শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

ইসলামী উম্মার শান্তি ও কল্যাণ কামনা

2_203238
মুসলিম উম্মাহর সুদৃঢ় ঐক্য, দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি, দেশের কল্যাণ কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে রোববার শেষ হল তাবলিগ জামাত আয়োজিত ৫০তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি ও গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করার জন্য দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে রহমত কামনা করা হয়। এ সময় ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে ইজতেমা ও আশপাশের এলাকায় এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বেলা ১১টা ১৬ মিনিটে শুরু করে ১১টা ৪৮ মিনিট পর্যন্ত ৩২ মিনিট স্থায়ী এ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি ভারতের হজরত মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ। তিনি আরবি ও উর্দু ভাষায় মোনাজাত করেন। রোববার বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে ঠিক কি পরিমাণ মুসল্লি অংশ নিয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা কেউ জানাতে পারেননি। তবে এ সংখ্যা ৩০ লক্ষাধিক হতে পারে বলে আয়োজকদের ধারণা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধের কারণে এ বছর ইজতেমায় গত বারের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ মুসল্লি কম হয়েছে বলে ধারণা করছেন আয়োজকরা।রোববার ভোর থেকে টঙ্গীর আকাশ ছিল ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন। কনকনে শীত এবং ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করেই মুসল্লিরা হাজির হতে থাকেন ইজতেমা মাঠে। সকাল ৯টার আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় ইজতেমা মাঠ। এক পর্যায়ে মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলিগলি, বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছাতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ কামারপাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন। বিভিন্ন যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদে নৌকায়ও দেখা যায় মুসল্লিদের। যে দিকেই চোখ যায় সে দিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষ। ইজতেমাস্থলের চারপাশের ৩-৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আখেরি মোনাজাতের জন্য রোববার আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল ছুটি।আখেরি মোনাজাতে ভিভিআইপি ও ভিআইপি : বিশ্ব ইজতেমা মাঠে না এলেও বঙ্গভবনেই আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন গণভবনে। বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ অংশ নেন বনানীর বাসায়। আর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশানে তার কার্যালয় থেকে আখেরি মোনজাতে অংশ নেন।

 ইজতেমা মাঠের পাশে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে স্থাপিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আকম মোজাম্মেল হক এমপি, স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, যুগ্ম সচিব মো. আবদুল খালেক, জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ হারুন অর রশীদ পিপিএম, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসএম মোস্তফা কামাল, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান। এবারই প্রথম কোনো ভিভিআইপি ইজতেমা মাঠে এসে মোনাজাতে অংশ গ্রহণ করেননি।
 বিশ্ব ইজতেমা চলাকালে টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল এবং তাদের ইজতেমা মাঠে স্থাপিত তিন মেডিকেল ক্যাম্পে ১২ হাজার ১৪৬ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৩১ জনকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পাশাপাশি ৪৯ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মো. হাবিব উল্লাহ। এছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্রেগুলোতে কয়েক হাজার মুসল্লি চিকিৎসা নিয়েছেন।

মোনাজাত শেষে দীর্ঘ যানজট : আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পর পরই নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটতে থাকেন মুসল্লিরা। এতে টঙ্গীর কামারপাড়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের এলাকায় সৃষ্টি হয় দীর্ঘ জনজট ও যানজট। এতে গাজীপুরের জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গাড়ি দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়ে।

মোনাজাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ : আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মহিলাও আগের দিন রাত থেকে ইজতেমা ময়দানের আশপাশে, বিভিন্ন মিল-কারখানা, বাসাবাড়িতে ও বিভিন্ন ভবনের ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।

প্রথম পর্বে সাড়ে ৩ হাজার জামাত তৈরি : বিভিন্ন দেশে তাবলিগের কাজে বের হতে এবার ইজতেমাস্থলে প্রথম পর্বে প্রায় সাড়ে তিন হাজার জামাত তৈরি হয়েছে বলে ইজতেমা আয়োজক সূত্রে জানা গেছে। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে সূত্র জানায়।

