মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকদের প্লাটফরম ‘কায়সার বাহিনী’র প্রধান এবং এরশাদ সরকারের কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আসামির উপস্থিতিতে জনাকীর্ণ বিচারকক্ষে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর পক্ষে গতকাল এ মামলার রায় ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। কায়সারের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের সাত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ এ দণ্ড দেওয়া হয়। প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে দুটি অভিযোগ থেকে। দণ্ডের জবাবে কায়সার কোনো মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া দেখাননি। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের ‘সমরনায়ক’ আখ্যায়িত করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, তাদের প্রাপ্য সম্মান, সামাজিক নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি সরকারের দেখা উচিত। আসামি পক্ষ জানিয়েছে, রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে সুপ্রিমকোর্টে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় গতকাল ট্রাইব্যুনাল-২ বসেন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারকক্ষে। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চতুর্দশ রায়। রায় ঘোষণা উপলক্ষে নিরাপত্তা জোরদার করা হয় ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে। বেলা ১১টা ৪ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্য আসন গ্রহণ করেন এজলাসে। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের ডান পাশে ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ সদস্য বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া এবং কনিষ্ঠ সদস্য বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম আসন গ্রহণ করেন বাঁ-পাশে। এজলাস সামনে রেখে ডান পাশে প্রসিকিউশনের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসেন প্রসিকিউটররা। বাঁ-পাশে আসামি পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান, আবদুস সোবহান তরফদার ও সাজ্জাদ আলী চৌধুরী। প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, মোহাম্মদ আলী, তুরিন আফরোজ, হৃষীকেশ সাহা, আবুল কালাম প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন আসামির ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ গালিব ও ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ হুমায়ুন। আর কাঠগড়ায় কায়সার। এ ছাড়া গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিও কম ছিল না। রায় ঘোষণা শুরু হয়ে তা শেষ হয় ১২টা ১৪ মিনিটে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এককভাবে পাঠ করেন ৪৮৪ পৃষ্ঠা রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ। রায় ঘোষণা উপলক্ষে সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয় কায়সারকে।
উল্লেখ্য, সৈয়দ কায়সার একাত্তরে ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা। মুক্তিযুদ্ধকালে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন ‘কায়সার বাহিনী’। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে পালিয়ে লন্ডনে চলে যান কায়সার। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। ১৯৭৯ সালে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে যোগ দেন বিএনপিতে। জেনারেল এরশাদের আমলে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে কৃষি প্রতিমন্ত্রী ও হবিগঞ্জ জেলার সভাপতি হন।সাত অভিযোগে পৃথক ফাঁসি : সাতটি অভিযোগে পৃথকভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে কায়সারকে। ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে একাধিক অভিযোগে পৃথকভাবে কোনো আসামিকে সর্বোচ্চ দণ্ড দেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। তবে একটি ফাঁসির আদেশ কার্যকরের সঙ্গে একীভূত হবে অন্য সব মৃত্যুদণ্ড। তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) মাধবপুর থানার কৃষ্ণনগর গ্রামের অহিদ হোসেন পাঠান, চেরাগ আলী, জনাব আলী ও মধু সুইপারকে হত্যা করেন আসামি কায়সার ও তার লোকজন। লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করা হয় তাদের বাড়িঘরে। পঞ্চম অভিযোগ- ২৯ এপ্রিল হবিগঞ্জ সদরের শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্যগুদাম এবং শায়েস্তাগঞ্জ পুরান বাজারের রেলব্রিজ এলাকায় আবদুল আজিজ, রেজাউল করিম, আবদুর রহমানসহ কয়েকজনকে আটক করে নির্যাতনের পর হত্যা করেন কায়সার ও তার বাহিনী। ষষ্ঠ অভিযোগ- ২৯ এপ্রিল হবিগঞ্জ সদরের লস্করপুর রেল লাইনের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং হীরেন্দ্র চন্দ্র রায়কে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করেন কায়সার ও তার বাহিনী। অষ্টম অভিযোগ- ১১ মে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার চাঁদপুর চা বাগানে সাঁওতাল নারী হীরামনিকে ধর্ষণ করে কায়সার বাহিনীর সদস্যরা। এতে সহায়তা করেন কায়সার। দশম অভিযোগ- ১৩ জুন হবিগঞ্জ সদর, মোকাম বাড়ি, শায়েস্তাগঞ্জ থানার আর অ্যান্ড এইচ ডাকবাংলো এবং মাধবপুর থানার শাহাজীবাজার এলাকার হামলা চালান কায়সার ও তার বাহিনী। এ সময় অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যা করা হয় শাহ ফিরোজ আলীকে। দ্বাদশতম অভিযোগ- আগস্টের মাঝামাঝি কোনো একদিন হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার বেলাঘর ও জগদীশপুর হাইস্কুল থেকে আতাব মিয়া, আইয়ুব মিয়া, মাজেদা বেগমকে অপহরণ করেন কায়সার ও তার বাহিনী। পরে ধর্ষণ করা হয় মাজেদাকে। ষোড়শতম অভিযোগ- ১৫ নভেম্বর কায়সার ও তার বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাটপাড়া থানার দাউরা, নিশ্চিন্তপুর, গুটমা, বুরুঙ্গা, চিতনাসহ কয়েকটি গ্রামের ১০৮ জনকে হত্যা করেন। এ সাত অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে কায়সারকে।চার অভিযোগে আমৃত্যুদণ্ড : প্রমাণিত প্রথম, নবম, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ- এই চার অভিযোগের প্রত্যেকটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে আসামিকে। প্রথম অভিযোগ-২৭ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া (তৎকালীন কুমিল্লা মহকুমা) সদরের পুলিশ ফাঁড়ি ও ইসলামপুর গ্রামের কাজীবাড়িতে শাহজাহান চেয়ারম্যানকে হত্যা, নায়েব আলীকে জখম এবং বাড়িতে লুটপাট করেন কায়সার ও তার সহযোগীরা। নবম অভিযোগ- ১৫ মে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের লোহাইদ এলাকার আবদুল আজিজ, জমির উদ্দিন, আজিম উদ্দিন, নূর আলী চৌধুরীসহ কয়েকজনকে হত্যা করেন কায়সার ও তার বাহিনী। ত্রয়োদশতম অভিযোগ-১৮ আগস্ট হবিগঞ্জের নলুয়া চা বাগান থেকে মহিবুল্লাহ, আবদুস শহীদ, আকবর আলী, জাহির হোসেনকে অপহরণ করে নরপতিতে আবদুস শহীদের বাড়ি ও রাজেন্দ্র দত্তের বাড়িতে স্থানীয় শান্তি কমিটির কার্যালয় এবং কালাপুরের পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যান কায়সার ও তার বাহিনী। নির্যাতনের পর হত্যা করা হয় এসব অপহৃতকে। চতুর্দশতম অভিযোগ- ২৯ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের মাধবপুরে সোনাই নদীর ব্রিজ এলাকা থেকে সিরাজ আলী, ওয়াহেদ আলী, আক্কাস আলী, আবদুস ছাত্তারকে অপহরণ করে নিয়ে যান কায়সার ও তার বাহিনী। তাদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।দুই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি : প্রমাণিত না হওয়ায় অন্য দুই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে কায়সারকে। চতুর্থ অভিযোগ- কায়সার ও তার বাহিনী হবিগঞ্জের মাধবপুর বাজারের উত্তর-পূর্ব অংশে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করেন ২৮ এপ্রিল।আপিল প্রসঙ্গ : এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা পক্ষ। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ৩০ দিনের মধ্যে করতে হবে এ আবেদন। সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে।সন্তুষ্ট সাক্ষী ও অন্যরা : হবিগঞ্জ প্রতিনিধি চৌধুরী মোহাম্মদ ফরিয়াদ জানান, কায়সারের ফাঁসির রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার সাক্ষী, ক্ষতিগ্রস্ত ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। অবিলম্বে রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন তারা। রায়ের পর জেলায় আনন্দ মিছিল করেছে বিভিন্ন সংগঠন। গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে শহর প্রদক্ষিণ করে একটি মিছিল।