বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভবনে এক সপ্তাহ আগে দেশ ছাড়ার আগের আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম কোনো রাখঢাক না রেখেই জানিয়েছিলেন, ‘টুর্নামেন্টে টিকে থাকতে হলে প্রথম ম্যাচেই আফগানদের মারতে হবে।’ ভদ্রতার মেকি মুখোশের বদলে দুর্জয় সাহসকে কাল ঔদ্ধত্য মনে হতে দেননি তিনি। মামুনুল যে আড়ালে লুকিয়ে যাওয়ার মানুষ নন! ওয়াহেদের বাড়ানো ব্যাকপাসে ডান পায়ের জোরালো শটে বল আফগান গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে যখন জালে পাঠিয়েছেন, তখন ঔদ্ধত্যের বদলে ঠিকরে বেরোল আত্মবিশ্বাস। দেশের পতাকা বুকে নিয়ে ইতিহাস পড়ার প্রত্যয়ে মাঠে নামার মানসিকতা। যেখানে গর্ব আছে, ঠুনকো অহংকার নেই। অধিনায়ক কথা দিয়েছিলেন, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে এনে দেবেন দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকিট। সেই প্রতিজ্ঞাপূরণে গত কয়েকটা দিন কঠিনই গেছে তাঁর। কারণ দল মাঠে নামার আগেই বেশ খানিকটা পিছিয়ে। অন্যতম সেরা খেলোয়াড় আতিকুর রহমান চোটের কারণে বিদায় নিয়েছেন মূল পর্ব শুরুর আগেই। আফগানিস্তানকে হারিয়েই এশিয়াড শুরু বাংলাদেশের তাঁর বদলি হিসেবে কোচের পছন্দ ছিল মিঠুন চৌধুরী, তাঁরও ‘বিকল্প’ জাহিদ হোসেন কালই যোগ দিলেন দলের সঙ্গে। তবু আতিকুর রহমানের অভাবটা কি এত সহজে যায়? তাঁর অবর্তমানে বাংলাদেশ দলটাকে দেখিয়েছে অগোছালো। নিজেদের রক্ষণে বেশ কয়েকবার আফগানদের আক্রমণ রুখতে হয়েছে রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের। ২১ মিনিটে গোলরক্ষকের ভুলে তো গোলই খেতে বসেছিল বাংলাদেশ, ভাগ্যিস লিটন শরীরটাকে গোললাইনের পেছনে ঠেলে দিলেও বল ধরা হাতটা রেখেছিলেন বাইরেই। ম্যাচের ২১ মিনিটে নিজেদের বক্সের ভেতর আফগান ফরোয়ার্ড মোহাম্মদ আহমেদ সান্দজারকেকে বিপৎজনকভাবে পেছন থেকে ফাউল করেছিলেন বাংলাদেশ দলের ইয়াসিন, রেফারি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিলেও যা অবাক করত না জাতীয় দলের সহকারী কোচ রেনে কোস্টারকে। এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে খানিকটা অসন্তোষই ঝরল আফগান কোচের কণ্ঠে। ফরোয়ার্ড ওয়াহেদও নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। বল বেশিক্ষণ পায়ে ধরে রাখার চেষ্টা করলেও সেই কৌশল অন্তত কার্যকর মনে হয়নি আফগানদের বিপক্ষে। সম্ভাবনাময় জায়গা থেকে গোলে শট নিতেও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি বেশ কয়েকবার।
