বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, অতি দ্রুত বিএনপি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। তিনি জানান, এই দাবিতে আন্দোলনের জন্য সবকিছু গুছিয়ে নিই। অচিরেই নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উদ্দেশে বলেছেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেই তাঁরা আসন ভাগ করে নিয়েছেন। বিএনপিকেও এক ভাগ দিতে চেয়েছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ভোট ভাগাভাগি চাইনি। সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছি।’
ভাষার মাসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সরস্বতী পূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য শুরু করেন খালেদা জিয়া। বক্তব্যে তিনি সারা দেশে দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে ও পরে এক মাসে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ২১ জন নেতা-কর্মীকে গুম করা হয়েছে। আর ওই সময়ে সারা দেশে নির্বাচনী সহিংসতায় ৩০০ জন নেতা-কর্মীকে খুন ও গুম করা হয়েছে। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বক্তব্যে আরও বিভিন্ন প্রসঙ্গ আসে। বক্তব্য শেষে তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
গুছিয়ে নিতে সময় লাগবে
বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি অতি দ্রুত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। কত দ্রুত—জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, সময়ে সব দেখা যাবে। এ সময় সাংবাদিকেরা জানতে চান, কবে নাগাদ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৯ দল সক্রিয় আন্দোলনে যাবে? উত্তরে তিনি জানান, বিএনপিকে সমাবেশ, মিছিল করতে জায়গা দেওয়া হচ্ছে না। কয়েক দিন আগেও রাজধানীতে মিছিলের অনুমতি পায়নি বিএনপি। তিনি বলেন, দলের অনেক নেতা-কর্মী কারাগারে। অনেকে মারা গেছেন। তবে তিনি বলেন, ‘এ অবস্থা বেশি দিন চলবে না। সবকিছু গুছিয়ে নিই। অচিরেই নতুন কর্মসূচি দেব।’
খুন, গুমের হিসাব
খালেদা জিয়া অভিযোগ করে বলেন, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের তালিকা করে বেছে বেছে খুন, গুম, করা হচ্ছে। পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। দেশকে হত্যাকাণ্ডের এক আতঙ্কিত জনপদে পরিণত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, খুনি সন্ত্রাসীদের ছেড়ে দিয়ে দেশের কারাগার ভরে ফেলা হয়েছে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দিয়ে। একেকটি ঘটনায় হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করে মামলা করা হচ্ছে। সেসব মামলায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের কারাগারে নেওয়া হচ্ছে।
এক মাসে ৩০০ নেতা-কর্মী খুন ও গুম
খালেদা জিয়া নির্বাচনী সহিংসতায় বিভিন্ন জেলায় নেতা-কর্মীদের কতজন নিহত হয়েছেন, তার পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, খুন ও গুম হওয়া বেশির ভাগ নেতা-কর্মী জামায়াত-শিবিরের। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে এক মাসে সারা দেশে তত্কালীন ১৮-দলীয় জোটের ৩০০ জন নেতা-কর্মীকে খুন ও গুম করা হয়েছে বলে জানান বিএনপির চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, ওই এক মাসে ঢাকায় বিএনপি ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের ২১ জন নেতাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলেছে।
এশিয়া কাপে জাঁকজমক না করার আহ্বান
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ওই দিন এশিয়া কাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। তিনি বেদনাবিধুর ওই দিনে অনুষ্ঠানে কোনো জাঁকজমক না করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।
ভোটবঞ্চিত মানুষ জবাব দেবে
বিএনপির নেতা বলেন, ভোট ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষ অপেক্ষায় আছে। তারা উপযুক্ত জবাব দেবে। বিএনপি একদলীয় বাকশালী শাসন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র এনেছে, উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপি বিভিন্ন কর্মপন্থা নিরূপণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অন্যায় ও অবৈধ শাসনকে প্রলম্বিত করা সম্ভব নয়। জনগণ দীর্ঘদিন স্বৈরাচার মেনে চলবে না। বিএনপিও অনির্দিষ্টকাল ধরে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে যাবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তিনি সময় থাকতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তামাশার সংসদ
বিএনপির নেতা বলেন, নির্বাচিত বলে গণ্য ব্যক্তিদের দিয়ে গঠিত সরকার গণতান্ত্রিক হতে পারে না। এটা তামাশার সংসদ। তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই। এক ব্যক্তি ও এক দলের স্বৈরশাসন জাতির কাঁধে চেপে বসেছে। কারসাজির মাধ্যমে এটা করা হয়েছে। খালেদা জিয়া বলেন, বর্তমান সরকার ইচ্ছামতো সংবিধান বদল করে সেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে বিনা ভোটে ক্ষমতা দখল করেছে। এই সরকার জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। খালেদা জিয়া বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর জনগণ বুঝে গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি কত সঠিক ছিল। তিনি বলেন, এই সরকার ও সংসদ বৈধ জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হয়নি। এই সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার কেউ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি। তাঁরা কেউ নির্বাচিত নন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অস্ত্রের ওপর ভর করে আছে সরকার
খালেদা জিয়া বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে প্রহসনের আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, সরকার যদি জনগণের কথা ভাবত, তাহলে তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করত। কিন্তু তারা বাস্তবতা থেকে দূরে গিয়ে সন্ত্রাস ও অস্ত্রের ওপর ভর করে অবৈধ শাসনকে প্রলম্বিত করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। খালেদা জিয়া আরও বলেন, তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে হুমকি-ধমকি দিয়ে চলেছে। তারা ক্ষমতায় টিকে থাকার অপকৌশল গ্রহণ করেছে। এভাবে তারা সংকটকে আরও গভীর ও প্রলম্বিত করছে।
দুর্বলের প্রতিশোধ ভয়ংকর
খালেদা জিয়া বলেন, দুর্বলের প্রতিশোধ ভয়ংকর। পরাজয়ের গ্লানি ভয়াবহ। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে। তারা একদিকে রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালাচ্ছে, অপরদিকে দলীয় সন্ত্রাসীদের সারা দেশে লেলিয়ে দিয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদন
খালেদা জিয়া দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদন তুলে ধরেন। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বক্তব্য ও হিসাব তুলে ধরেন।
দমন, পীড়ন বন্ধের দাবি
বিএনপির চেয়ারপারসন দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হয়রানি বন্ধ করার দাবি জানান। বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে সশস্ত্র আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানান।
সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেত
নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না, সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে খালেদা জিয়া বলেন, নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তিনি বলেন, এই সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না, তা প্রমাণিত হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেত বলে মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া।
২৯ ডিসেম্বর সরকার ভয় পেয়েছিল
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ২৯ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কর্মসূচি দেখে সরকার ভয় পেয়েছে। তিনি বলেন, যদি সরকার বাধা না দিত, তাহলে সেদিন জনস্রোত বয়ে যেত।তিনি বলেন, ‘ওই দিন আমাকে ও আমাদের কর্মসূচিকে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল।’
কারও ডিকটেশনে বিএনপি চলে না
‘জামায়াত ছাড়লে সংলাপ হবে’ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এই আহ্বানের ব্যাপারে সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা কাদের সঙ্গে থাকব, না-থাকব সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত। কারও ডিকটেশনে বিএনপি চলে না।
উৎস- প্রথমআলো