প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জনপ্রশাসন নীতিমালা ভঙ্গ করে সরকারের যেসব কর্মকর্তা গুলশানে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগেও এ ধরনের গোপন বৈঠকের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রী কেনইবা মধ্যরাতে চুপ্পি চুপ্পি এ ধরনের বৈঠকের নামে অভিসার করেন, জাতি জানতে চায়। তিনি বলেন, বিএনপি নেত্রীর এই যে গভীর রাতে চুপকে চুপকে দেখা করা… এটা কেন। একটা সিনেমা আছে না… চুপকে চুপকে।
তিনি বলেন, মানুষের মনে যখন শান্তি থাকে, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার তাতে ‘অশান্তি’ হয়। বিএনপি নেত্রীকে বলব, তিনি যেন এই রাতের অভিসারটা বাদ দেন, যা করার দিনের আলোতে করেন, তা সবার জন্যই ভালো হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, এত রাতে বৈঠক কেন।
সম্প্রতি নেপালে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলন ও মালয়েশিয়ায় তিনদিনের গুরুত্বপূর্ণ সফরের অর্জন তুলে ধরতে গতকাল বিকালে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে প্রতিদিনের সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়ালের সাম্প্রতিক সফরের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, কোনো একটি দেশ পাশে না থাকলে আমরা মরে যাব না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির বিরোধিতার পরও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হতে পারে, তাহলে এখন কোনো একটি দেশকে পাশে না পেলেও বাংলাদেশের সমস্যা হবে না। আর কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলেই একটি দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে বলেও তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যেও বাংলাদেশের বন্ধু রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেরও চরম বিরোধিতা করেছে কিন্তু নির্বাচন সফল হয়েছে। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ৪০ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও এই ভোট পড়ে না। আর যারা নির্বাচনের বিরোধিতা করছেন তাদের বলছি, নির্বাচন না হলে থাইল্যান্ডের মতোই কোনো সামরিক সরকার কিংবা ওয়ান-ইলেভেনের মতো বিতর্কিত সরকার আসত নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে। তাতে কী জনগণ শান্তিতে থাকত? দেশের উন্নয়ন হতো? ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কারণেই আমরা উন্নয়ন কাজের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছি। শেখ হাসিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন, তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। কেউ যদি কোনো মতামত দিয়ে থাকেন তাহলে সে দায়িত্ব তার। তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল, আর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের নির্দেশেই তা করা হয়েছিল বলে শোনা গেছে। আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সারা বিশ্ব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার প্রমাণ পায়নি।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেত্রীর গুলশান কার্যালয়ে মধ্যরাতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎ; যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তানসহ সরকারের কূটনীতিতে পূর্ব-পশ্চিমের প্রভাব; ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, টিআইবির প্রতিবেদন ও ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডসহ নানা ইস্যুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর দুইপাশে মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন প্রবাসী কল্যাণবিষয়কমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী প্রমুখ।
সরকারের চলমান কূটনীতি পূর্বমুখী কিনা, পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের পুনমর্ূল্যায়ন কিংবা স্থগিত করবেন কিনা এসব প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। আমরাও তাই বিশ্বাস করি। আর আমাদের মনে রাখতে হবে, কূটনীতিতে পূর্ব-পশ্চিম কিংবা উত্তর-দক্ষিণ বলে কিছু নেই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে কারও সঙ্গে সম্পর্ক যদি আরও গভীর করতে হয়, তা করব। তা ছাড়া পৃথিবীটা গোল। আমরা পশ্চিমদিকে সিজদা দেই কিন্তু লন্ডনে কোন দিকে সিজদা দিতে হয়?
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানও বাংলাদেশের বিজয় মেনে নিয়েছিল এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্কের জায়গায় কূটনীতি থাকবে তবে পাকিস্তানের কাছে আমাদের চাওয়ার কিছু নেই।
সরকার পতন প্রশ্নে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার আন্দোলনের ঘোষণা সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলে শেখ হাসিনা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতেই সরকার পতনের হুমকি। খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে পারেননি বলেই তো তার মনে এত আক্ষেপ। ৫ জানুয়ারি যদি নির্বাচন না হতো তাহলে তো ওই যুদ্ধাপরাধীরা কারাগার থেকে বেরিয়ে আসত। উল্টো কচুকাটা করত। আর এখন তো তাদের রায়ের বিচার কার্যকর হচ্ছে। তিনি বিএনপি নেত্রী ও তার দলের নেতাদের উদ্দেশ করে বলেন, তারা তো কত কথাই বলে। তারা তাদের কথা বলুক আর আমাদের কাজ আমরা করে যাব, তা হলো জনগণের কল্যাণ করা।
টিআইবির প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা আরও বেড়েছে এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টিআইবি কেন হঠাৎ সরব হলো, রিপোর্ট প্রকাশ করল? টিআইবির আসল উদ্দেশ্য কী সেটিও ভাবা দরকার। এর আগেও দেখেছি একটি বিশেষ সময়কে সামনে রেখে টিআইবি রিপোর্ট প্রকাশ করে। প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশে কী সামরিক সরকারের আমলে দুর্নীতি কমেছে। তারাই তো দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে। টিআইবি শুধু মুখে বললে হবে না, ব্যাখ্যা দিয়ে বলুক কোথায় কিভাবে দুর্নীতি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সরকারে আছি। আমরা কোনো দুর্নীতি করেছি কিনা, সেটি দেখুন। বিএনপি সরকারের আমলে কিভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে একবার ভাবুন। বিএনপি সরকারের আমলে কোনো খাতেই তারা উৎপাদন বাড়াতে পারেনি, কমিয়েছে। বেড়েছিল দুর্নীতি। ২০০১ সালের আগে বিএনপি নেতাদের কত টাকার সম্পদ ছিল আর পরে কত টাকার মালিক হয়েছে- কেউ তো তাদের নিয়ে লেখেন না। যারা দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তাদের সম্পদের উৎসও খতিয়ে দেখা হবে। সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে।
টিভি টকশোতে সরকারি দলের নেতাদের সরকারের উন্নয়ন বন্দনা আর প্রধানমন্ত্রীর স্তুতিবাক্য কী বাধ্যতামূলক বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, তাহলে সরকারের উন্নয়নের কথা বলা যাবে না, এই তো! সরকার উন্নয়ন করলে গর্বের সঙ্গেই সরকারি দলের নেতা, মন্ত্রী-এমপিরা তো বলবেই। কারণ তারাও তো এই উন্নয়নের অংশীদার। আর জিয়া অর্ফানেজ চ্যারিটি ফান্ডের টাকা আত্দসাতে যখন বেগম জিয়া অভিযুক্ত হন তা নিয়ে তো কাউকে টকশোতে কথা বলতে শুনি না। কথা বলার সাহস রাখেন না। এই যে রাত জেগে টকশোতে কথা বলা এটি তো আমিই করে দিয়েছি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুমতি দিয়ে। ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার আমলেই তার ছাত্র সংগঠনের কেউ বিতর্কে জড়ালে কিংবা সন্ত্রাস করলে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায়ও কে কার ভাগ্নে কিংবা জামাই আমরা তা না দেখে ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রশ্নপত্র ফাঁস সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব সময়ই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। তবে কয়েক সেট প্রশ্নপত্রের মধ্যে যে সেট ফাঁস হচ্ছে তার বিকল্প সেট দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি সরকারের আমলে ফাঁসের আগেই দলীয় ক্যাডারদের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দেওয়া হতো।