নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয় ঘেরাওকালে শক্তিশালী হাতবোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১১ জন। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনার পর কর্মসূচিতে আসা কর্মীরা গুলশান-২ এলাকার মার্কেটে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে ৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ। কর্মসূচি থেকে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে বলেছেন, হরতাল অবরোধ প্রত্যাহার না হলে কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
গতকাল সকাল ১০টা থেকেই খালেদা জিয়ার কার্যালয় ঘেরাওয়ের জন্য গুলশান-২ নম্বরের গুলশান সেন্ট্রাল পার্কে জড়ো হতে থাকেন আওয়ামীলীগপন্থি শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। রাজধানী ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে বাস ও ট্রাকে করে কয়েক হাজার শ্রমিক আনা হয়। তারা বনানী এলাকায় সড়কের দুই পাশে যানবাহনগুলো পার্ক করে হেঁটে পার্কের সমাবেশ যোগ দেন। বেলা ১১টার দিকে প্রায় কয়েক হাজার লোকের সমাগম হয়ে যায়। সেখানে একটি মিনি ট্রাকে মঞ্চ বানিয়ে শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের ব্যানারে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে বেলা ১২টা ৫ মিনিটের দিকে গুলশান সেন্ট্রাল পার্ক থেকে খালেদা জিয়ার কার্যালয় ঘেরাওয়ের উদ্দেশে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রওনা হন নৌমন্ত্রী। বেলা ১২টা ১০ মিনিটে যখন মিছিলের অগ্রভাগ গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বর পেরিয়ে যায় ঠিক তখনই পেছনের ভাগে পরপর দুটি শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। একটি বোমা বিস্ফোরিত হয় গুলশান সেন্ট্রাল পার্কের সামনে। আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয় গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বরস্থ মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজার সামনে। দুটি বোমাই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। মার্কেটের সামনে বিস্ফোরিত বোমায় অন্তত ১১ জন আহত হন। এ সময় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলটি। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গুলশান-২ এলাকায়। উত্তেজনা তৈরি হয় মিছিলকারীদের মধ্যে। প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিক লীগ নেতা কাওসার জানান, আমরা মিছিল নিয়ে গুলশান সেন্ট্রাল পার্ক থেকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে যাচ্ছিলাম। মেট্রোপলিটন মার্কেটের সামনে যাওয়া মাত্রই ওপর থেকে একটি বোমা ছোড়া হয়। বোমাটি আমার কয়েক গজ সামনে আমাদের এক কর্মীর গায়ে বিস্ফোরিত হয়। এ সময় রক্তাক্ত অবস্থায় বেশ কয়েকজন হামাগুড়ি দিয়ে মার্কেটের বারান্দা গিয়ে উঠেন। এরপর আমি দ্রুত সেখান থেকে সরে যাই। ওদিকে মিছিলে অংশ নেয়া যুবলীগকর্মী রমজান জানান, বিস্ফোরণের সময় মিছিলটি দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। সামনের অংশটি ছিল আলম মার্কেটের সামনে। পেছনের অংশটি তখন মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজার সামনে। বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটলে মিছিলের দুটি অংশই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিস্ফোরণস্থল ঘিরে রেখেছে মহানরগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)’র বোমা বিশেষজ্ঞ দল। সেখানে একটি দুধের কৌটার অংশ, হাড়ের টুকরো ও রক্ত পড়ে আছে। রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল স্যান্ডেল ও ভাঙা ইটের টুকরো। জমাট বাঁধা রক্তের চিহ্ন ছিল মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজার বারান্দাতেও। ডিবির বোমা বিশেষজ্ঞ দলের পরিদর্শক আজিজুল হক মিয়া জানান, বোমাটি সাধারণ ককটেলের চেয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। এটি একটি হাতবোমা। এতে ল্যাকটোজেন দুধের কৌটা ব্যবহার করা হয়েছে।
