শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

তেল তুলতে শ্রমিক নিয়োগ

pic-18_162798
জাহাজডুবিতে সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া তেল অপসারণে শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে বন বিভাগ। নৌকায় করে তেল তোলা শুরু করেছেন ২০০ জন শ্রমিক। তেলমাখা দূষিত কচুরিপানা ও গোলপাতাও সংগ্রহ করছেন তাঁরা। সেগুলো পরে চরে পুঁতে ফেলা হচ্ছে। তবে প্রশিক্ষণ ছাড়াই স্থানীয় লোকজন দিয়ে এভাবে তেল অপসারণ ও দূষিত গাছপালা মাটিতে চাপা দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ম্যানগ্রোভ বনে তেলদূষণ নিয়ে কাজ করেছেন এমন অভিজ্ঞজনরা বলছেন, মানুষের পায়ের চাপে তেল মাটির ভেতর চলে গেলে তা হবে আরো ভয়ংকর। সে ক্ষেত্রে ভূগর্ভেও দূষণ ছড়াবে, দূষিত অঞ্চলে গাছের অঙ্কুরোদ্গম হবে না। মারা যাবে সব ধরনের অণুজীব। ভেঙে পড়বে বনের খাদ্যশৃঙ্খল।
তবে স্বস্তির খবর দিয়েছেন প্রকৃতি ও বন্য প্রাণী গবেষকরা। দুর্ঘটনার চার দিন পর গতকাল শনিবার দুপুরে চাঁদপাই রেঞ্জের মৃগমারী অভয়াশ্রমের কাছে দুটি ইরাবতী ডলফিনসহ আটটি ডলফিনের দেখা মিলেছে। গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, ডলফিনগুলো এখনো সুস্থই রয়েছে। সেগুলোর আচরণও স্বাভাবিক।তবে স্থানীয় জেলেরা আশঙ্কা করছে, তেলের দূষণে বাগদা চিংড়ির অসংখ্য পোনা ও কাঁকড়া মরে নদীতে তলিয়ে গেছে। দুর্ঘটনার পর থেকেই বিস্তীর্ণ এলাকায় ছোট-বড় মাছের পাশাপাশি চিংড়ির পোনা বা কাঁকড়ার সন্ধান মিলছে না। কিছু পাঙ্গাশ, ভেটকি, মেনি ও ফাইস্যা মাছ পাওয়া গেছে অর্ধ মৃত বা মৃত অবস্থায়। নদী ও খালের পাড়ে দূষিত তেল-কাদার ভেতরে দেখা গেছে মরে পড়ে আছে কাঁকড়া। গত শুক্রবার রাতে তীব্র জোয়ার-ভাটার টানে নদীতে আরো তেল ছড়িয়ে পড়েছে। সুন্দরবনের ভেতরে যাতে আরো তেল ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য বনের পাড় জাল দিয়ে ঘেরা শুরু হয়েছে। তবে পানির ওপর ভাসমান তেলের মিশ্রণ এখন কিছুটা পাতলা হয়েছে। তেল তোলায় স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে বন বিভাগ। গতকাল সকাল থেকে ২০০ শ্রমিক কাজে নেমেছেন। তাঁরা নৌকা নিয়ে তেল অপসারণে নেমেছেন। এক নৌকায় দুজন করে শ্রমিক কাজ করছেন। দিনভর তাঁরা বনের মধ্যে, নদীর চরে, ভাসমান তেল, শেওলা অপসারণ করেন। তেল তোলার পাশাপাশি শ্রমিকরা তেলমাখা দূষিত কচুরিপানা ও গোলপাতাও অপসারণ করছেন। বন বিভাগ সেগুলো কিনে পুঁতে ফেলছে।
চাঁদপাই ফরেস্ট অফিসের স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘শেলা নদী পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযান চলবে। শ্রমিকদের দিনে ৫০০ টাকা করে মজুরি দেওয়া হয়েছে। সংগৃহীত তেল তাঁরা বিক্রি করতে পারবেন। তেল মেশানো পানি খেয়ে বন্য প্রাণীর যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সে জন্য আমরা দ্রুততার সঙ্গে অপসারণের কাজ শুরু করেছি।’
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের কর্মকর্তা আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, এলাকাটি ডলফিনের অভয়ারণ্য। এখানে ইরাবতী ও গাঙ্গেয় ডলফিন চলাফেরা করে। দুর্লভ এই ডলফিনের বিচরণক্ষেত্রের ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, এখন আমরা তেলের যে আস্তর দেখা যাচ্ছে তা অপসারণ করতে চাইছি।’
তবে গতকাল কিছুটা স্বস্তির খবর দিয়েছেন ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডাব্লিউসিএস) আবাসিক প্রতিনিধি এবং সুন্দরবনের ডলফিন সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রধান গবেষক রুবাইয়াত মনসুর। গত মঙ্গলবার চাঁদপাই রেঞ্জের মৃগমারীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার পর থেকেই সরেজমিনে সেখানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, অভয়াশ্রমের কাছে গতকাল দুটি ইরাবতী ডলফিন দেখা গেছে। সেগুলোর গায়ে কোনো তেলের ছোপ দেখা যায়নি, আচরণও ছিল স্বাভাবিক। দুপুরে পশুর ও শেলা নদীতে অন্তত ছয়টি গাঙ্গেয় ডলফিনের দেখা মিলেছে। এগুলোর আচরণও স্বাভাবিক ছিল।
