ফিফা ড্র শেষে আর্জেন্টিনার ভাগ্য দেখছিলেন বিশ্লেষকরা। ‘এফ’ গ্রুপে বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, ইরান ও নাইজেরিয়ার সঙ্গে লড়াই দুই বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের গরম আবহাওয়া নিয়ে আলাদা আলোচনা। তবে গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনা তিন ম্যাচ খেলবে ব্রাজিলের অপেক্ষাকৃত শীতপ্রধান শহর বেলো হরিজন্তে, পোর্ট আলেগ্রে ও রিওডি জেনিরোয়। বোদ্ধাদের বিচারে গ্রুপে ফেভারিট আর্জেন্টিনাই। তবে দ্বিতীয় স্থানের জন্য জোর লড়াই দেখা যাবে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার তিন দলে।
আর্জেন্টিনা
অংশগ্রহণ: ১৫ বার
সেরা সাফল্য: চ্যাম্পিয়ন ১৯৭৮, ১৯৮৬
ফিফা র্যাঙ্কিং: ৭
‘লস কুয়াতরো ফ্যান্টাসটিকো’- বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের ভরসার নাম সেরা চার ফরোয়ার্ড অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, সার্জিও অ্যাগুয়েরো, গঞ্জালো হিগুয়েন ও লিওনেল মেসি। সদ্য মওসুমে চারজনই রয়েছেন সেরা ফর্মে। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে এবারের ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনালে সেরা খেলোয়াড়ের নৈপুণ্য দেখান ডি মারিয়া। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে ম্যানচেস্টার সিটির শিরোপা জয়ে বড় ভূমিকা অ্যাগুয়েরোর। ইতালি জায়ান্ট নাপোলির জার্সি গায়ে সিরি ‘এ’ লীগে ১৭ গোলের তারকা হিগুয়েন। দু’দিন আগে জার্মানির তারকা কোচ জোয়াকিম লো’ বলেন, আর্জেন্টিনাকে বাদ দিয়ে বিশ্বকাপ আলোচনা করা যাবে না। কারণ আর্জেন্টিনার রয়েছে লিওনেল মেসি। চারবারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার মেসি সদ্য লা লিগায় করেন দ্বিতীয় সর্বাধিক ২৮ গোল। কোচ আলেজান্দ্রো সাবেলার বিশ্বকাপ অভিজ্ঞতা নতুন নয়। ১৯৯৮’র আসরে কোচ ড্যানিয়েল প্যাসারেলার সহকারীর দায়িত্ব পালন করেন সাবেলা। আর আর্জেন্টিনা দলে পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে লাতিন অঞ্চলের বাছাইয়ে তার কেরামতি দেখান কোচ সাবেলাও। এবারের বাছাইয়ে কলম্বিয়ার মাটিতে জয় পাওয়া একমাত্র দল আর্জেন্টিনা। শক্তিধর চিলিকে হারায় তারা দুইবার। তবে নড়বড়ে ডিফেন্স নিয়ে বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইনদের আলাদা চিন্তা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাছাই পর্বে তারা হার মানে ভেনিজুয়েলার কাছে। সদ্য মওসুমে ফরাসি দল মনাকোর বেঞ্চে বসেই সময় কাটছিল আর্জেন্টিনার সেরা গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরোর। স্পোর্টিং লিসবন লেফট ব্যাক মারকোস রোজো ও নাপোলি সেন্টার ব্যাক ফেদেরিকো ফার্নানদেজের নেই বড় আসরে খেলার অভিজ্ঞতা। তবে এফসি বার্সেলোনায় হেভিয়ের মাসচেরানো ও ম্যানচেস্টার সিটিতে মার্টিন দেমিচেলিস, পাবলো জাবালেতারা সদ্য মওসুমে দেখিয়েছেন সেরা ফর্ম। বিশ্বকাপে দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার এ পর্যন্ত রানার্সআপের কৃতিত্বও দুইবার। আর এতে তাদের বড় নামটি গ্রেট ফুটবলার দিয়েগো মারাদোনার। ১৯৭৮-এ নিজ মাটিতে বিশ্বকাপ জেতেন প্যাসারেলা, মারিও ক্যাম্পেসরা। দলে থাকলেও অল্প বয়সের কারণে মারাদোনাকে সেবার এক ম্যাচও খেলতে দেননি কোচ সিজার মিনোত্তি। মেক্সিকোয় ’৮৬’র আসরে একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দেন মারাদোনা। ’৯০-এ ইতালি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে তোলেন ফাইনালে। এবার আর্জেন্টিনা ভক্তরা মারাদোনার মতোই ভেলকি দেখতে চাইছেন লিওনেল মেসির খেলায়। এ জন্য দুই স্ট্রাইকারের পেছনে মারাদোনার মতোই ‘পিওর দশ নম্বর’ পজিশনে মেসিকে স্বাধীনভাবে খেলতে দিচ্ছেন কোচ সাবেলা।
