খবরিকা ডেক্স :পুরান ঢাকার বাসিন্দা আবদুল আলিম। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী। পেনশনের টাকা ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর) করে রেখেছেন বেসরকারি একটি ব্যাংকে। এফডিআর থেকে তিন বছর আগে প্রতি মাসে মুনাফা হিসেবে উত্তোলন করতেন ১৬ হাজার টাকা।
কিন্তু ধারাবাহিক আমানতের সুদ বা মুনাফার হার কমায় এখন পাচ্ছেন মাত্র ১৩ হাজার টাকা। কিন্তু এ সময়ে জীবনযাত্রাসহ সব ধরনের ব্যয় বাড়লেও কমেছে ব্যাংকের মুনাফার হার। ফলে সংসারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন আবদুল আলিম। সংসার নির্বাহে এখন মাঝে মধ্যেই তাকে ধারদেনা করতে হচ্ছে।
বিনিয়োগ মন্দার কারণে ব্যাংকিং খাতে বাড়ছে অতিরিক্ত তারল্য ও অলস টাকা। ফলে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা ব্যয় ও মুনাফা সহনীয় পর্যায় রাখতে ধারাবাহিকভাবে কমানো হচ্ছে আমানতের সুদ বা মুনাফার হার। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ আমানতকারীরা। তাই আমানতের সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকিং খাতে সার্বিক আমানতের সুদহার ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। এর বিপরীতে ঋণের সুদহার ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। তবে সার্বিক আমানত হার ৫ শতাংশের ওপর থাকলেও বিদেশি ব্যাংকের সুদহার নেমেছে ৫ শতাংশের নিচে। এমনকি অনেক ব্যাংক ১-২ শতাংশ সুদ বা মুনাফা দিচ্ছে আমানতকারীদের।
আমানতের সুদহার ৫ শতাংশের নিচে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংক। ব্যাংক দুটির আমানতের হার ৪ দশমিক ১১ ও ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের আমানতের হার ৪ দশমিক ২২ শতাংশ, সিটি ব্যাংকের ৪ দশমিক ৬১, ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংকের ৪ দশমিক ৩২, পূবালী ব্যাংকের ৪ দশমিক ৮৩, উত্তরা ব্যাংকের ৪ দশমিক ৯৩, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৪ দশমিক ৩৫, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ২ দশমিক ৪০, ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪ দশমিক ৮৫, ব্র্যাক ব্যাংকের ৩ দশমিক ৯০ এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৩ দশমিক ০৯ শতাংশ।
বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সুদের হার ১ দশমিক ১৯ শতাংশ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ২ দশমিক ৭৪, হাবিব ব্যাংকের ৪ দশমিক ২৫, কমার্সিয়াল ব্যাংক অব সিলনের ৩ দশমিক ০৯, উরি ব্যাংকের ২ দশমিক ২৪, এইচএসবিসির ১ দশমিক ৫৩ এবং ব্যাংক আল ফালাহর ৪ শতাংশ।
দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানতের সুদ দিচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের ফার্মার্স ব্যাংক। আমানতকারীদের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ সুদ দিচ্ছে ব্যাংকটি। আর সবচেয়ে কম সুদ দিচ্ছে বিদেশি সিটি ব্যাংক এনএ। ব্যাংকটি আমানতের হার মাত্র দশমিক ১৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমানতের মুনাফা দিয়ে অনেকে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন। তাই আমানতের সুদহার ৫ শতাংশের নিচে থাকা উচিত নয়। যেখানে দেশে বর্তমান মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের উপরে সেখানে আমানতের সুদহার ৫ শতাংশ বা তার নিচে থাকা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। এতে অর্থ অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে আমানতের সুদহার কমপক্ষে ৬ শতাংশ রাখা উচিত বলে মত এ অর্থনীতিবিদের।
আমানতের সুদ না কমিয়ে ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় কমানো প্রয়োজন উল্লেখ করে সাবেক এ গভর্নর আরও বলেন, আমানতের সুদ ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে ঋণের সুদ কমানোর কোনো যুক্তি হতে পারে না। ঋণের সুদ কমানোর জন্য স্প্রেড (আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান) কমানো উচিত। একইসঙ্গে কমাতে হবে ঋণখেলাপি ও দুর্নীতি।
এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সাবেক সভাপতি ও মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, পরিচালন ব্যয়, মুনাফা ও ব্যাংক ঋণের সুদহার সমন্বয় করতে গিয়ে আমানতের সুদহার কমাতে হয়েছে। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এসময় ব্যাংকগুলো আমানতের দিকে বেশি ঝুঁকছে না। তবে মূল্যস্ফীতির নিচে আমানতের হার কাম্য নয়। এতে করে অর্থের ক্ষতি হয়। ইতোমধ্যে আমানতের হার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার একটি পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে আমাদের নজর দেয়া উচিত।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। সেইসঙ্গে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৫৩ শতাংশে।