বিস্ফোরণের পরপর আতঙ্কে মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজায় আশ্রয় নেন অনেক নারী-পুরুষ। তাদের মধ্যে ছিলেন একটি ফুড কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি কায়সার আহমেদ। কায়সার জানান, বিকট শব্দে ককটেল বিস্ফোরণের পরপর মানুষের চিৎকার ও কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তবে আতঙ্কে তিনি পেছনে না তাকিয়ে দ্রুত ওই মার্কেটে আশ্রয় নেন। এমনকি মিছিলকারীদের অনেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজায় ঢুকেন।
বোমা বিস্ফোরণের পরপরই মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজায় ব্যাপক ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এসময় মার্কেটে অবস্থিত তিনটি ফাস্টফুডের দোকান বিএফসি, ওয়েল ফুড, কোপার্স, রয়েল ব্লু কম্পিউটার হাউস, স্মার্ট কম্পিউটার, মার্কেটের শাটার, ডিজিটাল বিলবোর্ড, মার্কেটের সামনের পার্ক করা কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। বিএফসির বাইরে থাই গ্লাস পুরো ভেঙে ফেলা হয়। রয়েল ব্লু কম্পিউটার হাউজের এক কর্মচারী জানান, আমাদের দোকানে রাজধানীর অত্যাধুনিক সব মেশিন রয়েছে। মিছিলকারী ভেতরে ঢুকে সবগুলো মেশিন ও গ্লাস ভাঙচুর করেছে। ওয়েল ফুডের এক বিক্রয়কর্মী জানান, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা সামনের দিকের শাটার বন্ধ করে দেই। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা মার্কেটের ভেতরে ঢুকে আমাদের দোকানে ব্যাপক ভাঙচুর করে। ভাঙচুরের একপর্যায়ের স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বিক্ষুব্ধদের নিবৃত্ত করেন। ওদিকে বিস্ফোরণের অন্তত ১০ মিনিট পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। এ সময় শপিং প্লাজার চারটি গেট বন্ধ করে দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে চারতলা ওই মার্কেটের প্রতিটি তলায় ব্যাপক তল্লাশি চালায় র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এসময় সেখান থেকে ১০ জনকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পাঁচজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। বিস্ফোরণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন পুলিশের গুলশান জোনের উপ-কমিশনার লুৎফুল কবিরসহ পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত উপ-কমিশনার লুৎফুল কবির এ বিষয়ে বলেন, মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজার ছাদ থেকে মিছিলে বোমা ফেলা হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। তাই তাৎক্ষণিকভাবে শপিং প্লাজার ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে সন্দেহমূলকভাবে কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। এ ব্যাপারে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এদিকে, ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বোমা বিস্ফোরণে আহত আনাস সরকার, আল-আমিন, রুবেল আহমেদ, ইমনসহ আটজন সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে আল-আমিন ও আনাসের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে। তাদের অর্থোপেডিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখাকে বাবুল আহমেদ, মোতালেব ও ওবায়দুর নামে তিনজন চিকিৎসা নিয়েছেন।
