শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

ঈদের আনন্দ হোক সবার জন্য

1_156427
বছর ঘুরে আবারও এলো ঈদ। ‘ঈদ মানেই আনন্দে উদ্ভাসিত দেশ, ঈদ মানেই শান্তি সুখের পরিবেশ’। ঈদ মানে খুশি হলেও ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদের খুশি, উৎসর্গ করতে পারার খুশি। যাকে বলা হয় ত্যাগের মহিমা। পশু কোরবানির মাধ্যমে উৎসর্গের মানসিকতা তৈরি হওয়াটাই হচ্ছে কোরবানি ঈদের বড় শিক্ষা। পশু কোরবানি করা হয় প্রতীকী অর্থে।
এই ঈদে নগরীর রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার পাশাপাশি দেখা যায় গরু আর খাসি। আবার ঠাসাঠাসি করে ট্রাকে ট্রাকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে গরু। ক’দিন আগেও যা ছিল খেলার মাঠ, এখন তা গরু-ছাগলের হাট। রাস্তাঘাটে গরুর দড়ি-ছড়ি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যায় অনেককেই। কোথাও ছুটন্ত গরুর টানে দাঁড়ানো দায়। আবার কোথাও দাঁড়ানো গরুকে নাড়ানো দায়। কোন গরু সুবোধ, কোন গরু অবোধ আবার কোন গরু অবাধ্য। গরুর হাটেও রয়েছে প্রতিযোগিতা। কেউ দামি গরু কিনে নামি হতে চান। কেউ বা ক্রেতা বুঝে বাড়তি দাম হাঁকান। তারপরও লাখ লাখ গরু কেনাবেচা হচ্ছে। আর আনন্দের সঙ্গে তাই নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটছেন ক্রেতা। এ এক অন্যরকম আনন্দ।
ধারালো অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ হলেও কোরবানির সময় মনে হয় এসব অস্ত্র বহনে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। দা, ছুরি, বঁটি যার যা আছে তাই নিয়ে সবাই তৈরি হয়ে যান শান দিতে। এ সময় ভীতিকর এসব অস্ত্র কারও মধ্যেই ভীতির সঞ্চার করে না। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। আজকাল দেখা যায় কোরবানির ঈদে উৎসবের বা ত্যাগের যে মহিমা রয়েছে, তার চেয়ে কারও কারও কাছে এখন এটা ভোজনের উৎসবে পরিণত হয়েছে। কোরবানির মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ সমাজের একটি অংশ সামান্য পরিমাণ মাংস বিলিয়ে, বাকিটা ডিপফ্রিজে চালান করে দিতে অভ্যস্ত। আর ওই গোশত দিয়ে মাসের পর মাস চলে ভোজন বিলাস। গরিব আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীরা ঠিকমতো মাংস পেয়েছেন কিনা সে খবর রাখারও প্রয়োজনবোধ করে না অনেকে। অথচ আমরা জানি- ‘ঈদ মানে কোনখানে ভেদাভেদ নাই, ঈদ মানে প্রাণে প্রাণে সমান সবাই’। ঈদে ভোগ-বিলাসী মানুষদের উদ্দেশে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়- ‘তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে- ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ’।
ঈদ উদযাপন করার জন্য নাড়ির টানে সবাই ছোটেন বাড়ির পানে। উদ্দেশ্য স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করা। এটা তাদের অপরাধ নয়। তারপরও বাড়িতে যেতে হলে তাদের পোহাতে হয় নানা দুর্ভোগ। প্রশ্ন হচ্ছে- এই ডিজিটাল যুগে এসেও ঈদ এলেই বাড়ি যাওয়ার জন্য আমাদের ট্রেন বা বাসের ছাদে উঠতে হবে কেন? কেনই বা গাদাগাদি করে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে লঞ্চে উঠতে হবে?