সেই ওয়াহেদই শেষ পর্যন্ত গোলের কারিগর! বাংলাদেশ দলের আক্রমণের ধারাটা ছিল মাঠের ডান প্রান্ত ঘেঁষে। সেখান থেকে তপু বর্মণের কাটব্যাকের পর ইউসুফ সিফাতের মাইনাসে বল পেয়ে যান ওয়াহেদ। নিজের নেওয়া শটগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল বলেই হয়তো পেছনে বলটা ঠেলে দিয়েছিলেন মামুনুলের উদ্দেশে। বেশ খানিকটা দৌড়ে এসে নেওয়া মামুনুলের দূরপাল্লার শটটা গোলবারে ঢুকতেই শোনা গেল উপস্থিত শখানেক বাংলাদেশি দর্শকের উল্লাস। ইনচিওনের ফাঁকা স্টেডিয়ামের এক কোণে জাতীয় পতাকা হাতে একজন বসে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশি লাল-সবুজের পতাকাটা ওড়ালেন অনেকক্ষণ।
ইনজুরি সময় মানেই বাংলাদেশের বর্মে ফুটো, যে ছিদ্র গলে অনেক সময় বেরিয়ে যায় জয়। রেফারির ঘোষণা করা চার মিনিট ইনজুরি সময় যেন আর শেষই হয় না! এইসময়ে আফগানরাও বেশ চাপে ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। সেসময় সবাই মিলে জমাট হয়ে রক্ষণ করেছেন, ১-০ গোলের ন্যূনতম ব্যবধানটা ধরে রেখেছেন মরিয়া হয়ে আর গোলরক্ষক রাসেল মাহমুদও দেখিয়েছেন দৃঢ়তা। শেষবেলায় জয়ের ব্যবধানটা বেড়েও যেতে পারত বাংলাদেশের। আফগানরা রক্ষণভুলে গোল শোধ করতে মরিয়া, গোলরক্ষকও উঠে এসেছিলেন প্রায় মাঝমাঠে। এমন সময় সোহেল রানার চিৎকারে জামাল ভুঁইয়া খেয়াল করেন প্রতিপক্ষের গোলবার ফাঁকা! অনেকটা দূর থেকেই শট নিয়েছিলেন ডেনমার্কপ্রবাসী এ ফুটবলার, কিন্তু গোলের ঠিকানায় যায়নি বল। তাতে বাংলাদেশের জয়ের দিনে জামাল ৬০ ভাগ খুশি আর ৫০ ভাগ মন খারাপ, দেশের হয়ে প্রথম গোলটা যে হলো না!
তা না হওয়ায় ২-০’র বদলে ১-০তে জিতেছে বাংলাদেশ। এতে করে পয়েন্টে তো আর কোনো ঘাটতি পড়ছে না! সেই সঙ্গে ১৯৮৬-র সিউল এশিয়াডের পর এশিয়ান গেমসের ফুটবলে ম্যাচ জিতে জয়খরাও ঘুচেছে বাংলাদেশ দলের। সেদিন আসলামের গোলে নেপালকে হারানোর পর যে আর জয়ের দেখাই পাচ্ছিল না ফুটবল! এখন প্রথম ম্যাচে পুরো ৩ পয়েন্ট নিয়ে দাপটের সঙ্গেই দ্বিতীয় পর্বে যাওয়ার লড়াইতে টিকে আছে বাংলাদেশ। ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে এই ফলকে কোচ লোডউইক ডি ক্রুইফ বলছেন চমক, আসরের প্রথম অঘটন। আর মামুনুল কিছু না বলেও গোলের ভাষায় বলে দিলেন, এটা আসলে পুরনো দেনাটা সুদে আসলে ফিরিয়ে দেওয়া! তাঁর কণ্ঠে যে আভাসটা পাওয়া গিয়েছিল দেশ ছাড়ার আগেই!
বাংলাদেশ দল : রাসেল মাহমুদ (গোলরক্ষক), ইয়াসিন, রায়হান, তপু বর্মণ, ইয়ামিন মুন্না, জামাল, মামুনুল, সিফাত/ফরহাদ, হেমন্ত, সোহেল রানা, ওয়াহেদ
আফগানিস্তান : মানসুর (গোলরক্ষক), আবাসসিন, ফখরুদ্দিন, ফারজাদ, ইকবালজাদে, মুস্তাফা, তাহের, ফয়সাল, আহমাদি, জেলালুদ্দিন, আনওয়ার