বিশ্ব ইজতেমাকে ঘিরে বাড়তি নিরাপত্তা : এ বছর বিশ্ব ইজতেমা চলাকালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ থাকায় আইনশৃংখলা বাহিনী বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে। ইজতেমা চলাকালে গত কয়েকদিন ধরে র‌্যাবের নদী পথে স্পিডবোর্ড ও আকাশপথে হেলিকপ্টার সার্বক্ষণিক টহল অব্যাহত ছিল। ইজতেমা ময়দান ঘিরে ৫ স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা। বাইনোকুলার, মেটাল ডিটেক্টর, নৌ-টহল, চেকপোস্ট বসিয়ে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করা হয়। ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তায় পুলিশ ও র‌্যাব আলাদা আলাদাভাবে কন্ট্রোল রুম ও ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করে। এছাড়া সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বিক নিরাপত্তা কন্ট্রোল রুম থেকে মনিটরিং করা যায়। খিত্তায় খিত্তায় সাদা পোশাকে নজরদারি করে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

এ বছর বিশ্ব ইজতেমার জন্য গাজীপুর জেলা পুলিশ ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন রেঞ্জ থেকে কর্মকর্তাসহ ফোর্স এবং সারা দেশ থেকে র‌্যাব ইউনিটের কর্মকর্তাসহ ফোর্স ইজতেমাস্থলে নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করে। সব মিলিয়ে বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের নিরাপত্তায় এ বছর আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রায় ১২ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয় বলে জানা গেছে।

ইজতেমায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প : এবারের বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করছে। এবার প্রায় ৫০টি স্বেচ্ছাসেবী, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেছে। মন্নুনগর এলাকায় হামদর্দ ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ছাড়াও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, গাজীপুর সিভিল সার্জন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন মুসল্লিদের ফ্রি চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছে।

বিদেশী মেহমানদের জন্য আস্ত মুরগি-খাসি : টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় বিদেশী মেহমান খানায় সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, কোরিয়া, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার মুসল্লি উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তাদের উন্নত আবাসনসহ খাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। গত তিন দিন ধরে প্রতি বেলায় মেহমানদের রন্ধনশালায় গড়ে ১০ হাজার বিদেশী মুসল্লির জন্য রান্না হচ্ছে।

বিদেশী মেহমানদের রন্ধনশালার এক বাবুর্চি জানান, গত তিন ধরে বিদেশী মেহমানদের খাবারের জন্য পাঁচ টন চাল (বিরায়ানির), চার টন মাছ, গরুর মাংস ৩ টন, সয়াবিন তেল পাঁচ ব্যারল (দুইশ’ লিটারে এক ব্যারেল), মধু ৫০ কেজি, ডিম ১৫ হাজার, খাসি ২২টি, তন্দুর রুটি ৫০-৬০ হাজার পিস রান্না হচ্ছে। এসবই আসছে ইজতেমায় ধর্মে মেহনতদানকারী মুসল্লিদের নিজস্ব অর্থে। দুবাইয়ের শেখ, কাতারের শেখ ও কুয়েতের শেখের মেয়ের জামাতাও এ ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন। তাদের জন্য পোলাওয়ের পাশাপাশি আস্ত খাসি, মুরগি ও কবুতর রান্না করা হয়।

বিশ্ব ইজতেমার ২য় পর্ব ১৬ জানুয়ারি : ৫০তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব আগামী ১৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে। এ পর্বে ৩৩টি জেলার মুসল্লিরা ময়দানে স্থাপিত ৩৮টি খিত্তায় অবস্থান নেবেন। খিত্তাগুলোর মধ্যে ১ ও ২নং খিত্তায় নারায়ণগঞ্জ জেলা, ৩ ও ৪নং খিত্তায় ঢাকা জেলা, ৫নং খিত্তায় কক্সবাজার জেলা, ৬নং খিত্তায় মানিকগঞ্জ জেলা, ৭নং খিত্তায় পিরোজপুর জেলা, ৮নং খিত্তায় পটুয়াখালী জেলা, ৯নং খিত্তায় টাঙ্গাইল জেলাসহ বিভিন্ন খিত্তায় বিভিন্ন জেলার মানুষ অংশ নেবেন।