বন সংরক্ষক (প্রকৃতি ও বন্য প্রাণী) তপন কুমার দে-ও বলেন, ‘বনকর্মীরা আমাদের খবর দিয়েছেন, চাঁদপাই রেঞ্জের অভয়াশ্রমের ডলফিনগুলো সুস্থ রয়েছে। সেখানে ডলফিনের আহার মাছেরও আনাগোনা রয়েছে।’ তিনি দাবি করেন, গত চার দিনে জোয়ার-ভাটায় তেলের দূষণ অনেকটাই কমতে শুরু করেছে। ভাসমান তেল সমুদ্রমুখী হতে থাকায় বনের ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া নদী ও খালপাড়ের গাছগাছালিতে লেপ্টে থাকা তেলও বারবার জোয়ার-ভাটায় ধুয়ে যাচ্ছে। যদিও দুর্ঘটনার কারণে কোনোমতেই বনের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। জলজ প্রাণীসহ অন্য বন্য প্রাণীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব হয়তো ধীরে ধীরে ধরা পড়বে। মংলার জয়মণি এলাকায় স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে তেল কিনছেন রফিকুল ইসলাম বাবুল। গ্রামবাসী সারা গায়ে দূষিত তেল-কাদা মেখে নৌকা করে ঘটি-বাটি, বালতি-ড্রামে তেল সংগ্রহের পর বিক্রি করছে তাঁর কাছে। রফিকুল বলেন, ‘গত দুই দিনে পাঁচ হাজার ২০০ লিটার করে ফার্নেস অয়েল সংগ্রহ করেছি। প্রতি লিটার কেনা হয়েছে ৩০ টাকা করে। বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) এই তেল আমাদের কাছ থেকে কিনে নেবে।’ তবে তেলমাখা কচুরিপানা ও গোলপাতা পুঁতে মাটিতে ফেলায় এবং তেল পড়ে থাকা অবস্থায় বনের চরে মানুষের হেঁটে বেড়ানো বিপজ্জনক বলে মনে করেন জলাভূমি বিজ্ঞানী রবার্ট লুইস। ম্যানগ্রোভ বন থেকে তেল অপসারণে বিশষজ্ঞ লুইস বলছেন, মানুষের পদচারণে এ তেল মাটির গভীরে চলে যাবে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়ায় সেখানে আর কোনো উদ্ভিদের জন্ম হবে না। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের অন্যতম সদস্য ড. হিথার কোল্ডওয়েও একই মত দিয়েছেন। নদীতে ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েল অপসারণে শ্রমিক ও স্থানীয় লোকজন ব্যবহার করার উদ্যোগের বিষয়েও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এতে চর্মরোগ ছড়িয়ে পড়াসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে মানুষের।
তেলদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ রাসায়নিক নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আসা উদ্ধারকারী জাহাজ কাণ্ডারি-১০ গতকালও অলস বসে ছিল। কারণ এখনো সেই রাসায়নিক ছড়ানোর অনুমতি মেলেনি। তেলের দূষণে শেলা নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা রাসায়নিক প্রয়োগ করার পক্ষে নন। তাঁরা বলছেন, ম্যানগ্রোভ ও ব্রাকিশ ওয়াটারের (স্বাদু ও মিষ্টি পানির মিশ্রণ) নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণে দ্রুত এই দূষণ কাটিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। যতটা বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হয়েছিল, ততটা বিপর্যয় ঘটবে না। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তদন্তদলও দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছে।
১০ হাজার বনজীবী কাজ হারিয়েছে : তেলদূষণের কারণে শেলা নদীসংলগ্ন এলাকার কমপক্ষে ১০ হাজার বনজীবী কাজ হারিয়েছে। মূলত মাছ ধরেই তাদের সংসার চলত। বন বিভাগের অনুমতিপত্র নিয়ে সুন্দরবনের ভেতরে নদী-খালে মাছ ও কাঁকড়া ধরতেন তাঁরা। জয়মনি এলাকার দুলাল শেখ ও নাজমুল হোসেন বলেন, ‘তেল ছড়িয়ে পড়ায় নদীতে জাল ফেলতে পারছি না। জালে তেল আটকে যাচ্ছে, জালের ক্ষতি হচ্ছে। মাছও মিলছে না।’