এদিকে নৌমন্ত্রী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ৯০ নম্বর সড়ক দিয়ে খালেদা জিয়ার কার্যালয় অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তাদের ৮৬ নম্বর সড়কে দক্ষিণ প্রান্তে ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয় পুলিশ। বাধা পেয়ে সেখানে দলীয় নেতাকর্মীদের অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানান নৌমন্ত্রী। এ সময় ৮৬ নম্বর সড়কের দক্ষিণপ্রান্তে খালেদা জিয়ার কার্যালয়মুখী করে একটি ট্রাকমঞ্চ তৈরি করা হয়। সেখানে সমাবেশ করেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এসময় ঢোল-তবলা ও বাদ্য বাজিয়ে আনন্দ-উল্লাস করেন মিছিলকারীরা। অনেকে হরতাল-অবরোধবিরোধী নানা স্লোগান দেন। সমাবেশ চলাকালে ৯০ নম্বর সড়কের পূর্বপ্রান্তে নির্মাণাধীন একটি ভবনের ওপর থেকে দুটি হাতবোমা ছোড়া হয়। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। বিক্ষুব্ধ কর্মীরা তখন নির্মাণাধীন ভবনে কর্মরত শ্রমিকদের মারধর করেন।
খালেদাকে বন্দি করার হুমকি নৌমন্ত্রীর
৯০ নম্বর সড়কের সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বন্দি করার হুমকি দিয়েছেন শাজাহান খান। বলেছেন, আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, অবিলম্বে আপনি অবরোধ-হরতাল বন্ধ করুন। অন্যথায় কেউ আপনাকে রক্ষা করতে পারবে না। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাব, মানুষ হত্যাকারী দানবকে বন্দি করুন। দেশ ও মানুষকে বাঁচান। খালেদা জিয়ার উদ্দেশে নৌমন্ত্রী বলেন, আমরা খালেদা জিয়ার ঘুম ভাঙাতে এসেছি। আপনি হরতাল-অবরোধের নামে মানুষ খুন করে চলেছেন। বোমাবাজি করছেন। চোরাগোপ্তা হামলা করে সাধারণ মানুষ, শ্রমিক হত্যা করছেন। অবরোধ-হরতালে খুন বন্ধ করুন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গুলশানের কূটনীতিক পাড়া থেকে খালেদা জিয়ার কার্যালয় সরিয়ে নিতে সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি। এর আগে গুলশান সেন্ট্রাল পার্কের সমাবেশে নৌমন্ত্রী বলেন, সরকার খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা না হলে জনগণই তাকে গ্রেপ্তার করে কাশিমপুর কারাগারে নিয়ে যাবে। আজকে শুধু আমরা জানান দিতে আসছি। পুলিশ ভাইয়েরা আমাদের যত দূর পর্যন্ত যেতে দেবে, তত দূর পর্যন্ত যাবো। কেউ যেন কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা না করে। আমাদের কর্মসূচি চলবে। আমরা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে যাব। তবে আমাদের কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ। শাহজাহান খান বলেন, খালেদা জিয়া কতিপয় জঙ্গি ও তালেবান নিয়ে মানুষ হত্যা করে চলেছেন। পাকিস্তানি আইএসআই এজেন্টরা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে। আমরা বলে দিতে চাই, মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বেঁচে থাকতে খালেদা জিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে না। হরতাল-অবরোধের নামে বিএনপি-জামায়াতের মানুষ হত্যার প্রতিবাদে শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলেও ঘোষণা দেন শাজাহান খান। এ সময় তিনি ২ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে ট্রাক মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও শ্রমিক-কর্মচারী সবাই অংশ নেবেন। ১৯শে ফেব্রুয়ারি মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত পতাকা মিছিল বের করা হবে। সমাবেশে জাসদ ও শ্রমিক জোটের নেত্রী শিরীন আখতার বলেন, খালেদা জিয়াকে বলতে চাই, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আপনি অবরোধ-হরতাল তুলে নিন। নইলে আপনি এই কার্যালয়ে থাকতে পারবেন না। আপনাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হবে। এছাড়া আমাদের আর কোন উপায় থাকবে না। সমাবেশে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ খান, এমপি ডা. এনাম আহমেদ, শ্রমিক নেতা এনায়েত করিম, ওসমান আলী প্রমুখ বক্তব্য দেন।
