গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষায় আগের অবস্থানে ফিরে আনার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমাদের মালিকানার ব্যাংক আমাদের বাদ দিয়ে সরকার নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ব্যাংকের কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই। অথচ বেশির ভাগ ব্যাংকেই এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। সরকার যে ভাবে আমাদের ব্যাংক নিয়ে যাচ্ছে এতে হানাহানি বাড়বে। গরিব মানুষের জন্যই গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যে লক্ষ্য নিয়ে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তা ভেস্তে যেতে পারে না। এতগুলো লোকের ইচ্ছাকে তলিয়ে যেতে দিতে পারি না। গ্রামীণ ব্যাংক
রক্ষার সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। গতকাল ‘সোশ্যাল বিজনেস ডে’ উপলক্ষে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। সম্মেলনে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা, অস্ট্রেলিয়া, মিশর, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত, জাতিসংঘের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টরসহ বিশ্বের ৩১টি দেশের ২৭৫ জন অতিথি যোগ দেন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি।
অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস বলেন, সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য নতুন আইন পাস করেছে। এই আইনের মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন হলে গ্রামের নারীদের প্রতিনিধিত্বশীল যে পর্ষদ রয়েছে তা আর থাকবে না। এর ফলে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ড. ইউনূস বলেন, বেকারত্ব সব জায়গায় রয়েছে। কিন্তু একজন মানুষও বেকার থাকবে না- এটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করছে সোশ্যাল বিজনেস। তিনি বলেন, আমরা চাকরিপ্রার্থী হিসেবে শিক্ষার্থীদের তৈরি করছি, মানবিক গুণাবলীর অধিকারী হিসেবে নয়- এটি লজ্জার। এর কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাই ভুল। তিনি বলেন, শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই ধারণা বিরাজ করছে। বর্তমান অর্থনীতি আমাদের সঙ্গে যে ব্যবহার করছে তাতে আমরা হতাশ। তরুণরা আরও বেশি হতাশ। এই হতাশা থেকেই আমরা সোশ্যাল বিজনেসের উদ্যোগ নেই। ড. ইউনূস জানান, আগামী বছর এটি আরও বড় আকারে হবে। বর্তমানে ২২৮টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কাজ করছে ২১০টি।
ইউনূস বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক এখন দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্য কাজ করছে। প্রথম প্রজন্মের ঋণগ্রহীতার সন্তানদের উদ্যোক্তা তৈরির কাজ করছে এ ব্যাংকটি। আমরা দ্বিতীয় প্রজন্মকে বলছি, আমরা চাকরি করবো না, আমরা চাকরি দেবো। এজন্য প্রতি মাসেই আমরা তাদের কাছ থেকে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা পাচ্ছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই শেষে তাতে অর্থায়ন করা হচ্ছে। এগুলো দেখে আমরা উৎসাহিত হচ্ছি। তিনি বলেন, তরুণেরা যখন ব্যবসার উদ্যোগ নিয়ে আসেন, তখন আমরা খুব অনুপ্রাণিত হই। সামাজিক ব্যবসা দিয়ে সামাজিক সমস্যা দূর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তরুণদের স্বপ্ন ও উদ্যোগ নিয়ে বেকারত্ব দূর করতে হবে। ড. ইউনূসের মতে, পৃথিবীতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে যখন বেকারত্ব বলে কিছু থাকবে না। সুস্থ শরীরের একজন মানুষ বেকার থাকবে, এটা হতে পারে না।ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের দর্শনকে আমি ভালবাসি। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ ব্যাংকে গিয়েছি। যেখানেই গিয়েছে আমি গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যাজিক দেখেছি। শিক্ষাবঞ্চিত মানুষদের ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিভাবে দক্ষ কর্মশক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন তা দেখেছি। ড. ইউনূস বেকারত্ব ঘোচাতে এখন নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন।
সম্মেলনে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক তাহসিনা খাতুন বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য পরিচালকদের না জানিয়ে নীতিমালা পরিবর্তন করেছে। ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের সদস্য নির্বাচনের নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালকদের বিরুদ্ধে কোন দুর্নীতির অভিযোগ ছিল না। সরকারের এ নীতির কারণে ব্যাংকটিতে রাজনৈতিক দলাদলি ও হানাহানি ছাড়িয়ে পড়বে। তাহসিনা খাতুন বলেন, তিনি ১০ বছর আগে ব্যাংকটির গ্রুপ সদস্য হন। এর পর ক্রমাগত সাফল্যের ধারায় পরিচালক নির্বাচিত হন। আজ এ ব্যাংক নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে।
পঞ্চমবারের মতো পালিত হওয়া সোশ্যাল বিজনেস ডে’র অনুষ্ঠানটি ৮৯টি দেশ সরাসরি দেখছে বলে জানানো হয় অনুষ্ঠানে। ইউনূস সেন্টার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ‘আমরা চাকরিপ্রার্থী নই, চাকরিদাতা’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে এবারের সোশ্যাল বিজনেস ডে পালিত হয়। এবার বিজনেস ডে কর্মসূচিতে গ্রামীণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও সিইও এন্ড্রিয়া জাং, যুক্তরাষ্ট্রের স্টোনিফিল্ড ফার্মসের সিইও গ্যারি হার্শবার্গ ছাড়াও চীন, ফ্রান্স, জাপান, ভারত, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র, হংকং, কম্বোডিয়া, কাজাখস্তান, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া, সুইডেন, ইতালি, বাহরাইন, সেনেগাল, কলম্বিয়া, ভিয়েতনামের প্রতিনিধি দল এবং গ্রামীণ ক্রেডিট এগ্রিকোল সংস্থা থেকে ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল যোগ দেন।
বেকারত্বকে উদ্যোক্তা হিসেবে রূপান্তর করাই হবে এবারের বিজনেস ডে’র লক্ষ্য। এতে ছয়টি প্যানেল আলোচনা হয়। এর মধ্যে বেকারত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ: গ্রামীণ কোম্পানিসমূহের নবীন উদ্যোক্তা উদ্যোগ, ক্রাউড ফান্ডিং, সোশ্যাল বিজনেস ইন মার্কেটিং, এরপরে কি আসছে বিষয়ক প্যানেল সেশন ছিল।
সারা বিশ্বে সোশ্যাল বিজনেস ডে সমপ্রসারিত হচ্ছে। বিশেষ করে আফ্রিকান ডেললপমেন্ট ব্যাংক তিউনিসিয়া, উগান্ডাতে সোশ্যাল বিজনেস মুভমেন্ট নামে একটি পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এ প্রকল্প সোশ্যাল বিজনেস ডে সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করছে। ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্যোগে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।