বসনিয়া
অংশগ্রহণ: প্রথমবার
ফিফা র্যাঙ্কিং: ২৫
ডেইটন চুক্তি নিয়ে বসনিয়ানদের তিন বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের অবসান হয় ২০ বছর আগে। এবার বিশ্বকাপে চমকের অপেক্ষায় লড়াকু দেশটি। সাবেক যুগোস্লাভ রাষ্ট্র বসনিয়া হার্জেগোভিনা বিশ্বকাপে খেলছে প্রথমবার। তবে সম্ভাবনাটা দেখাচ্ছিল তারা বরাবরই। গত দুই বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বসনিয়ার স্বপ্ন ভাঙে একেবারে শেষ মুহূর্তে। দু’বারই বসনিয়াকে প্লে-অফে হারিয়ে বিশ্বকাপে যায় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল। এবার ইউরোপ অঞ্চলের বাছাই পর্বে সাবেক ইউরো কাপজয়ী গ্রিসকে পেছনে ফেলে গ্রুপসেরা মর্যাদা নিয়ে বিশ্বকাপের টিকিট কাটে বসনিয়া। আর আক্রমণাত্মক ফুটবল কৌশল নিয়ে বোদ্ধাদের আলাদা প্রশংসা শোনেন বসনিয়া কোচ সাফেত সুসিচ। ফরাসি দল প্যারিস সেইন্ট জার্মেই-এর সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের মর্যাদা কুড়ানো সাবেক যুগোস্লাভ তারকা সাফেত সুসিচ নিজে বিশ্বকাপ খেলেছেন দু’বার। ১৯৮২’র পর ১৯৯০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সুসিচের আলাদা হতাশার স্মৃতি। সেবার মারাদোনার আর্জেন্টিনার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে সুসিচ-স্টয়কোভিচদের যুগোস্লাভিয়ার স্বপ্ন ভাঙে টাইব্রেকারে হার নিয়ে। পুরো ম্যাচে কোণঠাসা আর্জেন্টিনা পার পায় টাইব্রেকারে গোলরক্ষক গায়কোচিয়ার নৈপুণ্যে। ওই ম্যাচে পেনাল্টি মিস করেন মারাদোনা। তবে এবার কোচ সুসিচকে শক্তি জোগাচ্ছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড স্ট্রাইকার ইদিন জেকো, এএস রোমার মিরালেম পিয়ানিকরা। ফ্রান্স দলে আমন্ত্রণ পেলেও পিয়ানিক বিশ্বকাপে বেছে মাতৃভূমিকে। এবারের ইতালি সিরি ‘এ’ লীগে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় মিরালেম পিয়ানিকের ফ্রি-কিক দক্ষতায় আলাদা নজর রাখছেন বোদ্ধারাও। এবারের বাছাই পর্বে গ্রিসকে গোল পার্থক্যে পেছনে রাখা বসনিয়া কোচ সুসিচ বলেন, আমরা হয়তো একটু বেশিই আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলি। এতে ঝুঁকি থাকে ঠিক, তবে এতে বেশি গোল নিয়ে সুফলটাও ভোগ করছি আমরা। এবারের বাছাইয়ে ইউরোপে সর্বাধিক ৩০ গোলের কৃতিত্ব বসনিয়ার। আর অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্বে ধুঁকতে থাকা দেশটি এবারের বিশ্বকাপে কমপক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ড খেলবে এমন বাজি ধরছে বিশ্বের শীর্ষ বাজিকররা।
ইরান
অংশগ্রহণ: ১৯৭৮, ১৯৯৮, ২০০৬
সেরা সাফল্য: গ্রুপ পর্ব
ফিফা র্যাঙ্কিং: ৩৭