প্রতি ঈদেই শোনা যায় এবার ঘরমুখো মানুষ যেন নিরাপদে এবং সহজে বাড়ি যেতে পারেন তার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের অব্যবস্থা এতটাই তীব্র যে ব্যবস্থাগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ। কালোবাজারে টিকিট এখনও পাওয়া যায়। খানা-খন্দে ভরা রাস্তার দুরবস্থা এখনও দেখতে হয়। গাড়িগুলো এসব রাস্তায় পড়ে মাঝে মাঝেই গাড়িনৃত্যে মেতে ওঠে। সড়ক-মহাসড়কে মহাযানজট। ভোগান্তিতে ঘরমুখো মানুষ।
কি অদ্ভুত আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা। যে দেশ যত উন্নত তার যোগাযোগ ব্যবস্থাও তত উন্নত। প্রতিটি সরকার এলেই বলেন, দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। অথচ প্রতি ঈদেই মানুষের বাড়ি যাওয়া এবং বাড়ি ফেরার সময় অজানা আতংকে থাকতে হয়। ঠিকভাবে যেতে পারব তো? সময়মতো পৌঁছতে পারব তো? টিকিট পাব তো? লঞ্চে জায়গা পাব তো? না জানি কখন কোন দুর্ঘটনার খবর শুনতে হয়? কোন্ মায়ের বুক খালি হয়? আমাদের দেশে তো আবার ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সবাই মোটামুটি বেশ ত্বরিতগতিতে বক্তৃতা, বিবৃতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কেন হল? কিভাবে হল? কে করল? ওকে বাঁধো, একে ধরো, তদন্ত কমিটি করো। কিছুদিন পর সব শেষ। যেভাবে শেষ হয়েছে রানা প্লাজা কিংবা গত ঈদে পদ্মায় ডুবে যাওয়া লঞ্চের মতো অনেক দুর্ঘটনার বেলায়। কিন্তু শেষ হয়নি সেসব পরিবারের অবস্থা, যারা দুর্ঘটনায় স্বজন হারিয়েছেন, যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত দু-একটি পরিবারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ রয়েছে। তাদের জীবন যে কি দুঃসহ দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে তা না দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না। ঈদের আনন্দ তাদের স্পর্শ করে না। তারপরও এতসব কষ্ট সহ্য করেও যানজটে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের চোখে-মুখে জ্বলজ্বল করে ঈদের আনন্দ। কখন দেখা হবে স্বজনদের সঙ্গে। একেই বলে নাড়ির টান।
ঈদে যখন আমাদের বাড়ি যেতেই হবে- তাই আমাদেরই স্বার্থে সবাইকে ঘটনা ঘটার আগেই সচেতন হতে হবে, ঘটার পরে নয়। দায়িত্ববান ব্যক্তিরা যখন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, আইন করেও আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হন, তখন আমাদেরই দায়িত্ববান এবং সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে যাতায়াতের সময় আমাদের আর একটু সাবধানি হতে হবে। কারণ ‘সাবধানের যেমন মার নেই, সাবধানির তেমন হার নেই।’ বাস-ট্রেনের ছাদে যেমন ওঠা যাবে না, তেমনি অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই লঞ্চে ওঠা থেকেও আমাদের বিরত থাকতে হবে, অন্যদেরও বিরত রাখতে হবে। কারণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানুষের জীবন। আর একটি জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো জীবন। তাই কোনো কোনো মহলের অতি লাভ, অতি লোভ এবং সংশ্লিষ্ট মহলের উদাসীনতায় কোনো দুর্ঘটনা যেন কোনো ঈদেই বিষাদের ছায়া ফেলতে না পারে সেজন্য আমাদের সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে।
ঘরমুখো মানুষেরা নিরাপদে পৌঁছে যাক তাদের আপন আপন ঠিকানায়, আপনজনের কাছে। আবার ঈদ শেষে নিরাপদে ফিরে আসুক যার যার কর্মস্থলে। ঈদ হোক ভেদাভেদ ভোলামিলনের আনন্দে মুখর। সবাইকে ঈদ মোবারক।
পাদটীকা : যেখানে সেখানে পশু কোরবানি না দেয়া, কোরবানির পর পশুর রক্ত, মলমূত্র পরিষ্কার করে পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। আমরা যেন সে দায়িত্বটুকু নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করি।