রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩১ ভাদ্র ১৪৩১খবরিকা অনলাইনে আপনাকে স্বাগতম।

অলিনগর সীমান্তে চোরাচালান : দায় অস্বিকার

 

:: মাহবুব পলাশ ::

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের ফেনী নদীর আমলীঘাট এলাকা এখন চিনি পাচারের নিরাপদ রুট। প্রতিদিন দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর চোখ ফাঁকি শত শত বস্তা চিনি ঢুকছে বাংলাদেশে। আর এসব চিনি করেরহাটের একটি গোডাউনে আসতো। সেখান থেকে আসেপাশের এলাকা ছাড়াও সরবরাহ করা হয় চট্টগ্রাম শহরে। গত কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ ৩ টন চিনি সহ ২ ব্যক্তিকে আটক করে। এছাড়া চলতি মাসে ৬৫ বস্তা চিনি জব্ধ করেছে বিজিবি। সর্বশেষ গত ২৫ জুন চিনি পাচারের সময় নদীতে ডুবে এক কিশোরের মৃত্যুর পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুধুমাত্র চোরালানের জের ধরেই বিএসএফ এর ধাওয়ায় এই কিশোর জাহেদ নদীতে পড়ে গিয়ে নিহত হবার পর দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় এই এলাকার চোরাচালানের প্রকৃত চিত্র। অথচ এর পূর্বে অভিযোগ উঠা স্বত্তে ও প্রশাসন পারেনি চোরাচালান বন্ধ করতে। এছাড়া এই রুট দিয়ে ফেনসিডিল আর ভারতীয় বিভিন্ন মাদকসামগ্রী চোরাচারানের ও তথ্য জানা যায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ থেকে। নামে মাত্র দু-একটা অভিযান হলে ও প্রকৃত অপরাধীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাহিরে।
করেরহাট ইউনিয়নের আমলীঘাট এলাকার স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আমলীঘাট এলাকাটি চিনি পাচারের নিরাপদ রুট হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিনি পাচারের জন্য ভারতীয় পাহাড়ি এলাকায় সুড়ঙ্গ করা হয়েছে। সুড়ঙ্গ দিয়ে ভারতীয় পাচারকারীদের যোগসাজসে চিনিগুলো বাংলাদেশে পাচার করা হয়। চিনি পাচারে ব্যবহার করা হয় স্থানীয়দের। রাত ৮টার পর থেকে শুরু হয় চিনি পাচার। এসময় ২শত থেকে ৩শত শ্রমিক সুড়ঙ্গ পথে ভারত থেকে চিনির বস্তাগুলো নিয়ে এসে নৌকা ভর্তি করে। প্রতি বস্তা চিনি পারাপারের দেয়া হয় দুইশত টাকা। একজন কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ বস্তা চিনি আনতে পারে। চিনি পারাপারে মাঝি হিসেবে কাজ করে স্থানীয় মফিজুল, জামাল ও রাইফুল। এদের কাজ চিনি পাচার শ্রমিক সংগ্রহ করা।
এ বিষয়ে চিনি পাচার শ্রমিক সংগ্রহকারী সিন্ডিকেটের সদস্য মফিজুলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগর গ্রামের জামাল মাঝি ও তার ভাই রাইফুল চিনি পাচারের মাঝি হিসেব কাজ করে। আমি মাঝে মাঝে করলেও এখন করি না। আরো জানা গেছে, চিনি পাচারের সাথে করেরহাট ও এর আশপাশের এলাকার প্রায় ৩০ জন জড়িত। তবে নিরাপত্তার ভয়ে কারো নাম বলতে পারেনি মাঝিরা। এবিষয়ে চিনি পাচারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা পেটের দায়ে চিনি পাচারের শ্রমিক হিসেবে কাজ করি। এটা করে এলাকার দুইশত থেকে তিনশত মানুষের সংসার চলে। নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক আমলিঘাট এলাকার এক ব্যক্তি (৬০) বলেন, করেরহাট ইউনিয়নের আমলীঘাট মেরকুম সীমান্ত দিয়ে প্রতি রাতে শত শত বস্তা চিনি বাংলাদেশে ঢুকে। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চিনির বস্তাগুলো বাংলাদেশে পাচার করে প্রভাবশালী চক্র। মাত্র ৩০ মিনিটের ব্যবধানে এক থেকে দুই হাজার টাকা আয় করায় স্থানীয় যুবকরা চিনি পাচারে জড়িয়ে হয়ে পড়ছে। একইভাবে নানা ভাবে ছোট বয়সী কিশোরদের দিয়ে ওপার থেকে আসছে ফেনসিডিল ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য। এপারে আনিয়ে এগুলো পাচারকারীরা কিছু ষ্টক হলে কৌশলে রাতের অন্ধকাওে চালান করছে বিভিন্ন স্থানে।
আবার প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে স্থানীয় করেরহাট বাজারের প্রভাবশালী নেতা মহিউদ্দিন কিরন এর পাইকারি দোকানের গোডাউন সহ চিনি চালানের জন্য রয়েছে পৃথক গোডাউন । যেখান থেকে গত প্রায় ৬ মাস ধরেই চোরাচালান নিয়ন্ত্রন হতো। উক্ত কিশোর নিহত হবার পর রাতারাতি সব মালামাল সরিয়ে কোন চিহৃই আর রাখা হয়নি পাইকারি দোকান বা গোডাউনে । এই বিষয়ে অভিযুক্ত মহিউদ্দিন কিরন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি কোন প্রকার চোরাচালানের সাথে সম্পৃক্ত নই । কেউ কেউ ষড়যন্ত্র করে আমার ভাই ও আমার নাম প্রচার করছে। তাহলে ভারতীয় চিনির বস্তার ছবি সহ ভিডিওচিত্র সামাজিক মাধ্যমে কিভাবে আসল জানতে চাইলে তিনি বলেন ইন্ডিয়া লিখা বস্তাগুলো চিনির নয় সারের।
এই বিষয়ে মীরসরাইয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন এই রুটে কিছুদিন পূর্বে ও আমরা চোরাচালানের নানা অভিযোগ ও তথ্য পেয়েছিলাম। অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমাদের এসিল্যান্ড প্রশান্ত চক্রবর্তি দুরাত পাহারা বসিয়ে ও কাউকে আটক করতে পারেনি।
এবিষয়ে জানতে চাইলে জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল হারুন বলেন, বর্ডার সাইটে আমাদের (পুলিশকে) বিজিবি ঢুকতে দেয় না। ওটা ওদের (বিজিবি) কাজ। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অলিনগর বিওপি কমান্ডের নায়েব সুবেদার আব্দুল কুদ্দুস বলেন, আমরা সব সময় সীমান্ত পাহারায় রয়েছি। স্থানীয়রা অনেক কথাই বলে। চিনি পাচারকারীদের সাথে বিজিবির কোন সম্পৃক্তা নেই। আমরা চলতি মাসে (জুন) ৬৫ বস্তা চিনি জব্ধ করেছি।
সব মিলিয়ে বন্ধ হচ্ছে না পাচার। আবার কিছু লোকদেখানো তৎপরতা থাকলে ও শর্ষের মধ্যেই ভূত থাকলে কি করে সম্ভব এবং অবৈধ চোরাচালান বন্ধ করা। অথচ বৈধভাবে বানিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য সরকার রীতিমতো রামগড় স্থলবন্দর স্বাপন করেছে । যা শীঘ্রই চালু হবে। এভাবে অন্যায়ভাবে চোরাচালান করতে গিয়ে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা পাশাপাশি আমাদের দেশের ভাবমূর্তি এবং আত্মসম্মান ও কি হচ্ছে না প্রশ্নবিদ্ধ ?
মাহবুব পলাশ, সাংবাদিক, মানবাধিকার পর্যবেক্ষক।