তিনবারের বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডের গ-ি পার করতে পারেনি ইরান। এবার ইরানিদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রেজা ঘুচানেজাদ। নেদারল্যান্ডসে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এ ফুটবলারের ইরান দলে এ পর্যন্ত নৈপুণ্যটাও ভক্তদের কাছে আশা জাগানিয়া। ইরানের হয়ে গত বছর অভিষিক্ত এ স্ট্রাইকার এ পর্যন্ত ৬ ম্যাচে করেছেন সমান ৬ গোল। গত বিশ্বকাপে বিদায় শেষে পর্তুগাল দলের চাকরি হারান কোচ কার্লোস কুইরোজ। এসময় এশিয়া অঞ্চলের বাছাইয়ে ইরান দলের দায়িত্ব নেন এ পর্তুগিজ কোচ। বাছাইয়ের মূল পর্বে প্রথম পাঁচ ম্যাচে তিন হার নিয়ে ব্রাজিল বিশ্বকাপ দূরে দেখাচ্ছিল ইরানের সামনে। এসময় পাঁচ ম্যাচে ইরান তারকা গোল দেখান মাত্র দুইবার। তবে বাছাইয়ে শেষ তিন ম্যাচে টানা জয় নিয়ে ব্রাজিলের টিকিট হাতে নেয় ইরান। এতে শেষ ম্যাচে তারা হারায় শক্তিধর দক্ষিণ কোরিয়াকে। বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে ইরানের একমাত্র জয়টি তাদের কাছে আলাদা তাৎপর্যের। ১৯৯৮’র বিশ্বকাপে ইরান এতে হারায় চির বৈরী দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে। তবে স্বদেশী লীগের খেলোয়াড় নিয়ে গড়া বিশ্বকাপে এবারের ইরান দলের প্রধান শক্তিটা তাদের রক্ষণভাগে। বাছাইয়ের শেষ পর্বে আট ম্যাচে মাত্র দুই গোল হজম করে ইরান।
নাইজেরিয়া
অংশগ্রহণ: ১৯৯৪, ১৯৯৮, ২০০২, ২০১০
সেরা সাফল্য: দ্বিতীয় রাউন্ড ১৯৯৪, ১৯৯৮
ফিফা র্যাঙ্কিং: ৪৪
নাইজেরিয়া ভক্তরা নিশ্চয় কোচ স্টিফেন কেশির ক্যারিশমা দেখতে চাইবেন বিশ্বকাপেও। ২০১২’র আফ্রিকান নেশন্স কাপের যোগ্যতা কুড়াতে ব্যর্থ হয় নাইজেরিয়া। এতে কোচের দায়িত্ব ওঠে সাবেক তারকা স্টিফেন কেশির হাতে। দলে তারুণ্যের লালনে বছর ঘুরতেই ক্যারিশমা দেখায় কোচ কেশির নাইজেরিয়া। ১৯৯৪-এর পর ২০ বছরের বিরতিতে জিতে নেয় সর্বশেষ আফ্রিকান নেশন্স কাপ। ২০০৬’র বিশ্বকাপের আগে টোগো দলের দায়িত্ব সামলান স্টিফেন কেশি। তবে মূলযজ্ঞ শুরুর আগে টোগো দলে চাকরি খোয়ান এ নাইজেরিয়ান। এবারের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে আইভরি কোস্টের মতো অপরাজিত নাইজেরিয়াও। গ্রুপে দ্বিতীয়স্থানের দলের চেয়ে ৫ পয়েন্ট এগিয়ে প্লে-অফের যোগ্যতা পায় সুপার ইগলরা। ব্রাজিলের টিকিট পেতে প্লে-অফে ইথিওপিয়াকে হারায় তারা সহজ ৪-১ ব্যবধানে। বিশ্বকাপে আবির্ভাবেই চমক দেখায় নাইজেরিয়া। ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ এ পরপর বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডের যোগ্যতা দেখায় সুপার ইগলরা। তবে পরের দুই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব শেষেই দেশের বিমান ধরতে হয় নাইজেরিয়া দলকে।
আর্জেন্টিনা: লিওনেল মেসি (বার্সেলোনা), অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া (রিয়াল মাদ্রিদ), সার্জিও অ্যাগুয়েরো (ম্যানসিটি), গঞ্জালো হিগুয়েন (নাপোলি)।
বসনিয়া: ইদিন জেকো (ম্যানসিটি), ভিয়েজদান মিসিমোভিচ (গুইজহর রেনহে), মিরালেম পিয়ানিক (এএস রোমা), ভেদাদ ইবিসিভিচ (বিএফভি স্টুটগার্ট)।
ইরান: রেজা ঘুচানেজাদ (চার্লটন), জাভেদ নেকুনাম (কুয়েত এসসি), আশকান দেজাগাহ (ফুলহ্যাম), খসরু হায়দেরি (এস্তেগলাল)।
নাইজেরিয়া: ভিক্টর মোজেস (লিভারপুল-চেলসি), ভিনসেন্ট এনিয়েমা (লিল্), জন মিকেল ওবি (চেলসি), শোলা আমিওবি (নিউক্যাসল)।
‘জি’ গ্রুপের সূচি
১৫ই জুন: আর্জেন্টিনা-বসনিয়া রাত ৪টা
১৬ই জুন: ইরান-নাইজেরিয়া রাত ১টা
২১শে জুন: আর্জেন্টিনা-ইরান রাত ১০টা
২১শে জুন: নাইজেরিয়া-বসনিয়া রাত ৪টা
২৫শে জুন: আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া রাত ১০টা
২৫শে জুন: ইরান-বসনিয়া রাত ১০টা
উৎস- মানবজমিন