তবে বেসরকারি খাতে অর্থের জোগান যে হারে বাড়ে, বেতন-ভাতাও সে হারে বাড়ে। সরকার এ হিসাবমতো চলতে পারে না।এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, প্রতিবছরই এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু বড় ধরনের ঘাটতিতে অর্থবছরের শেষ সময়ে এসে অনেকটা বাধ্য হয়েই লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়। এতে সরকারের অনেক হিসাব পাল্টে যায়। অনেক পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এনবিআরকে নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে আরো ১৫ হাজার কোটি টাকা জোগানের দায়িত্ব দেওয়ার অর্থ হলো নতুন করে চাপে ফেলা। অবশ্য অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেছেন, নতুন বেতন কাঠামো কার্যকরে অর্থ কোনো সমস্যা নয়। এর প্রস্তুতি আরো আগেই সেরে রেখেছে অর্থ বিভাগ।আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে গিয়ে গতকাল অর্থমন্ত্রী এনবিআরের বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এতে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর করতে যে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হবে, তা কোন কোন খাত থেকে কিভাবে আদায় করা সম্ভব হতে পারে সে বিষয়ে তিনি আলোচনা করেন। এ সময় অপ্রচলিত খাত থেকে আরো বেশি রাজস্ব আদায়ের উপায় বের করার ওপর জোর দেন অর্থমন্ত্রী। একই সঙ্গে আয়করের আওতা বাড়ানো এবং মূসক আইন ২০১২ পুরোপুরি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হলে রাজস্ব আদায় কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এ ছাড়া করদাতার সংখ্যা আরো বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি। রাজস্ব আয় বাড়াতে নেওয়া বিভিন্ন কৌশল বাস্তবায়ন করতে পারলে নতুন অর্থবছরে বেতনের অর্থ জোগানে কোনো সমস্যা হবে না বলে অর্থমন্ত্রীকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।বিদ্যমান ২০টি গ্রেডকে ১৬টি গ্রেডে রূপান্তর করে সর্বনিম্ন গ্রেডে শতভাগ বাড়িয়ে বেতন ৮২০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ গ্রেডেও শতভাগ বাড়িয়ে ৮০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। সচিব কমিটি সর্বনিম্ন গ্রেডের মূল বেতন ৮২০০ টাকা থেকে কিছুটা বাড়ানোর সুপারিশ করছে বলে জানা গেছে। তবে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সংখ্যা প্রায় চার লাখ হওয়ায় সর্বনিম্ন গ্রেডে মূল বেতন সামান্য বাড়ালেও তা মোট ব্যয়ে বড় ধরনের চাপ ফেলবে বলে আশঙ্কা তাদের। তাই এ গ্রেডের মূল বেতন ৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর সুপারিশ করছে সচিব কমিটি। এ ছাড়া ১৩, ১৪ ও ১৫ নম্বর গ্রেডের মূল বেতনও কিছুটা বাড়ানোর প্রস্তাব থাকছে সচিব কমিটির সুপারিশে। তবে ওপরের দিকে সামান্য কমানো হতে পারে।ফরাসউদ্দিনের প্রতিবেদনে টাইমিং স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড প্রত্যাহারের সুপারিশ ছিল। এটি রাখা হবে কি না সে বিষয়ে সচিব কমিটির সদস্যদের মধ্যেও নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে। তবে শেষ পর্যন্ত টাইমিং স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করেই অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কমিটির এক সদস্য। সরকারি চাকুরেদের জন্য সমৃদ্ধ সোপান ব্যাংক নামে একটি বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন ব্যাংক স্থাপনের প্রস্তাব ছিল কমিশনের। তবে অর্থনীতির আকারের তুলনায় দেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় ওই প্রস্তাব আমলে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সচিব কমিটি।নতুন কাঠামোতে বেতন যে হারে বাড়ানোর সুপারিশ রয়েছে, তার চেয়েও বেশি হারে বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশন। বিদ্যমান বেতন স্কেলে মূল বেতনের সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িভাড়া পাওয়ার বিধান রয়েছে। এবারের প্রস্তাবে তা সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার ভেতরে। তবে সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়ায় কোনো কোনো গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এর চেয়েও বেশি হারে বাড়িভাড়া ভাতা পাবেন।এ ছাড়া শিক্ষা ভাতা প্রতি সন্তানের ক্ষেত্রে (সর্বোচ্চ দুই সন্তান) ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার এবং চিকিৎসা ভাতা দ্বিগুণ করে এক হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে কমিশন। সব মিলিয়ে ১ নম্বর গ্রেডের কর্মকর্তারা মাস শেষে বেতন-ভাতা বাবদ এক লাখ ২৭ হাজার টাকা এবং সর্বনিম্ন ১৬ নম্বর গ্রেডের কর্মচারীরা ২০ হাজার ৮০০ টাকা পাবেন। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঝুঁকি ভাতা কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নামাতে আর অবসরে যাওয়া চাকরিজীবীদের উৎসব ভাতা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ ২০০৯ সালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়। ওই বেতন কাঠামো অনুযায়ী বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীদের সর্বনিম্ন মূল বেতন ৪১০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা বহাল রয়েছে।

 

উৎস- কালেরকন্ঠ