এর আগে শাজাহান খান বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ এবং খাবার বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। ওই হুমকির পরপরই খালেদার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট, ক্যাবল টিভি, ফোন-ফ্যাক্স সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবে ২০ ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরিয়ে দেয়া হয়। ১১ দিন পর ওই এলাকার কয়েকটি দূতাবাসের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সচল করা মোবাইল নেটওয়ার্ক। তবে গত ৬ দিন ধরে ওই কার্যালয়ে খাবার ঢুকতে বাধা দিচ্ছে পুলিশ।
কার্যালয়ের দু’পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী
নৌমন্ত্রীর ঘেরাও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কার্যালয়ের সামনে ৮৬ নম্বর সড়কের দুই প্রান্তে কাঁটাতারের ব্যারিকেড দেয়া হয়। মোতায়েন করা হয় শতাধিক দাঙ্গা পুলিশ, মহিলা পুলিশ ও সাদা পোশাকের পুলিশ। ওই সড়ক দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বিকালের দিকে অতিরিক্ত পুলিশ সরিয়ে নেয়া হয়। সন্ধ্যার দিকে যান চলাচলের জন্য কাঁটাতারের বেড়া তুলে দেয়া হয়। পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) নুরুল আলম বলেন, ঘেরাও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ।
নৌমন্ত্রীর নিন্দা: ঘেরাও কর্মসূচিতে হামলার পর সচিবালয়ে নৌ-মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আমরা গণতান্ত্রিক ভাষায় ওই ঘটনার প্রতিবাদ করতে চাই। ঘেরাও কর্মসূচিতে বোমা হামলায় ২৩ জনের মতো আহত হয়েছে জানিয়ে শাজাহান খান বলেন, এর মধ্যে ২-৩ জনের অবস্থা গুরুতর। আহত অন্তত ১৭ জন আশুলিয়ার এনাম মেডিক্যালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আহতরা আশুলিয়ার শ্রমিক হওয়ায় তারা সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলেও জানান মন্ত্রী। আহত ১৮ জনের একটি নামের তালিকাও তুলে ধরেন মন্ত্রী। তাদের মধ্যে রয়েছেন- মো. সাগর, আরিফ মাতুব্বর, আনা সরদার, সোহেল রানা, আলামিন, মুখলেছুর, রুবেল, দেলোয়ার, ওবায়দুল, মোতালেব, শামীম, মোস্তফা, ইব্রাহিম, হেলাল, মিন্টু, বাবুল মিয়া, সীমা ও নাহার।
বিস্ফোরণের পরপর আতঙ্কে মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজায় আশ্রয় নেন অনেক নারী-পুরুষ। তাদের মধ্যে ছিলেন একটি ফুড কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি কায়সার আহমেদ। কায়সার জানান, বিকট শব্দে ককটেল বিস্ফোরণের পরপর মানুষের চিৎকার ও কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তবে আতঙ্কে তিনি পেছনে না তাকিয়ে দ্রুত ওই মার্কেটে আশ্রয় নেন। এমনকি মিছিলকারীদের অনেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজায় ঢুকেন।
বোমা বিস্ফোরণের পরপরই মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজায় ব্যাপক ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এসময় মার্কেটে অবস্থিত তিনটি ফাস্টফুডের দোকান বিএফসি, ওয়েল ফুড, কোপার্স, রয়েল ব্লু কম্পিউটার হাউস, স্মার্ট কম্পিউটার, মার্কেটের শাটার, ডিজিটাল বিলবোর্ড, মার্কেটের সামনের পার্ক করা কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। বিএফসির বাইরে থাই গ্লাস পুরো ভেঙে ফেলা হয়। রয়েল ব্লু কম্পিউটার হাউজের এক কর্মচারী জানান, আমাদের দোকানে রাজধানীর অত্যাধুনিক সব মেশিন রয়েছে। মিছিলকারী ভেতরে ঢুকে সবগুলো মেশিন ও গ্লাস ভাঙচুর করেছে। ওয়েল ফুডের এক বিক্রয়কর্মী জানান, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা সামনের দিকের শাটার বন্ধ করে দেই। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা মার্কেটের ভেতরে ঢুকে আমাদের দোকানে ব্যাপক ভাঙচুর করে। ভাঙচুরের একপর্যায়ের স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বিক্ষুব্ধদের নিবৃত্ত করেন। ওদিকে বিস্ফোরণের অন্তত ১০ মিনিট পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। এ সময় শপিং প্লাজার চারটি গেট বন্ধ করে দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে চারতলা ওই মার্কেটের প্রতিটি তলায় ব্যাপক তল্লাশি চালায় র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এসময় সেখান থেকে ১০ জনকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পাঁচজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। বিস্ফোরণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন পুলিশের গুলশান জোনের উপ-কমিশনার লুৎফুল কবিরসহ পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত উপ-কমিশনার লুৎফুল কবির এ বিষয়ে বলেন, মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজার ছাদ থেকে মিছিলে বোমা ফেলা হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। তাই তাৎক্ষণিকভাবে শপিং প্লাজার ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে সন্দেহমূলকভাবে কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। এ ব্যাপারে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এদিকে, ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বোমা বিস্ফোরণে আহত আনাস সরকার, আল-আমিন, রুবেল আহমেদ, ইমনসহ আটজন সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে আল-আমিন ও আনাসের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে। তাদের অর্থোপেডিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখাকে বাবুল আহমেদ, মোতালেব ও ওবায়দুর নামে তিনজন চিকিৎসা নিয়েছেন।
এদিকে নৌমন্ত্রী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ৯০ নম্বর সড়ক দিয়ে খালেদা জিয়ার কার্যালয় অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তাদের ৮৬ নম্বর সড়কে দক্ষিণ প্রান্তে ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয় পুলিশ। বাধা পেয়ে সেখানে দলীয় নেতাকর্মীদের অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানান নৌমন্ত্রী। এ সময় ৮৬ নম্বর সড়কের দক্ষিণপ্রান্তে খালেদা জিয়ার কার্যালয়মুখী করে একটি ট্রাকমঞ্চ তৈরি করা হয়। সেখানে সমাবেশ করেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এসময় ঢোল-তবলা ও বাদ্য বাজিয়ে আনন্দ-উল্লাস করেন মিছিলকারীরা। অনেকে হরতাল-অবরোধবিরোধী নানা স্লোগান দেন। সমাবেশ চলাকালে ৯০ নম্বর সড়কের পূর্বপ্রান্তে নির্মাণাধীন একটি ভবনের ওপর থেকে দুটি হাতবোমা ছোড়া হয়। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। বিক্ষুব্ধ কর্মীরা তখন নির্মাণাধীন ভবনে কর্মরত শ্রমিকদের মারধর করেন।
খালেদাকে বন্দি করার হুমকি নৌমন্ত্রীর
৯০ নম্বর সড়কের সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বন্দি করার হুমকি দিয়েছেন শাজাহান খান। বলেছেন, আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, অবিলম্বে আপনি অবরোধ-হরতাল বন্ধ করুন। অন্যথায় কেউ আপনাকে রক্ষা করতে পারবে না। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাব, মানুষ হত্যাকারী দানবকে বন্দি করুন। দেশ ও মানুষকে বাঁচান। খালেদা জিয়ার উদ্দেশে নৌমন্ত্রী বলেন, আমরা খালেদা জিয়ার ঘুম ভাঙাতে এসেছি। আপনি হরতাল-অবরোধের নামে মানুষ খুন করে চলেছেন। বোমাবাজি করছেন। চোরাগোপ্তা হামলা করে সাধারণ মানুষ, শ্রমিক হত্যা করছেন। অবরোধ-হরতালে খুন বন্ধ করুন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গুলশানের কূটনীতিক পাড়া থেকে খালেদা জিয়ার কার্যালয় সরিয়ে নিতে সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি। এর আগে গুলশান সেন্ট্রাল পার্কের সমাবেশে নৌমন্ত্রী বলেন, সরকার খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা না হলে জনগণই তাকে গ্রেপ্তার করে কাশিমপুর কারাগারে নিয়ে যাবে। আজকে শুধু আমরা জানান দিতে আসছি। পুলিশ ভাইয়েরা আমাদের যত দূর পর্যন্ত যেতে দেবে, তত দূর পর্যন্ত যাবো। কেউ যেন কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা না করে। আমাদের কর্মসূচি চলবে। আমরা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে যাব। তবে আমাদের কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ। শাহজাহান খান বলেন, খালেদা জিয়া কতিপয় জঙ্গি ও তালেবান নিয়ে মানুষ হত্যা করে চলেছেন। পাকিস্তানি আইএসআই এজেন্টরা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে। আমরা বলে দিতে চাই, মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বেঁচে থাকতে খালেদা জিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে না। হরতাল-অবরোধের নামে বিএনপি-জামায়াতের মানুষ হত্যার প্রতিবাদে শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলেও ঘোষণা দেন শাজাহান খান। এ সময় তিনি ২ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে ট্রাক মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও শ্রমিক-কর্মচারী সবাই অংশ নেবেন। ১৯শে ফেব্রুয়ারি মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত পতাকা মিছিল বের করা হবে। সমাবেশে জাসদ ও শ্রমিক জোটের নেত্রী শিরীন আখতার বলেন, খালেদা জিয়াকে বলতে চাই, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আপনি অবরোধ-হরতাল তুলে নিন। নইলে আপনি এই কার্যালয়ে থাকতে পারবেন না। আপনাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হবে। এছাড়া আমাদের আর কোন উপায় থাকবে না। সমাবেশে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ খান, এমপি ডা. এনাম আহমেদ, শ্রমিক নেতা এনায়েত করিম, ওসমান আলী প্রমুখ বক্তব্য দেন।
এর আগে শাজাহান খান বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ এবং খাবার বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। ওই হুমকির পরপরই খালেদার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট, ক্যাবল টিভি, ফোন-ফ্যাক্স সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবে ২০ ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরিয়ে দেয়া হয়। ১১ দিন পর ওই এলাকার কয়েকটি দূতাবাসের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সচল করা মোবাইল নেটওয়ার্ক। তবে গত ৬ দিন ধরে ওই কার্যালয়ে খাবার ঢুকতে বাধা দিচ্ছে পুলিশ।
কার্যালয়ের দু’পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী
নৌমন্ত্রীর ঘেরাও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কার্যালয়ের সামনে ৮৬ নম্বর সড়কের দুই প্রান্তে কাঁটাতারের ব্যারিকেড দেয়া হয়। মোতায়েন করা হয় শতাধিক দাঙ্গা পুলিশ, মহিলা পুলিশ ও সাদা পোশাকের পুলিশ। ওই সড়ক দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বিকালের দিকে অতিরিক্ত পুলিশ সরিয়ে নেয়া হয়। সন্ধ্যার দিকে যান চলাচলের জন্য কাঁটাতারের বেড়া তুলে দেয়া হয়। পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) নুরুল আলম বলেন, ঘেরাও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ।
নৌমন্ত্রীর নিন্দা: ঘেরাও কর্মসূচিতে হামলার পর সচিবালয়ে নৌ-মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আমরা গণতান্ত্রিক ভাষায় ওই ঘটনার প্রতিবাদ করতে চাই। ঘেরাও কর্মসূচিতে বোমা হামলায় ২৩ জনের মতো আহত হয়েছে জানিয়ে শাজাহান খান বলেন, এর মধ্যে ২-৩ জনের অবস্থা গুরুতর। আহত অন্তত ১৭ জন আশুলিয়ার এনাম মেডিক্যালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আহতরা আশুলিয়ার শ্রমিক হওয়ায় তারা সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলেও জানান মন্ত্রী। আহত ১৮ জনের একটি নামের তালিকাও তুলে ধরেন মন্ত্রী। তাদের মধ্যে রয়েছেন- মো. সাগর, আরিফ মাতুব্বর, আনা সরদার, সোহেল রানা, আলামিন, মুখলেছুর, রুবেল, দেলোয়ার, ওবায়দুল, মোতালেব, শামীম, মোস্তফা, ইব্রাহিম, হেলাল, মিন্টু, বাবুল মিয়া, সীমা ও নাহার।
উৎস- মানবজমিন