একই এলাকার এনামুল বলেন, ‘কাঁকড়া মরছে। কাঁকড়া সাধারণত নদীর চরে গর্ত করে বাসা বাঁধে। তেলের আস্তরণের কারণে অনেক কাঁকড়া গর্তে আটকা পড়েছে। আবার যে কাঁকড়া মাটিতে উঠতে পেরেছে তার গায়েও তেল লেগেছে। সেগুলো মরে যাচ্ছে। চাষের ঘের দেওয়ার জন্য ৩০০ কাঁকড়া সংগ্রহ করেছিলাম, একটাও বেঁচে নেই।’
মাস্টারের খোঁজ নেই : ডুবে যাওয়া ওটি সাউদার্স স্টার-৭-এর মাস্টার মোখলেসুর রহমানকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বজনরা শেলা নদীর পারে তাঁর লাশের অপেক্ষায় আছে। মরদেহের খোঁজে গতকালও স্থানীয় লোকজনকে তারা বনে পাঠিয়েছিল। মোখলেসুরের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা গ্রামে। দুর্ঘটনার খবর শুনে ঘটনাস্থলে এসেছেন তাঁর ছোট ভাই খোরশেদ আলম মোর্তুজা এবং মেয়ের জামাই শহীদুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান। মোর্তুজা বললেন, মোখলেসুরের সহকর্মীদের কাছে তিনি শুনেছেন, ‘দুর্ঘটনার পর অন্যদের সঙ্গে তাঁর ভাইও নদীতে লাফ দেন। তবে কিছু দূর সাঁতরে যাওয়ার পর তিনি আবারও জাহাজের দিকে ফিরে যান। সঙ্গীকে বলেছিলেন, জাহাজের এ অবস্থায় আমার চলে যাওয়া ঠিক হবে না। তারপর থেকেই তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।’
তেলে ক্ষতি হবে না : পরিদর্শন শেষে দাবি নৌমন্ত্রীর : এদিকে নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনের বন ও জলজ প্রাণীর তেমন ক্ষতি হবে না বলে মন্তব্য করেছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গতকাল খুলনা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, ‘আমি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি, এতে তেমন ক্ষতি হবে না। ফার্নেস অয়েলের বদলে ডিজেল বা পেট্রল হলে অনেক ক্ষতি হতো। ফার্নেস অয়েলের রাসায়নিক ক্ষতির প্রভাব কম। এ ছাড়া এখন বর্ষাকাল হলে নদীর জোয়ার বেশি হতো এবং তেল বেশি অঞ্চলে ছড়িয়ে তাতে আরো বেশি ক্ষতি হতো। তবে তা না হওয়ায় তেমন ক্ষতি হবে না।’ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা খবরটি একটু পরে জেনেছি। তবে আমরা জেনেই যথাসম্ভব পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করেছি।’ তিনি শেলা চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কটকা-সুপতি চ্যানেলটি ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ঘটনাস্থলে তদন্ত কমিটি : পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি দলটি গতকালও দুর্ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করে। কমিটির সদস্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ‘আমরা যে পরিমাণ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছিলাম, বিপর্যয় তেমন হবে না। ম্যানগ্রোভ ও ব্রাকিশ ওয়াটারের নিজস্ব ক্ষমতাবলে এ দূষণ কেটে যাবে। তবে শেলা ও সংলগ্ন নদী-খালের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। এ কারণে আমরা চাইছি না তেল অপসারণে রাসায়নিক পদার্থ ছিটানো হোক।’ সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের কর্মকর্তা আমীর হোসেইন চৌধুরী বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর এই রাসায়নিকটির মান পরীক্ষা করে দেখছে। ফলাফল ইতিবাচক হলে সেটি প্রয়োগে আমাদের আপত্তি থাকবে না।’
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার ভোরে তেলবাহী জাহাজ ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি জাহাজের ধাক্কায় শেলা নদীতে ডুবে যায়। সাউদার্ন স্টারে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল ছিল। যার বেশির ভাগই নদীতে ছড়িয়ে পড়ে।